আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্যাঁচালো কথা, বাঁকা কথা

বসে আছি পথ চেয়ে....

আজকাল বাঁকা কথা খুব চলছে। সোজা কথা কেউ আর সোজা করে বলতে চায় না। হয়তো বলতেও পারে না। সবার পেটে যেমন জিলেপির প্যাঁচ; কথাও তেমনি প্যাঁচানো। সোজাসুজি, সহজভাবে কথা বলাটা মানুষ কেমন ভুলেই যাচ্ছে।

অনেকেই অবশ্য শুরুতেই আপত্তি জানাতে পারেন। কথা তো কথাই; তার আবার সোজা-বাঁকা বা প্যাঁচানো কী? তাদের উদ্দেশ্যে বলতে হয়: হ্যাঁ কথার মধ্যেও প্যাঁচ আছে। সোজা ও বাঁকা আছে। বলা বাহুল্য, সারাণ আমরা এতো বেশি বাঁকা কথা বলি এবং শুনি যে, এর বাইরে যে সহজ-সরল কোনো কথা আছে বা থাকতে পারে তা-ই অনেক সময় ভুলে যাই। বাঁকা কথা কম-বেশি সবার মুখে শোনা গেলেও তা কিন্তু কেউই স্বীকার করে না।

ক্ষমতাসীনরা যেমন নিজেদের অপকর্ম ও ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে না; ঘুষখোর স্বীকার করে না ঘুষ গ্রহণের কথা। তেমনি যারা বাঁকা কথা বলে তারাও তা স্বীকার করতে চায় না। যে লোকটিকে আমরা সবচাইতে পেঁচুয়া ও বাঁকা কথা বলার ওস্তাদ হিসেবে জানি, তার মুখেও শোনা যায়: সে খুবই সহজ-সরল লোক। সে প্যাঁচ মোটেও বোঝে না। বাঁকা কথা সে বলতে তো নয়ই, শুনতেও পছন্দ করে না।

যারা বাঁকা কথা বলে তাদের সে অপছন্দ করে। এটা মানুষের এক আশ্চর্য মানসিকতা। যা তার স্বভাব বা বৈশিষ্ট্যের অংশ, তা সে কখনো স্বীকার করতে চায় না। যে নিজেকে -সোজা কথার মানুষ দাবি করে, সে আসলে ভয়ানক প্যাঁচালো মানুষ। বাঁকা কথা বলাটা তার অস্থিমজ্জাগত।

এই বাঁকা কথা বা প্যাঁচালো কথা শেখার জন্য কোনো বিদ্যালয়, পাঠশালা বা ট্রেনিং সেন্টার নেই। তারপরও সবাই কতো সহজেই না তা আয়ত্ত করছে। দৈনিকজীবনে আমাদের প্রতিনিয়ত প্রিয়জন বা অপরিচিত লোকের সঙ্গে শত্রু বা বন্ধুর সঙ্গে খারাপ-ভালো যে সব কথা বলতে হয়, বাক্যালাপ চালাতে হয়- সেসব কথা আমাদের কেউ শিখিয়ে দেয় না। কথা বলতে পারাটা আমাদের জন্ম প্রতিভা। আর বাঁকা কথা বলাটা বিশেষ প্রতিভা।

বাঁকা কথা বা প্যাঁচ হলো বুদ্ধির ব্যাপার। এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, তাদের বুদ্ধি এতোই প্যাঁচালো যে, তাদের মগজের মধ্যে পেরেক ঢুকিয়ে দিলে তা স্ক্রু হয়ে বেরিয়ে আসবে এবং এই স্ক্রু দিয়ে তিনি যাকে ইচ্ছে তাকে যতো ইচ্ছা টাইট দিতে পারেবেন। তবে শুধু অন্যকে টাইট দেয়ার জন্য মানুষ প্যাঁচ কষে না; বিভিন্নজনকে নানাভাবে জব্দ করার জন্যও অনেকে প্যাঁচ কষে। বলা যায় মনের আনন্দে প্যাঁচ কষে। এ ব্যাপারে আলোচনা অনেক হলো, এবার আমরা সরাসরি উদাহরণে যাবো।

একজন আরেকজনকে অত্যন্ত সহজভাবে প্রশ্ন করলো : ভাই আপনার ঘড়িতে কয়টা বাজে? ঘড়িওয়ালা এর যা উত্তর দিলো তা অভাবনীয়। তিনি উল্টে প্রশ্ন করলো, আপনার কয়টা প্রয়োজন? আরেকটা উদাহরণ দেয়া যাক। অনেকের যেমন অভ্যাস থাকে, এক ভদ্রলোক আমের বাজারে পাকা আম টিপে টিপে দেখছেন। বলা বাহুল্য আমের দোকানদার তাকে মানা করে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি অবিচল। অবশেষে আমের দোকানি এক প্যাঁচ কষলো।

তিনি আকস্মিক উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ওরে তোরা আর চিন্তা করিস না। আমের ডাক্তার এসে গেছেন, ডাক্তার সাহেব সব আম টিপে টিপে দেখে চিকিৎসা করবেন। তোদের সব আম নিয়ে আয়। প্যাঁচালো বুদ্ধি যে শুধুমাত্র বড়দের থাকে তা নয়। অল্প বয়সীদের মধ্যেও এর অভাব নেই।

স্কুলের স্যার রচনা লিখতে দিয়েছেন। রচনার বিষয়-আলস্য। নির্দিষ্ট দিনে সবাই রচনার খাতা জমা দিলো। প্রত্যেকেই যে যার মতো করে দু-তিন পৃষ্ঠা করে লিখেছে। শুধু একটি ছেলে ব্যতিক্রম।

