যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
৪.
শরীফ সাহেবের বাসায় লোকমান এসেছে আজ চার বছর হতে চলল। বাসার চা বানানোর দ্বায়িত্ব শুধু তার। শুধু চা বানানোর জন্য একজন লোক রাখে মানুষ, এধারনা লোকমানের ছিলনা। তবে তার নিজের বানানো চা যে খেতে অসাধারণ এটা সে জানত অনেকদিন থেকেই। বাবার কাছে একেবারে হাতেকলমে চা বানানো শিখেছে সে, ছোট বেলা থেকেই।
বছর তিনেক আগে ইতুর বাবা শরীফ সাহেব যখন সিলেটে গিয়েছিলেন ব্যাবসার কাজে, তখন একবার গাড়ী পাংচার হয়ে যাওয়ায় রাস্তার পাশে লোকমানের বাবার চা স্টলে বসেছিলেন। লোকমান তখন একাই দোকান চালাচ্ছিল, নয় দশ বছর বয়েস হবে তার। লোকমানের হাতের চা খেয়ে শরীফ সাহেব মুগ্ধ হয়ে গেলেন; তিনি চায়ের ভাল সমঝদার, তাঁর মনে হলো যে এমন ভালো চা আগে কখনও খাননি। দুমাস পরেও তাঁর সে মুগ্ধতা কাটেনি, এক ছুটির দিন সকালে সিলেট চলে গেলেন, সরাসরি লোকমানদের চায়ের স্টলে। লোকমানকে নিয়ে আসলেন, লোকমানের বাবাকে কথা দিলেন যে ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেন।
লোকমান এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে।
সকালে লোকমানও জেনে গেছে যে এই পরিবারে একটা বিরাট ঝামেলা দেখা দিয়েছে আজ। তবুও সে এতটুকু বোঝে যে এতে তার কিছুই করার নেই, অন্যান্য দিনের মতো আজও শরীফ সাহেব ডিনার শেষে যখন ডাইনিং টেবিলে বসেই পেপার পড়ছেন, তখন লোকমান চা নিয়ে আসে। শরীফ সাহেবকে চা দিয়ে যখন সে নিজের রুমে ফিরে যাবে, ঠিক তখনই সে দেখতে পায় বাড়ীর করিডোরে ছোট মেয়ে নীতু মুখ চেপে দোউড়াতে দৌড়াতে বড়বোনের রূমের দিকে যাচ্ছে। ঘড়িতে তখন ঠিক এগারোটা।
করিডোরের অন্যপাশ থেকে বাড়ীর একমাত্র ছেলে তুষারও এসে ঢোকে বড়বোনের রূমে। লোকমানের কৌতুহল হয়, সে এগিয়ে যায় সামনের দিকে, ইতুর রূমে উঁকি দিতে।
করিডোরের যে পাশে ইতুর রূমের দরজা তার ঠিক উল্টো দিকে ডাইনিংয়ের বারন্দার দরজা। লোকমান সেই দরজা দিয়ে বারান্দায় ঢুকে যায়, যেখান থেকে দরজা খোলা থাকলে ইতুর ঘর দেখা যায়। লোকমান দেখতে পায়, নীতু ইতুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আর তুষার একটু দূরে খানিকটা বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে।
মিনিটখানেক এভাবেই কেটে যায়। তারপর, ইতু নীতুর মুখ মুছে দিয়ে নিজের ড্রয়ার থেকে একটা প্যাকেট বের করে, প্যাকেটের ভেতর লালচে ধরনের কি যেন দেখা যাচ্ছে, লোকমান বুঝতে পারে ওগুলো ক্যাপস্যুল। আর তুষারের দিকে বাড়িয়ে দেয় এক প্যাকেট সিগারেট আর একটা লাইটার। তারপর কি মনে করে তুষারের হাত থেকে প্যাকেটটা ফিরিয়ে নিয়ে প্যাকেট খুলে কয়েকটা সিগারেট নিজের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখে।
লোকমান স্পস্ট দেখতে পায় যে নীতু আর তুষার হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে; তারা বুঝতে পারছেনা ঠিক কিজন্য তাদের বড়বোন এসব দিচ্ছে।
কিন্তু ইতুর মুখ হাসিহাসি, সে গল্প করার জন্য ভাইবোনকে নিজের বিছানায় বসায়। তারপর ইতু হাসিমুখে যখন গল্প শুরু করবে বলেই লোকমানের মনে হলো। ঠিক তখনই লোকামন দেখতে পেল যে ইতুর চোখ ঠিক তার ওপর, ইতু তাকে দেখে ফেলেছে। লোকমানের হৃদকম্প শুরু হয়ে যায়, অথচ ইতু এসে কিছুই নাকরে শুধু ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। অন্যকোনদিন হলে ইতু লোকমানের বারোটা বাজিয়ে ফেলত, শুধু আজ অন্যরকম একটা দিন দেখেই লোকমান বেঁচে যায়।
নীতু আর তুষার যখন হাসিমুখে বড়বোনের ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন লোকমান ডাইনিং থেকে তাদের দেখতে পাচ্ছে। শরীফ সাহেব চা শেষ করে চলে গেলে সে ডাইনিংয়ের বাতি নিভিয়ে এক কোনায় ওঁৎ পেতে থাকে নীতু আর তুষারকে দেখার জন্য। দুই ভাইবোন কোন কথা বলেনা, কিন্তু করিডোরের হাল্কা আলোতেই লোকমান বুঝতে পারে যে ভাইবোনের দুজনই খুব খুশী। বাবা-মা'র ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে, আর তিন ভাইবোন গল্পসল্প করে খুব আনন্দিত -- লোকমান হিসেব মেলাতে পারেনা। সে ভাবে, বড়লোকের ব্যাপার স্যাপার হবে হয়ত।
বড়লোকের তিন সন্তানকে নিয়ে লোকমান যখন ভাবছিল, ঠিক তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে ডাইনিংয়ের বাতি জ্বলে ওঠে; লোকমান দেখতে পায় বারান্দার দরজার সামনে ইতুর রুদ্রমূর্তি। ইতু শীতল গলায় বলে,
"লোকমান, তোর স্বভাব কবে এত খারাপ হলোরে?"
