আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অলৌকিকভাবে বেঁচে থাকা

বিক্ষিপ্ত জীবন. . . কখনো হাসায় . . . কখনো কাদাঁয় . . . আবার কখনো নির্ভেজাল অন্ধকার ঘিরে ফেলে চারদিক থেকে . . .

শিশুটির নাম ওবায়দুল। বর্তমানে আছে নানাবাড়িতে। গলাচিপার গোলখালী ইউনিয়নের গাবুয়া গ্রামের কাজেম আলী ডাক্তারের বাড়ির পাশেই তার নিবাস। ছয়-সাত বছর বয়সের শিশুটি কাদামাখা পায়ে আমার সামনে দাঁড়াল। তার চোখে কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা বিষণœতা।

একটা হাফপ্যান্ট আর সোয়েটার পরা ওবায়দুল মুখ ফুটে কোনো কথাই বলছিল না। অগত্যা প্রশ্ন করলাম তার ভাইকে। তার বড় ভাইয়ের নাম জাহিদুল। ১২ বছর বয়সী এই বালক ঝড়ের রাতে একটি গাছে উঠে বেঁচে গিয়েছিল। সে জানাল, ম্যালা দিন (কয়েক বছর) আগে মোরা (আমরা) ঢাকার মুন্সীগঞ্জ এলাকায় ছিলাম।

কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবা মোর (আমার) মাকে ছেড়ে অন্য এক মাতারিকে (মহিলাকে) বিয়ে করে। হ্যারপর (এরপর) মোগো (আমাদের) খেদাইয়া (তাড়িয়ে) দেয়। মায়ে মোগো (আমাদেরকে) লইয়্যা (নিয়ে) আইয়্যা পরে এই গ্রামে। ছোট্ট এউক্যা (একটা) খুপরিঘর করে আলহাম (বসবাস করতাম) মোরা (আমরা)। কিন্তু মায়ের পক্ষে আমাদের তিন ভাই-বোনকে নিয়ে জীবন চালানো কঠিন ছিল।

ফলে আমরা বছরের নির্দিষ্ট সময় কলাগাছিয়া চরে চইল্যা যাইতাম। সেখানে কী করতে? জবাবে জাহিদুল জানায়, ওইহানে (সেখানে) জাইল্যারা (জেলেরা) সাগর থেকে মাছ ধইর‌্যা নিয়া আইত। মা, আমি, ওবায়দুল মিলে মাছের কল্লা (মাথা) আলাদা করতাম এবং ওজন দিয়ে প্যাকেট করার কাজ করতাম। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রচুর মাছ আসত সাগর থেকে। তখন আমাদের কাজও থাকত অনেক।

বাকি সময় সাগরের পাড়ে ছোট ছোট জাল নিয়ে মাছ ও পোনা ধরতাম। ঘূর্ণিঝড়ের রাতে কী করেছিলে? ১৫ নভেম্বর বিকেল থেকেই ঝড়ের আলামত পাওয়া যাচ্ছিল। সন্ধ্যার দিকে পানি বেড়ে চরের অনেক অংশ ডুবে যাওয়া শুরু করে। পানি উত্তাল হয়ে যাওয়ায় চর থেকে মাছের ট্রলারে ওঠা যাচ্ছিল না। ফলে আইটক্যা (বন্দি) যাই আমরা।

কিছুক্ষণ ভেবে জাহিদুল জানায়, আমরাসহ আরো অনেকে সাগরের একেবারে পাড়ে ছোট ছোট ঝুপড়ি বানিয়ে ছিলাম। সন্ধ্যার দিকে পানি বাড়তে দেখে চরের মাঝামাঝি একটি জায়গায় মোটামুটি বড় ঘরে আশ্রয় নিই। কিন্তু পানি বাড়তে বাড়তে এক সময় সেই ঘরের মধ্যেও দুই-তিন ফুট পানি উঠে যায়। তখন আল্লাহর নাম নেওয়া ছাড়া অইন্য কোনো পথ আছিল না। এরপর? জাহিদুল জানায়, রাতে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়।