তার রচনা খাতার মাথায় লেখা আছে-আলস্য। এর পর তিন পৃষ্ঠা সাদা। তৃতীয় পৃষ্ঠার নিচে বড় বড় অরে লেখা আছে-এরই নাম আলস্য। অবশ্য এর চাইতেও প্যাঁচালো বুদ্ধির ছেলে আছে। এক বালককে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, তুমি সাঁতার জানো? সে বলেছিলো, মাঝে মাঝে।

মাঝে মাঝে মানে? বালকটির অকপট জবাব, মাঝে মাঝে মানে ওই যখন পানিতে নামি তখন। প্যাঁচালো কথা বা বাঁকা কথা সবাই বললেও আদালতের আঙ্গিনায় নাকি তা সবচাইতে বেশি চলে। গাড়ি চুড়ির মামলায় জজ সাহেব আসামিকে প্রশ্ন করলেন, তুমি গাড়িটা চুড়ি করতে গেলে কেনো? আসামি করজোরে বরলো, না হুজুর আমি গাড়িটা চুরি করিনি। জজ সাহেব বললেন, পুলিশ যে তোমাকে ওই গাড়িটা রাস্তায় চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার করেছে? আসামি বললো, সেটা আমি অস্বীকার করছি না। জজ সাহেব বললেন, তবে? আসামি বললো : হুজুর আমি ভেবে ছিলাম গাড়িটার বুঝি কোনো মালিক নেই।

জজ সাহেব বললেন, কেন? আসামির জবাব : হুজুর আমি দেখলাম গাড়িটা একটা গোরস্থানের সামনে দাঁড় করানো রয়েছে। ভাবলাম এর মালিক যখন গোরে গেছে, আমিই এটা নিয়ে যাই। আমাদের দেশে বাঁকা কথা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। কান পাতলেই শোনা যায় বাঁকা কথা। সেদি শুনলাম একজন আরেকজনকে বলছে : দেখো, তোমার ভাইকে এখন থেকে সাবধানে কথাবার্তা বলতে বলো।

তা না হলে কিন্তু ফল খারাপ হবে। দ্বিতীয়ব্যক্তি : কেনো সে কি করেছে? প্রথমব্যক্তি : সে আমার নামে যাচ্ছেতাই সব মিথ্যা কথা বলে বেড়াচ্ছে। দ্বিতীয়ব্যক্তি : তাতে তোমার রাগের কি আছে ! যতোক্ষণ পর্যন্ত না আমার ভাই তোমার বিষয়ে সত্যিকথা বলছে, তোমার আপত্তি করার কিছু নেই। বাঁকা কথা প্রসঙ্গে আবারো মনে পড়ছে আদালত করে একটি গল্প। উকিল আদালতকে জানালেন : স্যার আমার পরে দুজন সাক্ষী অনুপস্থিত।

আজকের মামলা মুলতবি রাখা হোক। আমাকে পরের একটি তারিখ দিন। জজ সাহেব আদালতের দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার মামলা মুলতবি রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। ওই দেখুন সাক্ষী দুজন এসে গেছে। উকিল সাহেব মাথা ঘুড়িয়েই দেখলেন সত্যিই সাক্ষী দুজন এসে গেছে; কিন্তু তবু তিনি মামলা মুলতবি রাখতে চাইলেন।

বিস্মিত জজ সাহেব বললেন, কিন্তু কেন? উকিল বললেন, ওই সাক্ষী দুজন মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। এরা আমাদের কথা দিয়েছিল যে আদালতে আসবে না। পরিশেষে বাঁকা কথা বা প্যাঁচালো কথা নিয়ে একটি রসালো গল্প। একজন ধূরন্ধর গ্রাম্য লোক খালের পাড়ে গাছতলায় বসে তামাক খাচ্ছিলো। পাশে তার শিশু ছেলেটি।

এ সময় এক চতুর পথিক সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। গ্রাম্য লোকটিকে দেখে সে থামলো এবং তার পাশে গিয়ে বসলো। ভাব জমানোর জন্য পথিক গ্রাম্য লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, এ ছেলেটি কি আপনার? গ্রাম্য লোকটির তৎণিক বাঁকা জবাব, আমার নয় তো কি আপনার? পথিক : খালে পানি কতোটা? গ্রাম্য লোক : মেপে দেখিনি। পথিক : পার হওয়া যাবে কি? গ্রাম্য লোক : কতো গরু ছাগল পার হয়, আর অপনি পার হতে পারবেন না? পথিক : কাপড় ভিজবে কি? গ্রাম্য লোক : হাতি ঘোড়া ভেজে আর আপনার কাপড় ভিজবে না? পথিক যদি কিছু মনে না করেন, তামাকটা দিলে একটু খেতুম. . . গ্রাম্য লোক : এ কথা আগে বললেই হতো। বাঁকা কথা বাহুল্য হলেও নিরর্থক নয়।

বাঁকা কথার আড়ালেও স্বার্থবুদ্ধি লুকিয়ে থাকে। বাঁকা কথা আসলে স্বার্থসিদ্ধির একটা সূক্ষ্ণ কৌশল। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষিত সচেতন মানুষ এ ব্যাপারে বরাবরই সিদ্ধহস্ত (শেয়ালতন্ত্র জিন্দাবাদ গ্রন্থ থেকে)।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।