আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপাকে মনে পড়ে ( বাকি অংশ)



তো আমাদের বন্ধুত্ব আশ্চর্য সাবলীলভাবে চলতে শুরু করল। আমাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠি। কিন্তু ক্যাডেট কলেজে সব চিঠি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চেক হয়ে আসায় ওর চিঠি সরাসরি হাতে পাওয়ার উপায় ছিল না। তাই অনেক ঝামেলা করে খুঁজে বের করলাম এক অদ্ভুত পদ্ধতি..... কলেজের গেটের সাথে লাগোয়া এক চায়ের দোকান ছিল। সেই দোকানের ঠিকানায় আসতো ওর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা সেই অদ্ভুত মায়াবী চিঠিগুলো।

যেদিন ওর চিঠি আসতো সেই দিনটা যেন আমার সারাদিন নেশার মতো পার হয়ে যেত। ক্লাসে চিঠিটা থাকতো আমার বুকপকেটে, প্রেপে ফিজিক্স বইয়ের ভেতর আর রাতে ঘুমোতে যাবার সময় থাকতো বালিশের পাশে...... সেসময় শরদিন্দুর এক উপন্যাসের কাহিনি শুনে মাথায় শরদিন্দুর ভূত চাপলো। সেই উপন্যাসের নায়ক নায়িকা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতো এক অদ্ভুত উপায়ে। প্রতি পূর্নিমায় তারা রাতের এক নির্দিষ্ট সময়ে একইসাথে চাদেঁর দিকে তাকাতো। আর নিজেদের না বলা কথাগুলো সেই মাথা খারাপ করে দেয়া রূপালি আলোদের শোনাতো।

এই কাহিনি শুনে মনে হলো , আরে, শরদিন্দু তো এই উপন্যাস আমার জন্যই লিখেছেন। আমিও তো কখনো রূপাকে দেখিনি। যাহোক, পরের চিঠিতেই ওকে জানালাম। ও বলল , এর পরের পূর্নিমায় ঠিক বারোটা এক মিনিটে ও চাদেঁর দিকে তাকাবে। অবশেষে বহু প্রতিক্ষার পর পূর্নিমা এলো।

সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ছাদে ওঠলাম। ঘড়ির কাটা ঠিক বারোটা এক মিনিটে পৌছুলে বুকের ভেতর শিরশির করে উঠলো। সেই সতেরো বছরের ভীরু ভীরু বুকের শিরশর অনুভূতি যে কেমন ছিলো তা আর লিখে বোঝানো যাবে না। এর পর থেকে ঝড় হোক , বৃষ্টি হোক, পরীক্ষা হোক, অসুখ হোক ..... যাই হোক না কেন , প্রতি পূর্নিমায় আমি চাদেঁর দিকে তাকাতাম। কারন আমি জানতাম, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্য কোন জায়গায় অন্য কোন স্থানে, অন্য কোন ঘরের জানালা দিয়ে রূপা নামের এক আশ্চর্য তরূনী চোখ তুলে চাদেঁর দিকে তাকিয়ে আছে।

যাহোক , এবার আমাদের বন্ধুত্বের কথা বলি। ওর সাথে পরিচয়ের প্রথমেই বলেছিলাম-- আমি দুদিনের বন্ধুত্বে বিশ্বাস করি না। আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে হলে সারা জীবনের জন্য করতে হবে। ও পরের চিঠিতে আমাকে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলো। ওর সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি।

ও প্রচন্ড জোরাজুরি করতো দেখা করার জন্য। কিন্তু আমার মনে হতো, থাকনা পৃথিবীতে এমন কিছু সম্পর্ক,যার কোন ব্যাখ্যা হয়না...... এরপর আমাদের সময় বয়ে চলে। কখনো বৃষ্টির মতো, কখনো বন্যার মতো , কখনো ঝড়ের মতো, কখনো মেঘের মতো.... যাহোক , আমি ক্যাডেট কলেজ ছেড়ে কিভাবে কিভাবে যেন 'বি এম এ'তে ঢুকে পড়লাম। আর এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে ইচ্ছে থাকলেও ওর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারতাম না। তারপর , এক দুপুরে কিংবা বিকেলে ওর চিঠি পেলাম।

চিঠি পড়ে আমার অনুভূতি শূন্য হয়ে গেল। চিঠিটা ছিলো বারো পৃষ্ঠার। আমাকে দেয়া রূপার সেটাই ছিলো শেষ চিঠি। যার সারমর্ম ছিলো অনেকটা এরকম------ ''''তুমি আমার সাথে দেখা করবে না জানি। আর আমি এও জানি যে আমাদের এই অদ্ভুত সম্পর্কের কোন পরিনতি নেই।

কিন্তু আমি তো খুউব টিপিক্যাল একটি মেয়ে। আমার পক্ষে আর এই প্লাজমা টাইপ সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব নয়। তুমি প্লিজ আমাকে ভুল বোঝনা....... আর তিন চার বছর পর আমার বিয়ে হবে। আর তুমি তো জান, আমাদের এই রক্ষনশীল সমাজে স্বামী নামক মানুষটি স্ত্রীর বন্ধুদের কখনো ভালো চোখে দেখেনা। একদিন হোক, দুদিন হোক সে আমাদের এই সম্পর্কটাকে ভুল বোঝবেই।

................................................................................................... জানিনা, হয়তোবা আমি ভুল করছি................. ভালো থেক.... সারাজীবন.............''' এরপর থেকে আমার দিনগুলো কেমন যেন সাদামাটা হয়ে গেল। খাই, ঘুমাই, ছুটিতে বাসায় আসি, আবার খাই , আবার ঘুমাই , আবার বাসায় আসি..... মাঝে মাঝে অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম আসে না। তখন একগ্লাস পানি খেয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে জীবনানন্দের বই খুলে পড়ি........ ''জোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ.....''' তখন প্রচন্ড ইচ্ছে করি না মনে করার। কিন্তু সেইসব পূর্ণিমার রাতের কথা মনে পড়ে যায়।

সেই বারোটা এক মিনিট,ক্যাডেট কলেজ, অফ হোয়াইট কাগজে মুক্তোর মতো করে লেখা ঝকমকে চিঠি, চিঠির ভেতর চ্যাপ্টা ফুল,...সেই সতের বছর বয়স................... তখন সেই সতের বছরের এই আমাকে আমার খুব হিংসে করতে ইচ্ছে করে। .... ... ....... ...... .... ........ ..... .. . ... ... .... ... ... ভালো থেক রূপা। আর দুদিন পরেই কিন্তু পূর্ণিমা.... .... ..;;;;;; । । ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.