আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেয়ারনেস ক্রিম সমাচার

তুমি যে আছ তাই,আমি ব্লগে লিখে যাই...... ১.চাকরি হতে অবসরপ্রাপ্ত ঘরের কর্তা গিন্নির কাছে চা চেয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে মুখের উপর ঝাড়ি-দুধ নাই। পরিবারের এই “দুর্দশা” দেখে বাড়ির কালো মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেয় যে সে ‘ফর্সা’ হবে। তখনই আশীর্বাদের মত ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি আবির্ভূত হয়!এবং বিজ্ঞাপনের শেষে আমরা দেখতে পাই-কালো মেয়েটি ‘সাদা’ হয়ে বিমানবালা হয়েছেন এবং পরিবারকে সচ্ছলতা দেখিয়েছেন! ২.এক যুবক স্টান্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। পারফরম্যান্স ও ভালোই।

কিন্তু কি দুর্ভাগ্য তার গায়ের রং ও কালো!এখানে ও সেই ইউনিলিভার!তবে ভিন্ন নামে। ফেয়ার এন্ড লাভলির ‘পুরুষ সংস্করণ’ ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম। কারণ,নারী এবং পুরুষের ত্বক এক নয়। অবশেষে ‘ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম’ নামের ক্রিম মাখার পরে স্টান্ট ভাইয়া ‘নায়কের’ ভাত ও মেরে দেন! এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে ফেয়ারনেস ক্রিম কোম্পানি গুলোর বিজ্ঞাপনের। কোন ফেয়ারনেস কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখার সময় আমার প্রথমেই যে কথাটা মনে হয় সেটা হচ্ছে যতক্ষন পর্যন্ত আপনি সাদা চামড়াধারী কেউ না হন,ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি মানুষ নন!ফেয়ারনেস ক্রিম গুলোর টিভিসির সবচাইতে কমন ফরম্যাট হচ্ছে,একজন সাধারণ মেয়ে নিজের গায়ের রং নিয়ে যারপনাই বিষণ্ণ এবং সাফল্য যেন তার হাতে ধরা দেয় না।

কিন্তু যেই না সে “স্টুপিড” ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করা শুরু করলো,অমনি সাফল্য তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো!এমনকি মধুলোভি ছেলেরাও আশপাশে ঘুরতে শুরু করে,প্রেম নিবেদন করে। আদতে নাম ‘ফেয়ারনেস ক্রিম’ হলেও এইসব ক্রিমকে টিভিসিগুলোতে রং সাদাকারী ক্রিম হিসেবেই দেখানো হয়। নিরন্তর মিথ্যা প্রচারণা এদের বড় হাতিয়ার। বিজ্ঞাপনী প্রচারণা চালানর জন্য নানা কৌশলে কিছু ভুল মেসেজ দেওয়ার ব্যাপারে এদের জুড়ি মেলানো ভার!মিনিপ্যাক-টিউবের মত এদের মিথ্যার ধরন ও নানামুখী। মূলতঃ ব্রিটিশরা উপমহাদেশে শাসন শুরু করবার পর থেকেই এই ধারণা জন্মাতে শুরু করে যে,গায়ের রং ফর্সা মানেই সুন্দর।

