আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টেলিফিল্ম স্পার্টাকাস ৭১ এবং নতুন বছরের সূর্যের কাছে একটি রক্তিম অঙ্গীকার

munirshamim@gmail.com

এক. বিনীত অভিনন্দন টেলিফিল্ম স্পার্টাকাস ৭১ এর পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর জন্য। অভিনন্দন এ ছবির মূল গল্পের লেখক আনিসুল হককেও। অনুভবনের সমস্ত গভীরতা দিয়ে অসমান্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি চ্যানেল আইয়ের প্রতিও। এ ছবির সকল কলাকূশলী এবং সংশ্লিষ্ট সকলকেও জানাচ্ছি অভিনন্দন। বাংলাদেশের সকল বিবেকবান, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, শান্তি ও প্রগতির পক্ষের মানুষ যখন আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সমবেত কন্ঠে সোচ্চার হয়েছে, একই বিষয়ে একটি রাজনৈতিক ঐক্য তৈরির সম্ভাবনা ক্রমশ দৃশ্যমান ও অনিবার্য হয়ে উঠেছে, ঠিক সে সময় এ ছবিটি প্রচারিত হলো চ্যানেল আইতে।

ঈদের অনুষ্ঠান হিসেবে। বাঙালী জাতির নিরবিচ্ছিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি মধ্যবিত্ত শহুরে পরিবারের প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রা, দেশপ্রেম, মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, রাজাকার-আলবদরদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে পাকিস্তানি হানাদার বেষ্টিত ৭১ এর ভয়াল দিনগুলোতে নিজ সন্তানের জন্য বাবা-মার অথৈ সমুদ্র সম আকুতি, তারুন্য ও যৌবনের বর্ণীল সম্ভাবনার সবটুকু ঢেলে দিয়ে মধ্যবিত্ত তরুনদের দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য জীবনবাজি দেয়া, হায়নার চেয়েও ভয়ংকর, পৃথিবীর জঘন্যতম নিকৃষ্ট কীট রাজাকার-আলবদরদের নিপীড়ন, নির্যাতন আর নৃশংসতা, ইত্যাদি বিষয়গুলো উপজীব্য হয়ে উঠেছে টেলিফিল্মটিতে। ছবিটি শৈল্পিক মানে কতটা সফল তার বিচার-বিশ্লেষণের দায়ভার চলচ্চিত্র-বোদ্ধাদের। তাঁরা হয়তো সে কাজটি করবেন। তবে একজন দর্শক হিসেবে আমি এটুকু বলতে পারি, ছবিটি আমি একাগ্র হয়ে দেখেছি।

একাগ্র হয়ে দেখতে বাধ্য হয়েছি। ছবিটি দেখতে দেখতে আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে চোখের জল। একবার দু'বার নয়, অসংখ্যবার। ছবিটির কাহিনী যতই এগিয়েছে ততই আমার মধ্যে হিংসা ও ক্রোধের আগুন নব উদ্যমে ঢালপালা গজিয়েছে। অনবরতভাবে।

পাকিস্তানি হানদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় এজেন্ট রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে। একটি ছবি দেখতে দেখতে অনুভূতির এ ক্রমাগত পরিবর্তন, হৃদয়ের গভীরতাকে এ যে স্পর্শ করার শক্তি, মানুষের সুপ্ত অনুভূতিগুলোকে এ যে জাগিয়ে তুলতে পারার ক্ষমতা, দর্শক হিসেবে এটাই আমার কাছে এ ছবির স্বার্থকতা। আমি আবারও এ ছবির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। একই সাথে এ ছবিটি বিভিন্ন চ্যানেলে, গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে পুন:পুন প্রদর্শনের জন্য অনুরোধ করছি। দুই. ওরা দু'জন সহোচর।

চেহার হুবুহু এক। প্রকাশভঙ্গিও অবিকল এক। দুই সহোদরের বড়জন চলে যায় যুদ্ধে। একাত্তুরের যুদ্ধে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে।

