আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজাকারের জবানবন্দি -১

পা

১৯৭১ সালে ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায় রচনা করেছে আল বাদর-রজাকাররা। ঘাতক রাজাকাররা কত জঘন্য বর্বরতা,নির্মম নির্যাতন,নিষ্ঠুর অত্যাচার, বিভৎস পৈশাচিক রাহাজানি, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছে তা বর্ণনাতীত। আল বাদর-রাজাকারদের নির্দয় নিপীড়নের কাহিনী যে কোন বিবেকসম্পন্ন মানুষকে স্তম্ভিত করে। গা শিহরিত এমনই এক ঘটনা ‘রাজাকারের জবানবন্দি’ শিরনামে লিপিবদ্ধ করেছেন কানাডা প্রবাসী এম বাহাউদ্দিন। এখানে তা ধারবাহিকভাবে তুলে ধরা হল।

বিদ্র: লেখাটি যদি আগে অন্য কেউ পোস্ট করে থাকে টবে আমাকে জানাবেন আমি মুছে ফেলব। কানাডার টরন্টো শহরের মহা অট্টোলিকার ২৯ তলায় আমার বাস। মালিক নই, ভাড়াটে। আমার মত আরও অনেক বঙ্গ সন্তান অনেক আগে থেকেই এই অট্টালিকায় বসবাস করে আসছে। কেউ তিরিশ চল্লিশ বছরও আছে।

তবে সত্তর দশকের বাসিন্দাই বেশি। এ আমাদের স্বাধীনতার ফসল। স্বাধীনতার পর সহজলভ্য পাসপোর্ট আর জীবন-জীবিকার তাগিদে বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। যারা সত্তরের দশকে এ দেশে পাড়ি দিয়েছেন তারা এখন বৃদ্ধের কোটায়। নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছেন।

যাদের মাতাপিতা জীবিত তাদের স্পন্সর করে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন। এই মাতাপিতারা অনেক বৃদ্ধ। এখানে এসে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করছেন। সাধারণত এই মাতাপিতাদের করার মত কিছুই থাকে না। কেউ নাতি নাতনী নিয়ে সময় কাটান, কেউ ধর্মকর্ম করে সময় কাটিয়ে দেন।

কেউবা ছোট ছেলে মেয়েদের আরবী শিক্ষা দেন। প্রতিদিন অফিসে আসা যাওয়ার সময় অনেক বঙ্গ সন্তানের সাথে দেখা হয়। কারও সাথে কুশল বিনিময় হয়, অপরিচিতদের সাথে হয় না। একদিন অফিস থেকে ফেয়ার পথে ইলেভেটরের লবিতে সত্তোরোর্ধ দু’জন বৃদ্ধ সালাম দিয়ে হাত মিলিয়ে জিজ্ঞেস করল- আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ? বললাম- ইয়েস। তখন তিনি বুকে বুক মিলিয়ে কুশল বিনিময় করে বললেন: আমার নাম আলহাজ্জ মুহাম্মদ ইয়াসিন হাওলাদার।

বাড়ী... (এখানে জেলার নামটা উহ্য রাখতে হল কোন কারণে)। আর ইনি হলেন আলতাফ হোসেন। আমি থাকি এগার তলায় আমার ছেলের সাথে। আর ইনি থাকেন নয় তলায় তার মেয়ের সাথে। এগার তলায় আমরা একটা মসজিদ করেছি, প্রতি জুম্মায় জামাত হয়।

আসবেন নামায পড়তে। আমি দু’জনের দিকে ভাল করে তাকালাম। আলতাফ সাহেব বাঙালি স্টাইলে পায়জামা পাঞ্জাবী আর বাঙালি টুপি পরিহিত। বাঙালি টুপি বললাম এই জন্য যে বাংলাদেশে একটু লম্বা মত সাদা যে টুপিটা কারো কারো মাথায় দেখা যায় তা আর কোথায়ও দেখিনি। মাথায় সাদা কয়েকটা চুল লেগে আছে।