আনুমানিক ১০ বা ১১টার দিকে বিশাল এক ঢেউ এসে আমাদের ভাসিয়ে নেয়। পানির স্রোতে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাই আমরা। আমি আমার ছোট বোন রুবিনাকে (৬) এক হাতে ধরে সাঁতরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু স্রোতের চোটে রুবিনা আমার হাত থেকে ছুটে যায়। তুমি বাঁচলে কী করে? ততক্ষণে জাহিদুলের চোখে জল এসে গেছে।

জানাল, আমাদের চরের একপাশে ছোট একটা বন ছিল। ভাগ্যক্রমে স্রোতের টানে আমাকে সেদিকেই নিয়ে গিয়েছিল। এক সময় আমি হাতের নাগালে কিছু গোলপাতা গাছ পাই। এরপর সেগুলো ধরে ধরে একটি বড় গাছের ওপর উঠে পড়ি। আমার মতো আরো কয়েকজন সারারাত গাছে কাটিয়ে বেঁচে যায়।

মা, ভাই, বোনের খবর নাওনি? জাহিদুল জানায়, পরদিন পানি কমে গেলে চরের আশপাশে তাদের খুঁজতে থাকি। অনেক লাশ ছিল সেখানে। কিন্তু মা, ভাই, বোনকে খুঁজে পাইনি। ওইদিন দুপুরের পরে জানতে পারি চর মোনতাজ নামক একটি চরে আমাদের চরের অনেক লোক ভাইস্যা গেছে। তাদের মধ্যে শুধু একটি পোলা বাঁইচ্যা আছে।

এর মধ্যে এই গ্রাম থেকে আমাদের আত্মীয়স্বজন সেখানে যায়। আমি চলে আসি এই গ্রামে। আর অন্য আত্মীয়স্বজন চরমোনতাজে গিয়ে ভাই আর মাকে খুুঁজে পায়। চর মোনতাজ পর্যন্ত ভেসে যাওয়া শিশুটি ওবায়দুল। ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার ভেসে গিয়ে বেঁচেছিল সে।

কিন্তু কীভাবে? জানতে চাই ওবায়দুলের কাছে। কিন্তু কিছুতেই বলতে চায় না সে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিই ওবায়দুলকে নিয়ে যাব কলাগাছিয়া চরে। ঝড়ের রাতে সেখানে ছিল সে। নদীপথে গলাচিপা থেকে কলাগাছিয়া চরের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার।

স্পিডবোটে ওবায়দুল আর তার ভাইকে নিয়ে সেখানে যেতে সময় লেগেছিল দুই ঘণ্টার মতো। আমাদের যেতে হয়েছে আগুনমুখা নামক একটি হিংস্র নদীর বুক চিরে। কলাগাছিয়া চরের একপাশে সমুদ্র আর তিনপাশে বড় নদী। চরের কাছাকাছি যেতেই চেঁচিয়ে ওঠে জাহিদুল, ‘ওই যে, ওই গাছে চড়ে বেঁচে ছিলাম আমি। ’ ছোট্ট বনের দিকে আঙুল তুলে কোনো একটা গাছ দেখানোর চেষ্টা করছিল জাহিদুল।

আমিও বোঝার চেষ্টা করেছি ঠিক কোন গাছটাকে চেনাচ্ছে সে। সমুদ্র আর নদীর মিলনস্থলে ছোট্ট একটি বন বাঁচিয়েছে অনেককে। সান্ত্বনা এতটুকুই। ওবায়দুলকে নিয়ে চরের মাঝে ঘুরছিলাম আমি। যদি ঝড়ের রাতের ঘটনা জানায় সে।

একসময় ওবায়দুল বলে উঠল, ‘ওইখানে আমাগো ঘর আছিল। ’ সমুদ্রের একেবারে কিনারে ফাঁকা জায়গায় ইঙ্গিত করছিল সে। আমি বললাম, ওই জায়গা একেবারে সাগরের কাছে। কেমনে থাকতা? ওবায়দুল জানাল, ‘নীল রঙের পলিথিনের ঘরে থাকতাম। ঝড়ের কালে মায়ে (মা) আমাগো নিয়া চরের মইধ্যে ওই ঘরে গেছিল।

