আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাষার ভালোবাসার ২১শে, আর জনমানুষের বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া

জাদুনগরের কড়চা
** ১০০ তম পোস্ট ** ১ বাংলা ভাষার জন্য বাঙালিদের টানটাই আলাদা। এ ভাষার উৎপত্তিই এসেছে জনমানুষের মুখের কথ্য ভাষা হতে। প্রাচীন কালের বিত্তশালী সভ্য সমাজে যখন সংস্কৃতের চল ছিলো, তখন বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে নবান্নের আনন্দে, কঠিন প্রকৃতির সাথে কঠোর সংগ্রামে, জীবনকাব্যে ব্যস্ত থাকা মানুষেরা নিজেদের প্রাণের থেকে মনের থেকে যে ভাষা আসে, তাতেই কথা বলেছে, রচনা করেছে জীবনের গান আর আলেখ্য। চর্যাপদের কবিদের কাব্যেও জনমানুষের এই জীবনটা ফুটে উঠেছে। "টালত মোর ঘর নাহি পরিবেশী হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী৷" - চর্যাপদের এই ভাষা কিন্তু আমাদের আদি অকৃত্রিম বাংলারই আদি রূপ, আমাদের বাঙালি জনমানুষের জীবনেরই কাহিনী।

বাংলার এই সবুজ ভূখন্ডকে শাসন করেছে যুগে যুগে অনেক দেশের অনেক শাসকেরা। সেন বংশ থেকে শুরু করে তুর্কি, মোগল, পাঠান আর ইংরেজ রাজপুরুষেরা এদেশ শাসন করেছে, তারা কিন্তু নিজেরা কথা বলেছে তুর্কি, আরবী, উর্দু - ফার্সি অথবা ইংরেজিতে, কিন্তু আম-জনতা সেই সব ভাষাকে উপেক্ষা করে কথা বলে চলেছে নিজেদের বাংলায়। এই চরম আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো ফাল্গুন মাসের সেই দিনটাতে, ২১শে ফেব্রুয়ারীর সেই রক্তাক্ত মিছিলে। আর এই ভাষার টান আছে বলেই একুশে বইমেলাতে লক্ষ মানুষের ভীড় নামে, পহেলা বৈশাখে মৌলবাদীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে ঢল নামে বাঙালিদের। --- ২ আধুনিক বিশ্ব তর তর করে এগিয়ে চলছে।

আর এগুনোর এই প্রবল প্রবাহের মূল নিয়ামক হলো তথ্য। জনমানুষের জন্মগত অধিকার তথ্যে, জ্ঞানে, আর এই অধিকারের বাস্তবায়ন ঘটাতে হলে আগামীর শিশুর হাতে পৌছে দিতে হবে দুনিয়ার সব তথ্য, মুক্ত ভাবে স্বাধীন ভাবে জ্ঞান অর্জনের আনন্দে পূর্ণ অধিকার পাবে আগামীর শিশুরা আমাদের ও অতীত প্রজন্মের অর্জিত সব জ্ঞানে। ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজ, প্রযুক্তি - এসবের সমন্বিত সংকলন হলো বিশ্বকোষ। দুঃখের কথা, বাংলাতে পূর্ণাঙ্গ বিশ্বকোষ বড়ই দূর্লভ। যা রয়েছে, অধিকাংশই হয় কেবল বাংলাদেশ কেন্দ্রিক, অথবা অচল হয়ে যাওয়ার দোষ দূষ্ট।

আক্রার এই বাজারে ছাপা বিশ্বকোষ কেনার সামর্থ কয় জনেরই বা আছে? যেখানে চালের দাম পেরিয়ে যায় ৫০টাকা কেজি, সেখানে হাজার কয়েক টাকায় কে কিনতে পারবে বিশ্বকোষ? তাহলে কি ইংরেজি শিখে ব্রিটানিকা আর এনকার্টা গিলতে হবে আমাদের? জ্ঞানের প্রকৃত অর্জন সম্ভব মাতৃভাষাতে, এটা নিয়ে মনীষীরা বহুভাবে বহু কথা বলে গেছেন, আমার কিছু যোগ করার অবকাশ নেই। বাংলাতে জ্ঞানকোষের এই অভাবটা কে মেটাবে? বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে, কাড়ি কাড়ি ডলারের বিদেশী "উপদেষ্টা" নিয়োগ করে, কয়েক কোটি টাকা খরচ করে লিখতে হবে? বিদেশী দাতাদের দয়ার অর্থে প্রজেক্ট চালাতে হবে? জবাবটা হলো, না! আমাদের নিজেদের কথা, নিজেদের ইতিহাস, লিখে যেতে হবে আমাদেরকেই। বিদেশ থেকে টাকার লোভ দেখিয়ে আনা বিশেষজ্ঞরা তাদের নিজেদের দৃষ্টিতেই আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাসকে দেখবে, আমাদের প্রাণের আবেগ আর জাতিসত্ত্বার অন্তর্নিহিত স্রোতকে তারা আদৌ বুঝতে পারবেনা, লেখা তো কোন ছার। আর জ্ঞান হলো জনমানুষের ... এই জ্ঞানকে করে দিতে হবে মুক্ত। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সেই আলোকিত মানুষের আন্দোলনের যেই লক্ষ্য, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের শিশুরা সেই আলোকিত মানুষ হয়ে তৈরী হবে নিজের ভাষাতে জানার আনন্দে দুনিয়ার কথা জেনে, বুঝে।