অবশ্য এরও আগে বর্ণপ্রথার সুবাদে এই ধারণা জন্মায় যে ‘ব্রাহ্মণরা শুদ্ধ বিধায় সাদা এবং দলিত তথা নিম্ন বর্ণের লোকজন অশুদ্ধ বিধায় কালো’। ধীরে ধীরে ফর্সা হওয়ার ধারণা এত ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে যে এশিয়া মহাদেশ কিংবা আরেকটু স্পষ্ট করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশ ফেয়ারনেস ক্রিম কোম্পানিগুলোর সবচাইতে বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। গবেষণা সংস্থা ACNielsen এর মতে শুধু ইন্ডিয়াতেই ২০১০ সালে এই বাজারের আর্থিক মূল্যমান ছিল ৪৩২ মিলিয়ন ডলার এবং প্রতি বছর ১৮% প্রবৃদ্ধি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। উপমহাদেশের নামজাদা সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই ফেয়ারনেস ক্রিম কোম্পানিগুলোর মডেল হয়েছেন,যার ফলে এইসব ফেয়ারনেস ক্রিম নারীসমাজের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। ফেয়ারনেস ক্রিম শুধু নারীতেই থেমে থাকেনি বরং এখন পুরুষের জন্যও ফেয়ারনেস ক্রিম পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেশ জনপ্রিয় একজন ক্রিকেটার এই মিডিয়া ক্যাম্পেইনে আছেন। খুব সম্প্রতি পুরুষদের জন্য বাজারজাতকৃত ফেয়ারনেস ক্রিম জনপ্রিয় করার জন্য একটি রিয়েলিটি শো এরও আয়োজন করা হয়েছে। পুরুষদের জন্য ভ্যাসলিনের যে প্রডাক্ট আছে তা জনপ্রিয় করার জন্য ফেসবুকে একটি এপ্লিকেশান ও আছে! এখন স্বভাবতই একটা প্রশ্ন সামনে চলে আসে যে আসলেই কি রং ফরসাকারি ক্রিমগুলো গায়ের রং ফর্সা করতে পারে?কিংবা রং ফর্সা করার জন্য যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়,সেগুলো কি ক্ষতিকর?অথবা ফর্সা মেয়েরা কালো মেয়েদের চাইতে সেরা-এই ধরনের মানসিক প্রচারনা আসলে কতটা নৈতিক বা সমর্থনযোগ্য? ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মত যখন ফেয়ার এন্ড লাভলি বাজারজাত করা হচ্ছিল,তখন এর বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল-এবার ভারতীয় নারীরা একটি ‘টিউবের’ মধ্যে তাদের আশা খুঁজে পাবেন!এবং সেই সাথে এও দাবি করা হয়েছিল যে, niacinamide বা নিকোটিনামাইডের এর মধ্যে গায়ের রং ফরসাকারি গুণ পাওয়া গেছে। এই নিকোটিনামাইড আসলে কি তা সচেতন কাউকে উইকিপিডিয়ায় খুঁজে দেখবার অনুরোধ রইল। শুধু এটুকুই বলি,নিয়াচিনামাইড বা নিকোটিনামাইডএর রং ফর্সা করার ‘গুণ’ আছে ঠিকই তবে সেই সাথে ব্রণ,উদ্বিগ্নতা সেই সাথে ক্যান্সারকে ডেকে নিয়ে আসার ‘গুণ’ ও আছে!এখন হয়তো নিকোটিনামাইড আর ব্যবহার করা হয় না ঠিক,তবে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, সেগুলোও যে ক্ষতিকর নয় তার নিশ্চয়তাই বা কি? এবার কিছু ফ্যাক্ট জানা যাক!আমাদের ত্বকের রং এর পিছনে মেলানিন নামের পিগমেন্টই মূল ভুমিকা পালন করে।

জেনেটিক লাইনেজ কিংবা আমাদের পূর্বপুরুষদের গায়ের রং ঠিক করে যে মেলানিনএর পরিমাণ কিংবা গঠন কেমন হবে। ডারমালজিস্টদের মতে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত ত্বকের রং বদলান সম্ভব,এর বেশি নয়। তাহলে ফেয়ারনেস ক্রিমের কাজ কি?ফেয়ারনেস ক্রিম সূর্যরশ্মিকে ঠেকিয়ে দেয়। যার ফলে মেলানিন এর নিঃসরণ কম হয় এবং কম কালো দেখায়। কিন্তু সত্য কথা বলতে ফেয়ারনেস ক্রিম কক্ষনোই গায়ের রং সম্পূর্ণভাবে বদলাতে পারে না।