লোকমান মাথা নীচু করে থাকে। মনে মনে সে তার ভবিষ্যত প্রস্তুতি নেয়, সিলেটে ফিরে গেলে কিভাবে বাবার চায়ের দোকান আর পড়াশোনা একসাথে চালাবে। কারণ, সে মোটামুটি নিশ্চিত যে আজ সে যা করেছে, তারপর আর এবাসায় তার থাকা হবেনা। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ইতু খুব স্বস্তিদায়ক কন্ঠেই বলে,
"শোন লোকমান, তোকে বলি।
আর কখনও যেন এমন না হয়, বুঝলি?"
ধড়ে প্রাণ ফিরে পায় লোকমান। হাল্কাভাবে মাথা নাড়িয়ে ইতুর কথায় সায় দেয় সে। ইতু যখন চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়, তখনই লোকমান প্রাণপণে বলে উঠে, "আপামনি, খালুকে কিছু বলিয়েননা। "
ইতুর মুখে বিজয়ীর হাসি, সে আস্তে করে বলে, "ঠিক আছে। কিন্তু আমার কথাগুলো মনে রাখবি"
অথচ ইতু ঠিকই জানে, লোকমান এখন থেকে তাদের তিনজনের ওপরই চোখ রাখবে।
৫.
ইতুদের বাসায় আজ আত্নীয়স্বজনদের ভীড় লেগেছে। মার পক্ষ থেকে এসেছেন নানী, বড়মামা, মামী আর বিচ্ছু বাচ্চা দুটো। বাবার পক্ষ থেকে বড় ফুপু আর ছোট ফুপু এসেছেন বাচ্চাকাচ্চা সহ। একইসাথে বাবার সার্বক্ষণিক সঙ্গী উকিল চাচাও এসেছেন। অনেকদিন পর আজ মার চড়া গলা শোনা যাচ্ছে, বাবাও মাঝে মাঝে গরম হয়ে উঠছেন।
ইতু বারান্দায় হাঁটাহাঁতির ছলে কয়েকবার ড্রয়িংরূমে উঁকি দিয়েছে, তার রীতিমতো হাসি পাচ্ছে বড়ফুপু আর ছোটফুপুকে দেখে। দুজনই ভীষন মারমুখী হয়ে আচেন, পারলে ইতুর মাকে এখনই আস্ত পুঁতে ফেলেন। বড় ফুপু কিছুক্ষণ পরপরই "আমার ভাইয়ের সোনার সংসারটা!!" বলে এক টান দেন, আর হেঁচকি খাওয়ার মত ভয়ানক একটা শব্দ করেন। যতবারই তিনি এটা করছেন, ততবারই উকিল চাচা কথা বলা বা পড়তে থাকা কাগজপত্র থেকে চোখ উঠিয়ে চশমার উপর দিয়ে অবাক হয়ে ফুপুকে দেখছেন। ইতুর ভীষন মজা লাগছে, তার মনে হচ্ছে আজ যদি বড়খালা আসত, তাহলে একেবারে সোনায় সোহাগা হয়ে যেত।
আজকের বৈঠকটা মূলতঃ ইতুদের ভাইবোনদের কাস্টডি নিয়ে। অনেক কিছুই মিটমাট হয়ে গেছে; মা সম্ভবতঃ তাঁর কোন এক বন্ধুর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় ডিপ্লোমা করার জন্য কাগজপত্র আগেই ঠিক করে ফেলেছেন, আজ ইতুর বাবা মা'র পড়াশোনার যাবতীয় খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি খুব সহজেই দিয়ে দিয়েছেন। ইতুর ধারনা ছিল তার বাবার মতো কিপ্টে লোক কোনদিনই এব্যাপারটাতে রাজী হবেননা, কিন্তু বাবা শুধু এতেই রাজী হননি, এমনকি মাকে আগামী পাঁচ বছর বা মা ডাক্তারী পেশায় পুরোপুরি ফিরে আসার আগ পর্যন্ত মাসে দু'লাখ টাকা করে ভরন-পোষন দেয়ার ব্যাপারেও সহজেই একমত হয়েছেন। সমস্যা বাঁধল তখনই, যখন মা বললেন তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি থাকতে চান। শরীফ সাহেব কিছুতেই ছেলেমেয়েদের ছাড়বেননা।