আর ছোটজন থেকে যায় বাড়িতে। তবে শেষ পর্যন্ত তার বাড়িতে থাকা হয় না। বড় ভাইয়ের যুদ্ধে যাবার সংবাদ ফাঁস হয়ে যাবার পরিপ্রেক্ষিতে হানাদাররা তাকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে রেখে তার ওপর চলতে থাকে অবিরাম অত্যাচার। 'ধর্ম' রক্ষার নামে গড়ে তোলা রাজাকার, আলবদর, আর শান্তি কমিটির কমান্ডারের হাতে এ দুই সহোদরের পরহেজগার নামাজী বাবাও রেহায় পান না।

রেহায় পায় না মুক্তিযোদ্ধা বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ে পাকাপাকি হয়ে যাওয়া মেয়েটিও। শোক, অপমান, ঘৃণা, আর অনুশোচনায় ওদের বাবাও একদিন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। ছবির একবারে শেষ দৃশ্যে দেখা যায়-রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার দুই সহোদরের বাড়িতে এসে ওদের দু'জনকে এক সাথে পেয়ে যায় বাড়িতে। কিন্ত হুবুহু চেহারা এক এবং তাদের অবিকল প্রকাশভঙ্গির কারণে দু সহোদরের মধ্যে কে প্রকৃত পক্ষে প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা, যাকে তারা এতদিন ধরে খুজছিল, তা চিনতে পারে না পিশাচ রাজাকার কমান্ডার। হায়নার পুনপুন জিজ্ঞাসার জবাবে দুই সহোদরই নির্ভীকভাবে ক্রমাগত দাবি করে-আমি বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধা।

শেষপর্যন্ত রাজাকার কমান্ডার ওদের দু'ভাইকে নিয়ে যায়। অজানা গ ন্তব্যে। রাজাকার তাদের দু'জনকে খুন করে। দেশ মাতৃকার জন্য জীবন দেয়, শহীদ হয় ওরা দু'ভাই। ছবিটি শেষ হয় নেপথ্যে কন্ঠে ভেসে আসা সংলাপের মধ্য দিয়ে।

সংলাপে বলা হয়-দাসযুগের স্পার্টাকাসের মতো এভাবে চিরতরে হারিয়ে যায় ৭১ এর স্পার্টাকাস। ওরা আর ফিরে আসে না। কিন্তু রয়ে যায় ৭১ এর ঘাতক বাহিনী। এ স্বাধীন দেশে আজও সেসব ঘাতকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়.......(সংলাপগুলো হুবুহু বর্ণনা করতে না পারার দায়ভার কাঁধে নিয়ে সবার কাছে দু:খ প্রকাশ করছি)। তিন. স্পার্টাকাস ৭১ ছবির শেষ সংলাপটির নির্ভেজাল সত্যতই স্বাধীনতার ৩৬ বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির প্রাসঙ্গিকতাকে সময়ের সবচেয়ে অনিবার্য কর্তব্যে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশের গত ৩৬ বছরের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে নিরবিচ্ছিন্ন এবং ক্রমবর্ধমান হারে ঘটে যাওয়া ঘটনা-দুর্ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে যে, ঘাতকের পায়ের আওয়াজ এখনও পাওয়া যায়। খুব বেশি করে পাওয়া যায়। না, শুধু পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় না। বরং ৭১ এর পরাজিত শক্তি সেসব পিশাচ ও হায়নাগুলোর হিংস্র থাবা এখন বড় বেশি দৃশ্যমান। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত।

এখানে, ওখানে এবং সবখানে। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের অপতৎপরতা আরও বেড়ছে। খুব বেশিই বেড়েছে। অতি সম্প্রতি 'দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই, মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি গৃহযুদ্ধ' এ সব মন্তব্যের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ক্রমাগত সমস্ত অশুভ প্রয়াসের প্রক্রিয়াগুলোকে দিবালোকের মতো স্পষ্ট করেছে সমগ্র জাতির সামনে। প্রমাণ করেছে, প্রয়াত লেখক শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদের 'একজন রাজাকার আজীবন রাজাকার' উক্তিটি শুধু সত্য নয়।

চিরায়ত সত্য। কিন্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বাস ও আচরণে আজীবন মুক্তিযোদ্ধা কিনা- বিষয়ে একই উক্তিতে তিনি যে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন সে সংশয় এখন আমরা দূর করতে পারিনি। তবে এ সংশয় দূর করার একটি বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে, এক কাতারে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন আজাদের সে সংশয় দূর করার নৈতিক দায়িত্ব এখন আমাদের সকলের......। চার. আবারও পেছনে ফেরা যাক।