মুখে পাতলা দাড়ি। তাও একদম সাদা। চোখ কোঠরাগত। গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা। বয়স সত্তরের উপর হবে।

বয়সের তুলনায় একটু বেশি কাহিল মনে হল। ইয়াসিন সাহেবের গায়ের রং আফ্রিকার মানুষের কাছাকাছি। মাথায় সউদি রুমাল (লাল সাদা ক্রস স্ট্রাইপ)। পরনে সউদি কোর্তা যা পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝুলে থাকে। বয়স সত্তরের উপর হবে।

কিন্তু বয়সের তুলনায় খুব শক্ত সামর্থ দেখা যায়। মুখে ঘন চাপ দাড়ি বুক ছাড়িয়ে গেছে। এরই মাঝে তিনি দুবার দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিয়েছেন। হয়তবা মুদ্রাদোষ। আমি আমার নাম বললাম।

শুনে দু’জনেরই খুব খুশি হলেন। আমি কথা দিলাম জুম্মার দিন নতুন মসজিদে আসব। সেই থেকে তাদের সাথে সখ্য। তাদের কাম আর আমার নাম মিলে সখ্যতা তীব্র গতিতে এগিয়ে গেল। বাসায় আসা যাওয়া শুরু হল।

একবারে গলায় গলায় ভাব। দেখলাম ইয়াসিন সাহেবই লিডার। আলতাফ সাহেব শুধু সাথে থাকেন। খুব কম কথা বলেন। ইয়াসিন সাহেবই সব চালিয়ে নিয়ে যান।

মাঝে দু’একটা হাদীছ শরীফও বয়ান করেন। ইয়াসিন সাহেবের ছেলের সাথে পরিচয় হল। নাম মুহাম্মদ আবুল কাসেম হাওলাদার। কাজ করেন একটা রেস্টুরেন্টে। ডিউটির কোন আগামাথা নেই।

তার দুটি ছেলে। তিন ও পাঁচ। ইয়াসিন সাহেব বাদ মাগরিব কয়েকটা ছেলেমেয়েকে আরবী শিক্ষা দেন। সেগুলোও বাঙালি। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় কিছুদিন যাবত বেশ রাত করে ঘরে ফিরি।

প্রায় মাসখানেক আমাদের দ’ুজন আলিমের সাথে সাক্ষাৎ হয় না। ব্যস্ততা কমে যাবার পর একদিন বিকেলে লবিতে আলতাফ সাহেবের সাথে দেখা। কুশল বিনিময় করে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়াসিন সাহেবকে দেখাছি না। তিনি কোথায়? কেমন আছেন? আমার এতগুলো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন: একটা ঘটনা তো হয়ে গেছে! বলতে লজ্জা করে। তিনি এখন জেলে।

বলেন কী! একজন হাজী, আলিম মানুষ! কি কারণে জেলে? জেলে না হাজতে? ঐ একই কথা হল। কি, হয়েছিল কি? ঘটনা বলুন তো! তিনি যে আরবী পড়াতেন সেখানে কিছু একটা হয়েছে। আপনি বরং তার ছেলে কাসেমের সাথে কথা বলুন। সেই সব সঠিকভাবে বলতে পারবে। উকিল নিযুক্ত করেছে? নিশ্চয়ই কোথায়ও ভুল হচ্ছে।

এমন একজন হাজী, আলিম মানুষ, আল্লাহ পাক-এর কাজে যিনি সর্বদা ব্যস্ত, একটা মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি খারাপ কিছু করতেই পারেন না! দুনিয়ার সব আলিম এক হয়ে এখন তার প্রতিবাদ করা উচিত। মসজিদের সব মুসুল্লিরা কি বলে? হাজী সাহেবকে বের করে আনার কী ব্যবস্থা হচ্ছে? এসব আমি কিছুই জানি না। কাসেম সব জানে। আমি আর দাঁড়ালাম না। সোজা কাসেমের বাসায় চলে গেলাম।

দরজা নক করতেই কাসেম খুলে দিল। সালাম বিনিময় করে ঘরে গিয়ে বসলাম। সে বলল, আপনি এসেছেন ভালই হল। একজন মানুষ নেই যার সাথে একটু পরামর্শ করব। আমি আজ আপনার বাসায় যেতাম।