শরীফ সাহেবের যুক্তি হলো আসমা বিদেশে চলে যাবে, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার মাঝখানে আছে, এখন তারা কিভাবে আসমার সাথে বিদেশে যাবে। আসমার কথা হলো, তিনি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে সহজেই ডাক্তারের লাইসেন্স পেয়ে যাবেন, পড়াশোনার ব্যাপারে তার আত্মবিশ্বাস সবসময়েই খুব বেশী। কাজেই ইতুর গ্র্যাজুয়েট স্টাডি, তুষারের শুরু থেকেই এবং নীতুরও ক্রেডিট ট্রান্সফার করে সহজেই তিন ছেলেমেয়েকে তিনি বিদেশে দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারবেন। তিনজনের নামে ব্যাংকে যে টাকা জমা আছে, তা দিয়ে ওরা পড়াশোনা শেষ করে খুব আরামেই ক্যারিয়ারের দিকে এগুতে পারবে। কিন্তু শরীফ সাহেব একেবারেই নাছোড়বান্দা, তাঁর কথা হলো মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে কোনভাবেই বিদেশে যেতে দেবেননা, ছেলেকেও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগে না।
তাঁর বন্ধুদের যতজনেরই ছেলেরা কলেজ শেষ করে বিদেশে পড়তে গেছে, সবাই বখে গেছে।
কাস্টডী নিয়ে ঝগড়া চলল দুপুর পর্যন্ত। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে উকিল চাচা রাজী করালেন যে নীতু থাকবে বাবার সাথে, আর তুষার মায়ের সাথে। কিন্তু এখনও যে ঝামেলাটা ঝুলে থাকল, সেটা হলো ইতউ কার সাথে থাকবে। ইতুর পড়াশোনা প্রায়ই শেষ, মা সাথে নিয়ে যেতে চান।
আর অন্যদিকে বাবা কিছুতেই মেয়েকে বিয়ে দেবার আগে যেতে দেবেননা, তাঁর কথা হলো সারাজীবন ইসলামের আদর্শে মেয়েকে বড় করেছেন, আজ তিনি সেটার বরখেলাফ হতে দিতে পারেননা। ইতুর মা বলছেন, মেয়ের বিদেশে পড়তে যাবার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। শরীফ সাহেব (ইতুর বাবা) বলছেন, খুব ভালোভাবেই আছে, সেটা সবাইই বোঝে, শুধু আসমা (ইতুর মা) বুঝেও বুঝতে চাচ্ছেননা। ইতুর প্রসঙ্গে এসে আলোচনা আর কিছুতেই থামছেনা, ঝগড়াও থামছেনা।
সমস্যা গুরুতর দেখে ইতু নিজেই রূমে এসে ঢুকল।
খুব শীতল গলায় বলল, "আব্বু, আম্মু, তোমরা অযথাই ঝগড়া করছ। "
"ইতু! তুই ভেতরে যা!" শরীফ সাহেব গর্জে উঠলেন।
"না! ইতু, বল কি বলতে চাস। " মা স্বভাবতই বাবার বিপরীতটা বলবে, ইতু জানে।
ইতু যথাসম্ভব সহজ থাকার চেষ্টা করে বলল, "মা, আমি একা থাকব।
ধানমন্ডিতে এখন স্টুডিও-ফ্লয়াট পাওয়া যায়, মৌ আর দীবা থাকে, আমিও ওরকম একটা কিনে নেব। "
"ইতু, সাবধানে কথা বল! তু কি বলছিস তুই নিজে বুঝছিস!" মা শাসালেন।
ইতু শীতল কন্ঠেই বলল, "মা আমি এখন এডাল্ট। আমার প্রাইভেসী দরকার; আমার বন্ধু-বান্ধবীরা যখন তখন বাসায় আসতে পারেনা, আমিও নিজের স্বাধীনতামতো সময় কাটাতে পারিনা। আমি অলরেডী ফ্ল্যাট ঠিক করে ফেলেছি।
"
"বন্ধু-বান্ধব মানে?" বাবা-মা একসাথে গর্জে ওঠেন।
ইতু বলতে থাকে, "বাবা, আমি এখন বড়, আমার প্রাইভেসী দরকার। আমার বন্ধু না বান্ধবী কে আসল বাসায় সেটা নিয়ে তোমাদের আর না ভবালেও হবে। "
সারাঘরে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে ওঠে, আসমা তটস্থ হয়ে ফোন ধরেন।
ওপাশ থেকে মিন্টুর গলা শোনা যায়, "স্লামালাইকুম আন্টি, ইতুকে দেয়া যাবে। আমি মিন্টু। "
আসমা ক্রূর চোখে মেয়ের দিকে তাকান, অন্য যেকোন সময় হলে ইতুকে তিনি কাঁচা গিলে ফেলতেন।
(চলবে ...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।