৭১ এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তিকে জনবিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সমূলে উৎপাটন করতে পারিনি। এ না পারার ব্যর্থতার কারণেই দৃশ্যের আড়ালে থেকে পরাজিত কুকুর-বিড়াল-ইঁদুরের জীবন-যাপনকারী যুদ্ধাপরাধীরা ইতোমধ্যে আমাদের জনজীবনে পুনর্বাসিত হয়েছে। তাদের এ ভাবে পুনর্বাসিত হতে দেয়ার এ দায় বিগত দিনের সব সরকারের। সকল রাজনৈতিক দলের।

এ দায় আ'লীগের, অবশ্যই বিএনপির, এমনকি বামদলগুলোরও। এ ব্যর্থতা রাষ্ট্র যন্ত্রের। নাগরিক সংগঠন, এনজিও, পেশাজীবী সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের এবং আমাদের সকলের। ব্যর্থতা আমাদের ব্যবসায়ী এবং ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দেরও। যে মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বাধীন ব্যবসায়ী হিসেবে বিকশিত হওয়ার দিগন্তটি উন্মোচিত করেছিল, পরবর্তীতে সে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ, একটি বড় অংশ, মুনাফার প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষের আদর্শিক ব্যবধানটুকু ভুলে গিয়েছে।

আর সে ভুলে যাওয়া ভুলে ক্রমাগত মুনাফা তৈরি করে নিজস্ব বিকশমান একটি শক্তি পরিমন্ডল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে মৌলবাদের অর্থনীতি। স্বিকার করছি, স্বাধীনতা বিরুধীদের বিচারের কাঠকড়ায় দাঁড় করাতে না পারার ব্যর্থতার দায়-দায়িত্বের মাত্রাগত ব্যবধানটি সকল পক্ষের জন্য সমান নয়, কারও কারও জন্য অনেক অনেক বেশি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজকে আসীন করে টিকে থাকবার একমাত্র বাসনায় পরিচালিত আমাদের রাজনীতিতে কোন কোন দলযে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়ে, কোমর বেঁধে যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করেছে, আদর-আপ্যায়নে আপনজন করে নিয়েছে, আমাদের দূবৃত্তায়িত সুবিধাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির এ কালো অধ্যায়টি নতুন করে মনে না করিয়ে দিলেও খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার কারণে এটি সাধারণ জনগণের মনে থাকবে। মনে থাকাটাই স্বাভাবিক এবং জরুরি। পাঁচ. আমরা আবারও একটি নতুন বছর শুরু করছি।

আজ রাতের নিকষ অন্ধকার ভেদ করে আগামী কালের নতুন ভোরে ২০০৮ সাল পথ চলা শুরু করবে। আমাদেরও পথ চলা শুরু হবে নতুন সময়ের সাথে। তবে কতটা নতুনভাবে? বিগত ৩৬ বছরে আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে। আছে হতাশা ও ক্ষোভ। আছে না পাওয়ার বেদনা।

অন্যের ঘাড়ে ব্যর্থতার দায় চাপাবার কাড়িকাড়ি নিদর্শনও আছে। আছে দায় না নেবার ভূরিভূরি উদাহরণ। কিন্তু আর কতকাল এ ভাবে বেঁচে থাকা! আর কতকাল এ ভাবে পথ চলা। আসুন ২০০৮ সালকে আমরা পরিণত করি বাঙালী ইতিহাসের আরেকটি গৌরবময় অধ্যায়। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াস দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার লড়াইটাকে আরও বেগবান করি।

ওদের ঘৃণ্য পায়ের আওয়াজগুলো আর যেন শুনতে না হয় সে সংগ্রামের অঙ্গিকার হোক এ নতুন বছরের শুরুতে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে সে ঐক্যের সিঁড়ি বেয়ে আসুন আমরা আমাদের সব ব্যর্থতার দাগ মুছে ফেলি। পৃথিবীকে জানান দেই- দেখ আমরাই পারি.........আমরা পেরেছিলাম ৭১ এ, আবারও পেরেছি ২০০৮ সালে। সবাইকে ইংরেজি নববর্ষ ২০০৮ সালের শুভেচ্ছা...।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.