আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের কাঠগড়ায় মার্শাল আর্ট: পর্ব ২-অমোঘ অস্ত্রের সন্ধানে



ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক প্রথম অনুষ্ঠানে জোর দিয়েছিল কিংবদন্তীগুলোর সত্যাসত্য পরীক্ষা করে দেখায়,সেটা হবার পরে তারা দেখতে চাইলো,মার্শাল আর্টের 'আলটিমেট উইপন' বা 'অমোঘ অস্ত্র' কোনটা হতে পারে,মানুষের নিজের শরীর,নাকি হালকা কোন অস্ত্র। প্রথমে মানুষ নিয়েই পরীক্ষা শুরু হলো,এগিয়ে এলেন একজন কারাটে মাস্টার,এবং শুধুমাত্র কনুই দিয়েই বেশ কয়েকটা কংক্রিটের ব্লক ভেঙে দিয়ে চোখ কপালে তুলে দিলেন বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু বিস্ময়ের তখনো বাকি ছিলো,এবার তিনি তার মাথার খুলি দিয়ে একসাথে ১০টা কংক্রিটের ইট ভেঙে দিয়ে বোঝালেন,দীর্ঘ চর্চায় তার নিজের মাথাটাও ১টা অস্ত্র হয়ে গেছে বটে। মেপে দেখা গেল,তার খুলির এক আঘাতে ইটগুলোর উপর ২১১২ পাউন্ড,সোজা কথায়,১ টনের উপর বল দিয়েছেন,মানুষের উপর এই আঘাতটা করলে,হাড় ১টাও আস্ত থাকতো না। কিন্তু শুধু ১টা করে অঙ্গ কেন,পুরো শরীরটাকেই ১টা দানবীয় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

কিভাবে? আরেক কারাটে মাস্টারের সেটাই প্রমাণ করার পালা। একসারে সাজানো হলো ২০টা কংক্রিট ব্লক,মাস্টার ট্রাকের মত ছুটে এসে দিলেন ধাক্কা,প্রতিটা ব্লক ভেঙে গেল,আর মেপে দেখা গেল,এই ধাক্কায় মোট প্রয়োগকৃত বল ৪৭৫১ পাউন্ড,২ টনেরও বেশি তো,এই শরীরের রহস্য কি? বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যামতে,মানুষের হাড়গুলিতে 'গো স্লো' নীতি মেনে আস্তে আস্তে দীর্ঘদিন ধরে চাপ বাড়ালে ভেতরের ফাঁপা জায়গা আস্তে আস্তে ঘনীভূত হয়ে শক্তিটা বাড়িয়ে দেয়। প্রাচীন মার্শাল আর্ট গুরুরা সেটা জানতেন,এবং নিয়মমাফিক ধীর অনুশীলনে সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলতেন। ওস্তাদরা শরীর নিয়ে কি করতে পারেন সেটা তো দেখা গেল,এবার জানার ইচ্ছা হলো,হাতে হালকা কোন অস্ত্র পেলে তারা কোন জায়গায় যেতে পারেন,আর কোন অস্ত্রটাই বা 'আলটিমেট উইপন',যাকে বলা যায় সর্বগুণান্বিত হতে পারে। শুরু হলো ফিলিপাইনে ব্যবহৃত খাটো,৩ ফিট এর দু'টো লাঠি দিয়ে,যার নাম 'খালী স্টিক'।

ড্যান ইনাসান্তো,বুড়োর বয়স ৬৯ বছর,দেখালেন লাঠির কাজ। বিদ্যুৎ গতি,এবং সেটা ক্ষেত্রভেদে ঘণ্টায় ৯০ মাইল পর্যন্ত,আওতা প্রায় ৯ ফিট ব্যাসের ১টা বৃত্তাকার এলাকা,হাড়ভাঙার মত জোর,বলাই বাহুল্য। কিন্তু 'খালী স্টিক' এর সমস্যা হলো এর আওতা,বা রেন্ঞ্জ খুবই কম। সমাধান হিসেবে দেখা হলো 'চাইনিজ বো' কে,লাঠিটা লম্বায় ৬ ফিট,আওতা ১২ ফিট ব্যাসের ১টা বৃত্ত। ওজনেও একটু বেশি বলে আঘাতটাও বেশি জোরালো হয়,একই সাথে লম্বায় বেশি বলে ভরবেগ এবং মোমেন্ট মিলেও আঘাতটার জোর,বা ইমপ্যাক্ট হয় অনেক বেশি।