আর এই কাজটা করবো আমরাই। এটা করতেই হবে, আমাদের কোলের শিশুটি, আমাদের অনাগত প্রজন্মের কথা ভেবে। --- ৩ বাংলাতে জনমানুষের মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার কাজ জোরে সোরে চলছে দুই বছর ধরে। ২০০৬ সালের শুরুতে যখন এই প্রজেক্টে উৎসাহী অনেক তরুণ-তরুণী ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন ইন্টারনেটে বাংলা তথ্যভাণ্ডার একেবারেই ছিলো অনুপস্থিত। গত দুই বছরে আমাদের অর্জন, একটা মুক্ত তথ্যভাণ্ডারের অন্তত ভিত্তিটা গড়ে তোলা গেছে।

উইকিপিডিয়ার প্রক্রিয়াটা চলমান, এখানে আজকেই বা কালকেই চুড়ান্ত মানসম্পন্ন একটা বিশ্বকোষ হাজির হয়ে যাবে, তা হবে না, কিন্তু পরশু অন্তত কিছু না কিছু বিষয়ে কারো না কারো জ্ঞান লিপিবদ্ধ হবে। "দশে মিলি করি কাজ" - এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসটাই উইকিপিডিয়ার ভিত্তি। একজনের পক্ষে সব জানা সম্ভব না, কিন্তু দশ জনে যদি একটা একটা করে নিজের জানা তথ্য একত্র করে, তাহলে জ্ঞানের মহাসমূদ্রের একটি ঢেউ হলেও তৈরী হবে। বাংলা উইকিপিডিয়ার উৎসাহী কর্মীরা এই দুই বছরে যোগ করেছে ১৭,০০০ ভুক্তি। এই ভুক্তি গুলোর কিছু কিছু এখনো রয়েছে একেবারেই শুরুর পর্যায়ে, কিন্তু দরকারী অনেক বিষয়ের ভুক্তিগুলো ছোট্ট ছোট্ট তথ্যের সমারোহে হয়ে উঠছে পূর্ণ নিবন্ধে।

কর্মীদের উৎসাহের শেষ নেই, তাই ভাষার আনন্দের এই ফেব্রুয়ারী মাসকে সামনে রেখে বাংলা উইকিপিডিয়ার কর্মীরা ঘোষণা করেছে, ফেব্রুয়ারী হবে আমাদের "বাংলা উইকিপিডিয়া মাস"। পুরো মাস জুড়ে থাকবে বাংলা ভাষায় বিশ্বকোষ লেখার এই মহাপ্রয়াসের অগ্রযাত্রা , থাকবে ইংরেজি ও অন্য ভাষা হতে বাংলাতে জ্ঞান, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঐতিহ্য এগুলোর তথ্যকে নিয়ে আসা। আরো চলবে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি এগুলোর কথা লেখা, বাংলাদেশের প্রকৃতি, জনমানুষ, সবকিছুর ছবি তুলে ধরা। আসুন, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রেখে যাই মুক্ত জ্ঞান, সেই জ্ঞানে উদ্ভাসিত হোক আগামীর শিশুর পবিত্র মুখখানি। --- শেষ করছি ছোট্ট দুটি ঘোষণা দিয়ে।

বাংলা ভাষা আন্দোলনের উপরে ইংরেজি উইকিপিডিয়ার নিবন্ধটি "সেরা নিবন্ধ" বা featured article এর তালিকায় উঠেছিলো গত বছরের জুলাই মাসে, অনুজপ্রতীম তারিফ এজাজের উৎসাহী প্রয়াসে। এই নিবন্ধটিকে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি পঠিত ওয়েবসাইটের অন্যতম ইংরেজি উইকিপিডিয়ার প্রথম পাতায় পুরো একদিন ধরে আনার জন্য মনোনয়ন দিয়েছি, আর এটা আসবে ২১শে ফেব্রুয়ারীতেই। আশা করি, আমাদের এই মনোনয়ন সফল হবে, ২১শে ফেব্রুয়ারী সারা দিন ধরে দুনিয়ার সব মানুষেরা জানবে ভাষার জন্য বাঙালিদের সেই আবেগ, সেই উচ্ছ্বাসের কথা। আর অন্য ঘোষণাটা হলো, ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে আয়োজন করা হয়েছে বছর ব্যাপী একটি প্রতিযোগিতা, দেশিপিডিয়ান ২০০৮ । যে কেউ অংশ নিতে পারবেন এই প্রতিযোগিতায়, বাংলাদেশের উপরে নিবন্ধের মানোন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারবেন।

সেরা অবদানকারীকে দেয়া হবে ৫০০০ টাকার পুরষ্কার। বিস্তারিত জানবেন দেশিপিডিয়ান ২০০৮ প্রতিযোগিতার মূল পাতায়। -- হঠাৎ খেয়াল হলো, এটা আমার ১০০তম পোস্ট। দেড় বছরে ১০০টা লেখা লিখে ফেলেছি কখন, টেরই পাইনি।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.