’ কাছেই আরেকটি খালি জায়গা ইঙ্গিত করল সে। তবে সেখানে মাটির ওপর কিছুটা জায়গা উঁচু করে বাঁধানো ছিল। বোঝা যায় একটা ঘরের ভিটা সেটা। তবে ঘরটা নেই। তুমি বাঁচলা কেমনে? ওবায়দুল জানাল, ‘বড় তুফানের ধাক্কায় আমি ছিট্টা গেছিলাম।

কিন্তু মায়ে সাঁতরাইয়্যা আমার ডাইন হাত ধইর‌্যা ফালায়। হেরপর হাত আর ছাড়ে নাই। আমরা ভাসতে লাগছি। ’ এত ঝড়ের মধ্যে কেমনে ভাইস্যা থাকলা? ওবায়দুল বেশ কিছু সময় নিয়া বলল, ‘মেল্যা রাইত। শো শো বাতাস আর আন্ধার।

চারদিকে পানি আর পানি। হেই পানি অনেক কাল (ঠাণ্ডা) আছিল। মায়ে আমারে নিয়া ভাইস্যা যাচ্ছিল। ’ তোমার মা কি কিছু ধইর‌্যা ভাসতেছিল? ‘হ্যা কেমনে কমু। তয় হ্যার আরেক হাতে একবার একটা কালো গোল বাক্স দেখছিলাম।

এরহম বাক্স আগে কখনো দেহি নাই। ভাসতে ভাসতে একসময় মায়ের হাত অনেক কাল (ঠাণ্ডা) হইয়্যা গেছিল। ’ তোমরা কতক্ষণ ভাসছিলা? ওবায়দুল বলল, বেইন্যাকালের আলো যখন ফুটল তখন আমরা একটা চরের কিনারে ছিলাম। মায়ে তহন কোমড় পানিতে। আমারে কইলো ‘তুই তরে (চরের পারে) ওঠ, আমি যাই।

’ এরপর আমারে একটা ধাক্কা দিয়া পারে উঠাইয়া দিল। তোমার মা তোমার সাথে অন্য কোনো কথা কয় নাই? জবাবে ওবায়দুল, হারা (সারা) রাইত মায়ে খালি আমার হাত ধইর‌্যা ভাসাইয়া নিয়া গেছে। কোনো কথা কয় নাই। শুধু তরে ওঠানোর সময় কইছে ‘তুই তরে ওঠ, আমি যাই’। এরপর তুমি কী করলা? ওবায়দুল বলল, ‘মোর খুব ডর লাগতেছিল।

মায়ে ছাড়ার পরে চরে একটা নৌকার গলুইয়ের মধ্যে ঢুইক্যা শুইয়া ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা পোলা আমারে দেইখ্যা চইল্যা গেল। হেরপর মাইনষ্যে আইয়্যা মোরে হাসপাতালে লইয়্যা যায়। ’ তোমার মায়ের কী হইল? এবার ওবায়দুলের চোখেও জল এসে গেছে। জানাল, দুপুরের কালে লোকজন আমারে নিয়া নদীর পাড়ে গেল।

আমারে যেহানে পাইছে, সেখান থেকে একটু দূরে মায়ে শুইয়্যা ছিল। মাইনষ্যে কইল হ্যায় নাকি মইর‌্যা গেছে। ওবায়দুলের মায়ের নাম হালিমা। ৩৩ বছর বয়সের এই নারী তিন সন্তানকে আগলে রেখেছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। জাহিদুলের ভাষায়, মায়ে অনেক ভালা আছিল।

কখনো মারত না। ঢাকা থেকে চলে আসার পর মাইনষ্যের বাড়ি বাড়ি গিয়া কাম কইর‌্যা আমাগো খাওয়াইছে। নিজে না খাইয়্যা ছিল ম্যালা রাইত। মায়ে খুব ভালা ছিল। আল্লাহ যেন মোর মায়েরে বেহেস্তে সুখে রাখে।