সবার সাথে তো সব কথা বলা যায় না! আমি এইমাত্র উকিলের কাছ থেকে আসলাম। বোধ হয় শুনেছেন ঘটনা। না, আমি তো কিছুই জানি না। এইমাত্র আলতাফ সাহেবের কাছে শুনলাম তিনি জেলে। কি কারণে জেলে আলতাফ সাহেব বলতে পারেননি।

এখন আমাকে ব্যপারটা খুলে বল তো! ব্যাপার কিছুই না। একটা বার বছরের মেয়ের অভিযোগে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। মেয়েটা কে? একটা বাঙালি মেয়ে। তাকে আরবী পড়াতেন। তার বাবা মা অভিযোগ করেছে।

অভিযোগ করলেই হল! ষাটোর্ধ একজন বৃদ্ধ একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে কিছু করেছে একথা কেউ বিশ্বাস করবে? এটা নিশ্চয়ই বানানো কিছু। আমি উকিলের সাথে কথা বলতে চাই। আমি একা গেলে তো কথা বলবে না। তোমার সাথে যেতে হবে। কখন যেতে পারি? আমি তো কাজে যাই না আজ দু’সপ্তাহ হল।

ঝামেলা শেষ করে কবে যে কাজে যোগ দিতে পারব জানি না। আমি যে কোন সময় যেতে পারি। কালও উকিলের কাছে যাব। দু’টার সময়। আপনি গেলে যেতে পারেন।

কাল আমি ছুটি নিব। তোমার সাথে যাব। একজন আলিমের জন্য কাজ করব না তো কার জন্য করব! একজন হাজীর উপকার করতে পারলে কত নেকি পাব তার হিসাব আমার জানা নেই। মনে মনে ভাবলাম যদি এমনিভাবে মানুষের উপকারে লেগে যাই তাহলে বেহেস্তের পথটা পরিষ্কার হয়েও যেতে পারে। কাসেমকে বললাম, আমি ঠিক বারটায় রেডি থাকব।

তুমি আমাকে নিয়ে যেও। আমরা ঠিক সময়ে গিয়ে পৌঁছলাম উকিলের অফিসে। উকিলের নাম..... কাসেম পরিচয় করিয়ে দিল। বলল, আমার আঙ্কেল জনাব মিসকীন। তোমার সাথে কথা বলতে এসেছে।

করমর্দন করে সে আমাকে বসতে বলল। তারপর বলল, বল, তুমি কি কথা বলতে এসেছ? কি অভিযোগে এমন একজন পায়াস (ধর্মপরায়ণ) মানুষকে গ্রেফতার করা হল? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হল: সেক্সুয়েল এবিউসমেন্ট, চাইল্ড মলেস্টেশন। কে করেছে অভিযোগ? এ পর্যন্ত তিনটা অভিযোগ হয়েছে। প্রথম হয়েছে ছয়মাস আগে। একটি বার বছরের মেয়ের বাবা-মা অভিযোগ করেছে।

তাদের মেয়েকে ধর্মীয় শিক্ষা দেবার সময় সে মলেস্ট করেছে। সেই অভিযোগের পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। কারণ সে একজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ এবং পায়াস লোক। ফাইভ টাইম সে ইবাদত করে, বেশিরভাগ সময় মসজিদে কাটায়। কিন্তু পুলিশ তাকে নজরে রেখেছে।

তারপর দু’মাস আগে একই ধরনের অভিযোগ আসে আর একটি পরিবারের কাছ থেকে। এখানেও সে ধর্মীয় শিক্ষা দিত। দশ বছরের একটি মেয়েকে সে কোলে বসিয়ে পড়াচ্ছিল। তার মা দেখে ফেলে ইয়াসিনকে শিক্ষকের কাজ থেকে বাদ দিয়ে পুলিশে অভিযোগ করে। পুলিশ আরও প্রমাণের অপেক্ষায় ছিল।