'চাইনিজ স্পিয়ার' ও একি রকম কাজ করে,শুধু সেটার সামনে ১টা ছোট ব্লেড থাকে,আর ব্লেডের গোড়ায় থাকে লাল পালক,যেটা একি সাথে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করে,আবার ব্লেডের আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে যে রক্ত লাগে সেটাকেও শুষে নেয়। 'বো' এবং 'স্পিয়ার',দু'টোই বৃত্তাকারে প্রবল বেগে ঘোরানো হয়,একি সাথে আঘাত করা এবং আঘাত ঠেকানোও চলে এভাবে। বলা হয়,মাস্টাররা যখন এভাবে ঘোরান তখন তীরও এই ঘূর্ণন বর্ম ভেদ করে ঢুকতে পারেনা। কিন্তু,এই ২টা অস্ত্রেরই দুর্বলতা হলো তাদের প্রচণ্ড আঘাত বা ইমপ্যাক্ট,খুব বেশি জোরে আঘাত করলে ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে,প্রতিপক্ষের কাছে লাঠিওয়ালা তখন একদমই অসহায়। সমস্যাটার সমাধানে এগিয়ে এল আমাদের সবার চেনা ব্রুস লী'র বিখ্যাত 'নান চাকু' বা 'নানচাক'।

লাঠি ভাঙার বদলে বরং দু'টো টুকরাকেই জোড়া দেয়া হলো ১টা চেইন দিয়ে,এবং বড় চাইনিজ বো কে ৩ ভাগেও ভাগ করা হলো। মার্শাল আর্টের হল অভ ফেমে জায়গা পেয়ে যাওয়া মার্ক হিকস দেখালেন নানচাকুর খেলা,আর চীনা জি লিং দেখালেন ৩ ভাগে ভাগ করা বো এর কাজ। সুবিধা,আঘাতের প্রচণ্ডতা একি রকম,কিন্তু 'ফ্লেক্সিবিলিটি' বা নমনীয়তা অনেক বেশি অস্ত্রটার,ফলে ভাঙার কোন সম্ভাবনাই নেই,একি সাথে আওতা বা রেন্ঞ্জ অনেক বেশি,নানচাকুর বেলায় ২০ ফিট ব্যাসের বৃত্ত থেকে বো এর বেলায় ৪০ ফিটের বৃত্ত পর্যন্ত। আবার,মারার পরে টান দিয়ে নিজের হাতে আরেকটা অংশকে নিয়ে আসা যায়,যার কারণে প্রতিপক্ষ এখানে সবসময়ই অরক্ষিত,কোন অংশটা কখন আসছে আন্দাজ করা সবসময়ই কঠিন কাজ। তবে,এই ফিরে আসা বা 'রিবাউন্ড'ই এর দুর্বলতা,চেইনের অপর প্রান্তের অংশটা যখন ফিরে আসে,১ সেকেন্ডের জন্য হলেও সেটার নিয়ন্ত্রণ যোদ্ধার হাতে থাকেনা,মার্শাল আর্টে যেটুকু সময় জয়-পরাজয়ও নির্ধারণ করে দিতে পারে।