কলাগাছিয়া চরের জেলে জসিম জানাল, ওবায়দুলের বেঁচে থাকাটা অলৌকিক ব্যাপার। আমাদের এখান থেকে চর মোনতাজের দূরত্ব সরাসরি নদীপথে গেলে ৮ কিলোমিটারের মতো। কিন্তু ওবায়দুল আর তার মা প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ ভেসে গিয়ে সেই চরে পৌঁছাইছে। হেগো মতো আরো যারা ভাইস্যা গেছিল সবাই মরছে। এইটা আমাদের কাছে বিস্ময়কর ব্যাপার।

অলৌকিক কাহিনী। কলাগাছিয়া চরে এখন নতুন করে জীবন শুরুর চেষ্টা করছে কেউ কেউ। সেখানে অবস্থানরত জেলে মজিবুর রহমান গাজী জানালেন, ঝড়ের রাতে এই চরে ৪০০০-এর মতো মানুষ ছিল। ঝড় কেড়ে নিয়েছে ১০০০-এর মতো তাজা প্রাণ। বেশ কয়েকটা ট্রলার হারিয়ে (ডুবে) গেছে।

প্রচুর গরু-মহিষ মারা গেছে। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় ৭০০ ঘর সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে। এখন আমাদের ভরসা শুধু মাইনষ্যের দান-খয়রাত। কলাগাছিয়া চরের বয়স ২০ বছরের বেশি। একেবারে সাগরঘেঁষা হলেও সেখানে দুর্যোগ মোকাবেলার কোনো ব্যবস্থাই নেই।

চর রক্ষায় এখনো তৈরি হয়নি বেড়িবাঁধ। নেই কোনো সাইকোন শেল্টার। রেলিং ছাড়া ছাদের মতো জেগে আছে চরটি। এখানের বাসিন্দারা কেউ স্থায়ী, কেউ অস্থায়ী। স্থায়ী বাসিন্দা নুরুজ্জামান জানান, আমরা বাঁচতে চাই।

সরকার আমাদেরকে বেড়িবাঁধ আর সাইকোন শেল্টার করে দিলে সুবিধা হয়। ওবায়দুলের পরের কাহিনী মানুষের মুখে মুখে। চর মোনতাজ থেকে তাকে নিয়ে আসা হয় গেবুয়া গ্রামে। তার মাকে গেবুয়া গ্রামে দাফন করা হয়েছে। দিনের বেশির ভাগ সময়ই ওবায়দুল বসে থাকে নারিকেল পাতায় ঢাকা মায়ের কবরের পাশে।

ছোট্ট এই বালকের কাছে পৃথিবীটা বিস্ময়কর। পাষণ্ড বাবা তাদের ছেড়ে গেছে অনেক আগেই। আর মা তো তাকে বাঁচাতে গিয়েই চলে গেল। ওবায়দুল এখন এতিম। ঘূর্ণিঝড়ে এতিম হওয়া আরো অনেক শিশুর একজন।

তবে ওবায়দুলের কিছুই নেই। গেবুয়া গ্রামে তাদের যে ঝুপড়িঘর ছিল সেটাও ঘূর্ণিঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে। আর তাই প্রতিবেশীর বাড়িতে থাকে তারা। ভবিষ্যতে কী করবা? ওবায়দুল জানায়, ‘আগে বড় হই। হ্যারপর দেখমু অনে।

’ আর জাহিদুল জানাল, ‘এহন তো আমাগো আর কোন মাথা নাই। ভাবতাছি মাইনষ্যের বাড়ি বাড়ি গিয়া কাম খুঁজমু। ভাইডারে তো বাঁচাইতে হইব। ’ আর হ্যাঁ, ওবায়দুলের ছোটবোন রুবিনাকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার ভাইয়ের দাবি, সম্ভবত সে মারা গেছে।

(সাপ্তািহক ২০০০ এ প্রকািশত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।