ব্যাপারটা অনেকটা এমনঃধরুন,আপনার চুল কোঁকড়া। এখন আপনি হয়তো কেমিক্যাল ব্যবহার করে কিংবা বিউটি পারলারে গিয়ে আপনার চুলকে সাময়িক স্ট্রেইট করতে পারবেন কিন্তু আপনার মাথায় নতুন যেসব চুল গজাবে,সেগুলো কোঁকড়াই হবে। কারো কারো ধারণা,ক্রিমের প্যাকেটে তো উপাদান লেখাই থাকে,তাহলে সমস্যা কি?কিন্তু জেনে রাখা ভালো,ক্রিমের উৎপাদকরা ক্রিমের সব কয়টি উপাদান লিখতে বাধ্য নন। তাহলে কি আয়ুর্বেদিক প্রডাক্ট ব্যবহার করা উচিৎ?আয়ুর্বেদিক প্রডাক্ট যেহেতু বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয়,সুতরাং এখানেও কেমিক্যাল ব্যবহারের ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই রূপচর্চার জন্য নিজের বাসায় তৈরি প্যাকই সবচাইতে নিরাপদ।

দীর্ঘদিন ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করলে তার ফলাফল কি হতে পারে এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন ধারণা পাওয়া যায় না। ফেয়ারনেস ক্রিমগুলোর বিজ্ঞাপনে নারীকে হেয় করে দেখানোর একটা নোংরা প্রবণতা কাজ করে। অভিযোগ আছে ,যৌতুকের মত নির্মম প্রথাকে উস্কে দেওয়ার। মজার ব্যাপার হচ্ছে,ফেয়ার এন্ড লাভলি যে ইউনিলিভারের পণ্য,সেই ইউনিলিভারেরই পণ্য ‘ডাভ” এর ‘ক্যাম্পেন ফর রিয়েল বিউটি’ নামে একটি ইউএসএ-ইউরোপে একটি জনপ্রিয় প্রচারণা আছে যেখানে দেখানো হয়,শ্বেতাঙ্গ কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ-যাই হোক না কেন নারী-ই সুন্দর!ইউনিলিভারের ওয়েবসাইটে ফেয়ার লাভলি সম্পর্কে লেখা আছেঃFair & Lovely understands that different people have different fairness needs based on age or skin type and therefore offers expert fairness solutions relevant to different consumer needs আবার ডাভ সম্মন্ধে লেখা আছেঃDove today is in 80 countries making women beautiful everyday and enabling them to enjoy their own brand of beauty by providing a wide range of personal care, hair care, and skin care products. Dove is known to be a keeper of promises and has given real products to women all over the world. মানে একদিকে সৌন্দর্যের প্রচারণা অন্যদিকে ত্বক ফর্সা হওয়ার প্রচারণা। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বোধহয় একেই বলে!ফেয়ার এন্ড লাভলির নামে ইউনিলিভারের একটি ফাউন্ডেশান ও আছে!যার সম্বন্ধে ওয়েবসাইটে এভাবেই বলা আছেঃUnilever Bangladesh's social initiative to encourage women's economic empowerment through information and resources in the areas of Career, Education and Enterprise, has created waves across the country. স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে,একজন নারী যদি সুন্দর হন,তবে এইসব গুণের কি আদৌ দরকার আছে?আর একজন নারীর যদি শিক্ষা-মেধা সহ অন্যান্য গুণাবলি থাকে,তাহলে একজন নারী কেন ফেয়ার এন্ড লাভলি বা ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করবেন?তাহলে কি ফর্সা হওয়াটাই কি সব? এইসব প্রশ্নের উত্তর মিলানো কিছুটা কঠিন বৈকি!নারীর প্রতি এমন অবজ্ঞা মিডিয়াগুলোতে দেখানোর পরেও কেন সরকারের কিংবা নারী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না সে প্রশ্নের উত্তর উনারাই ভালো জানেন।

তবে এইসব ছাইপাশ কিনে আর কেউ ঠকে না,ঠকে গার্মেন্টস এর নিম্ন-মজুরি পাওয়া মেয়ে,গ্রামের কিশোরি কিংবা মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণীটা!প্রিন্ট কিংবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া শুধু সাপ্তাহিক নারী বিষয়ক ক্রোড়পত্র ছাপিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত ভাবে। পারলে সেই ক্রোড়পত্রেও ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপন ছাপে!আর এভাবেই আমাদের দিন যাচ্ছে,নারীকে সামনে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে চাইছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।