এতক্ষণ যতগুলো অস্ত্রের কথা বলা হলো,সব কয়টারই আওতা সীমিত,তাহলে? একটা সময়ে,যখন আগ্নেয়াস্ত্র ছিলোনা,লং রেন্ঞ্জে যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র ছিল তীর বা বো,সব দেশেই,কুংফুতে যাকে কিয়োডো বলে। গতির চেয়ে এখানে অনেক বেশি জরুরী হলো গভীর মনঃসংযোগ আর দীর্ঘচর্চিত দক্ষতা। তীরন্দাজ যখন লক্ষ্যস্থির করেন দেখা গেছে সেসময় এমনকি তাঁর হৃদস্পন্দনও ধীর হয়ে যায়। ছোট রেন্ঞ্জ থেকেই অনুশীলন শুরু হয়,আস্তে আস্তে রেন্ঞ্জ বাড়তে থাকে। তীরের পেছনের পালকগুলো বাতাস কেটে তীরকে বুলেটের মত সোজা গতিপথ ধরে রাখতে সাহায্য করে,সোজা শত্রুকে গিয়ে ভেদ করার জন্য।

সমস্যা ১টাই,শর্ট রেন্ঞ্জে বা হাতাহাতি লড়াইয়ে এটা একেবারেই অকেজো। দূরপাল্লার আরেক হাতিয়ার 'শুরিকেন',যেটাকে নিনজা স্টার বললেও অনেকে চিনবেন। তারার মত এই স্টিলের ছোট্ট স্টারগুলো দক্ষ হাতে ভয়ংকর ঘাতক,অনেক দূর থেকে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম,স্টারের পাঁচটা মাথা বৃত্তাকারে ঘুরে বাতাস কেটে ভারসাম্য রাখে,জায়গামত বেঁধানোর জন্য। যদিও দুর্বল জায়গায় আঘাত করতে না পারলে মরণঘাতী নয়,আর ছোঁড়ার জন্য কিছুটা জায়গা আর সময় লাগেই,তীরের মত অতটা না হলেও। অমোঘ অস্ত্রের সন্ধানে এবার হানা দেয়া হলো তলোয়ারের রাজ্যে।

শুরু করা হলো 'চাইনিজ কুংফু সোর্ড' দিয়ে,নাম 'লিন'। হালকা-পাতলা,একদম সোজা গড়ন,নমনীয়,দারুণ গতিসম্পন্ন (ক্রাউচিং টাইগার হিডেন ড্রাগন মুভিতে এই তলোয়ারের খেলা অনেকে দেখে থাকবেন)। তীক্ষ্ণ ফলা,তাতে সহজেই বিপক্ষের সোজা বুক ভেদ করে ঢুকে যাবে তীরের মতই,কিন্তু হালকা এবং নমনীয় বলেই,'আর্মার' বা লৌহ বর্মে আঘাত করলে নিজেই ভেঙে যাবে,ফলাফল,খালি হাত আরেকটা সমস্যা,কাটে খুবই কম,২ ইন্ঞ্চির মত,ফলে যেটাকে স্ল্যাশ বলে,সেটা করে মরণ আঘাত হানার তেমন সুযোগ নেই। এবার আশ্রয় নেয়া গেল চওড়া ফলার 'ডাও' এর,একদিক ভোঁতা,এদিক দিয়ে আঘাত ঠেকানো হয়,আর ধারালো দিকটা দিয়ে আঘাত করা হয়। 'ডাও' কাটে বেশি,৫ ইন্ঞ্চির মত,বাতাসে মাঝপথেই দিক বদলানো যায়,ভাঙেও না সহজে,কিন্তু ফলাটা তীক্ষ্ণ নয় বলে ভেদ করে কম,আঘাতটাও পিন পয়েন্ট হয় না।

অমোঘ অস্ত্রের সন্ধানে সবশেষে আসা হলো কিংবদন্তীর সামুরাই যোদ্ধাদের কাছে,তাদের অস্ত্র,'সামুরাই সোর্ড' বা 'কাতানা'র শক্তি পরীক্ষা করার জন্য। ৭০০ শতকের এক কারিগরের আবিষ্কার এই তলোয়ার। কাঠামো তৈরি উন্নত মানের স্টিল দিয়ে। হালকা,সামান্য বাঁকানো, ব্লেডের কিনারাগুলো ধারালো,ফলা তীক্ষ্ণ। চমৎকার ভারসাম্য,একি সাথে প্রচণ্ড গতি।