একদিন বিকেলে একটি বার বছরের মেয়ে মেইল চেক করার জন্য মেইল রুমে যায়। তখন অন্য কোন লোকজন ছিল না সেখানে। সাদা পোশাকে পুলিশ তার উপর নজর রাখছিল। যখন মেয়েটি মেইল রুমে ঢুকে তার পিছু পিছু ইয়াসিনও ঢুকে। যদিও তার মেইল চেক করার চাবি ছিল না।

এক সময় সে মেয়েটিকে খুব আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরতেই মেয়েটি তার বাহু থেকে ফসকে দে ছুট। এ সময় দূরে লবির এক কোণে দাঁড়ানো পুলিশ দেখে ফেলে এবং হাতে নাতে গ্রেফতার করে। এসব মামলা খুবই স্পর্শকাতর। কোন সাক্ষী লাগে না। তার বিরুদ্ধে তিনটা অভিযোগ।

এখন ভাবছি কিভাবে তাকে বাঁচানো যায়। অথবা মিনিমাম পানিসমেন্ট কিভাবে হতে পারে। আমি আমার আরও সহকারীদের নিয়ে আগামীকাল বসব এই মামলাটা নিয়ে আলোচনার জন্য। এখন কোন পথে এগুনো যায় তা তোমাকে তিন দিন পর বলতে পারব। তুমি বরং তিন দিন পর আমার এখানে আর একবার এস অথবা ফোন করো।

আমার এখন কোর্টে যেতে হবে। তোমার সাথে আর কথা বলতে পারব না। সি ইউ, বাই.....। তিন দিন পর কাসেমকে নিয়ে উপস্থিত হলাম উকিলের অফিসে। উকিল আমাদের দেখে কুশল বিনিময় করে বসতে বলল।

আমরা বসার পর উকিল আমার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, দেখ আমার পঁচিশ বছর ওকালতি জীবনে এমন অদ্ভুত মক্কেলের দেখা পাইনি। সে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। দোষ স্বীকার করে সে একটা স্টেটমেন্ট দিয়েছে। তাতে মনে হয় তার বড় ধরনের শাস্তি হয়ে যাবে।

আমি ভেবে দেখলাম তাকে সব দোষ দেয়া যায় না। সে ঘাবড়ে গেছে এবং ভয়ে ভাল করে কথাও বলতে পারে না। বোধ হয় পুলিশের চাপে পড়ে এবং ভয়ে এসব জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশ তার উপর খুব চাপ দিয়েছে। কারণ এদেশে সে আছে মাত্র একবছর।

তার অতীত সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই। তার অতীত জানতে হলে তার দেশে যেতে হবে। তাই তাকে খুব চাপ দিয়ে তার মুখ থেকেই তার অতীত জেনে নিল। সে এক বিরাট স্টেটমেন্ট। তাতে মামলার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে।

কি দিয়েছে সে জবানবন্দি? আমি তো এখনও কিছুই দেখিনি। দোভাষীর সাহায্যে সে তার নিজের ভাষায় বলেছে আর তা এখন টাইপ হচ্ছে। একটা কপির জন্য আমি দরখাস্ত করেছি। কাল পরশুর মাঝে পেয়ে যাব। তখন বুঝতে পারব কোন দৃষ্টি নিয়ে মামলা লড়তে হবে।

জবানবন্দি না দেখে এখন কিছুই বলতে পারব না। তোমরা বরং দু’দিন পর আস। সব দেখে আলোচনা করা যাবে। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে দু’জন অনেকক্ষণ চুপচাপ হাটলাম। সাবওয়ের কাছে এসে কাসেম বলল, কাকা, কি হতে পারে জবানবন্দি? কি আর হবে? বোধ হয় দোষ কিছু করেছে যা আমরা জানি না এবং তা স্বীকার করেছে।

এদেশে দোষ স্বীকার করলে অনুকম্পার দৃষ্টিতে শাস্তি হয়। জবানবন্দি দিয়ে বোধ হয় ভালই করেছে। তারপর সারা পথ দু’জনের আর কোন কথা হয়নি। (চলবে)


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.