সামান্য বাঁকানো গড়নের জন্য অনায়াসে বাতাস কেটে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যে আঘাত করতে সক্ষম,একি সাথে,শক্ত আর তীক্ষ্ণ ফলাবিশিষ্ট বলে ভেদ করতে পারে অনেক বেশি,মানবদেহে প্রায় ১৮ ইন্ঞ্চি পর্যন্ত ভেদ করে যায়,যাকে বলে,একেবারে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়া। তৈরিই হয়েছে যেন যোদ্ধার হাতে মানাবার জন্য,বৃত্তাকারে,সমান্তরালে,শূন্যে,বা সোজাভাবে,যেকোনভাবে মরণ আঘাত করার জন্য চমৎকার অস্ত্র,বেশ লম্বা বলে আওতাও অনেক বেশি,একি সাথে স্টিলের তৈরি বলে নিজে তো ভাঙেই না,বরং হালকা যেকোন অস্ত্রকে ভেঙে দিতে জুড়ি নেই। এজন্যই বলা হয় যে,সামুরাই কাতানা অস্ত্র আর যোদ্ধার আত্মাকে একাকার করে নেয়। এই সামুরাই কাতানা উপযুক্ত হাতে কতটা ভয়ঙ্কর,দেখাতে এগিয়ে এলেন মাস্টার তোশিরো ওবাহাতা,৭ বার কাটিং চ্যাম্পিয়ন। কাটিং প্রতিযোগিতাটা কি সেটা এখানে বলে নেয়া দরকার,প্রতি বছরই হয়,সামুরাই মাস্টারদের মাঝে।

তো কাটার জন্য মানুষ তো পাওয়া যাবেনা,এক্ষেত্রে কাঁচা বাঁশের উপর ম্যাট জড়িয়ে দেয়া হয়,বাঁশটা মানুষের হাড়ের মত কাজকরে,আর ম্যাট করে মাংসের কাজ। মাস্টার ওবাহাতার একটা মাত্র কোপ,বাঁশ একবারে ২টা দ'টুকরো হয়ে গেল,মানুষের হাত-পা থাকলে সেটারো যে একি অবস্থা হতো সন্দেহ নেই। শেষে আনা হলো বিশেষভাবে তৈরি একটা ডামি,এক ধরণের ফ্লেক্সিবল পলিমার দিয়ে বানানো,ব্যবহার করা হয় বুলেটের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য,জিনিসটা মানবদেহের মত কাজ করে। এবার পরীক্ষার পালা,সামুরাই যুদ্ধের যে মূলনীতি,"ওয়ান কাট ওয়ান কিল"(বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ২য় আঘাতের সুযোগ পাওয়া যায়না),সেটা কতটা ঠিক। পরীক্ষার ফল ভয়ানক,এক আঘাতেই বুলেট ঠেকানো ডামি সোজা দু'ভাগ,মানুষের পরিণতি সহজেই অনুমেয়।

সব মিলে,বিজ্ঞানীদের রায়,গতি,রেন্ঞ্জ বা পাল্লা,ভয়ঙ্কর আঘাতের শক্তি,ভারসাম্য,আঘাত ঠেকানোর উপযুক্ততা,নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাতের ক্ষমতা,সব মিলে সামুরাই কাতানার উপরে কোন অস্ত্র নেই মার্শাল আর্টের ইতিহাসে। তারপরেও কিন্তু কথা থেকে যায়,অস্ত্র যতই ভালো হোক,শেষমেশ লড়াইয়ের ফলাফল কিন্তু যোদ্ধার ব্যক্তিগত দক্ষতার উপরই নির্ভর করে,মানুষের চেয়ে বড় কে কবে হতে পেরেছে আর?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.