আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যে কথা আবারও বলি



যে কথা আবারও বলি ফকির ইলিয়াস খুব বেশি মনে পড়ছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা। আমি তাকে শ্রদ্ধাভরে ‘মা’ বলে ডাকতাম। ১৯৯২ সাল। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছে। তারই ডাকে সাড়া দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা এ কমিটির শাখা গঠন করেছি।

আমি সে কমিটির প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সচিব। মায়ের সঙ্গে প্রায়ই ফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, আমরা এগিয়ে যাবই। আমাদের সঙ্গে আছেন এই বাংলার মানুষ। মনে সাহস পাই।

শহীদ জননীর ডাকে প্রতিষ্ঠিত গণআদালতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর এই একাত্মতা আমাদের আরও প্রত্যয়ী করে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে একই মঞ্চে বসেন শেখ হাসিনা। হাসিনা বলেন, ‘খালাম্মা, যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়, তবে এসব ঘাতক দালালকে বিচারের মুখোমুখি করবই। ’ আমরা শুনে আশান্বিত হই।

শহীদ জননী নিউইয়র্কে এলে হাজার হাজার অভিবাসী বাঙালি তাকে ঘিরে ধরেন। সবার চোখে-মুখে অজস্র জিজ্ঞাসা। আবদুর রউফ খান মিন্টু, সালেহ আহমদ মনিয়া, খসরুজ্জামান, শেখ আতিকুল, নুরে আলম গেদু, দেওয়ান শাহেদ চৌধুরী­ এরকম শত শত নির্ভীক কর্মীর মুখ। শহীদ জননীকে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করি, ‘মা, শেখ হাসিনা আপনার মঞ্চে বসে বলেছেন, যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায় তবে ঘাতক দালালদের বিচার করবে। মা, আপনি কি মনে করেন শেখ হাসিনা তার কথা (ওয়াদা) রাখবেন কিংবা রাখতে পারবেন।

’ শহীদ জননী চটপট জবাব দেন, ‘ছেলে, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? শেখ হাসিনা বা তার দল কিছুই করবে না। ’ শুনে ভীষণ হতাশ হই। তাহলে শেখ হাসিনা যে আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? মা হাসেন। তিনি বলেন, ঘাতক-রাজাকার-আলবদরদের বিচার এই বাংলার মানুষই একদিন করবে। হয়তো আমি দেখব না।

কিন্তু এই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে রাজাকাররা মানুষের মধ্যে ধিকৃত হবেই। এই ধিক্কার চলতেই থাকবে। মা বলেন, যদি নাৎসিদের বিচার এখনও চলতে পারে, তবে বাংলাদেশের আলবদর-রাজাকারদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না কেন? মা, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলাম এবং আনন্দও পেয়েছিলাম সেদিন। ব্যথা পেয়েছিলাম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেও এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্খা নেবে না এ কথা শুনে। আর আনন্দিত হয়েছিলাম এই প্রজন্ম একদিন ঘাতক দালালদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই সে কথা শুনে।

১৯৯৪ সালে শহীদ জননীর মৃত্যু ঘটে। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এরপর তারা ঘাতক-দালালদের বিচারের আদৌ কোন চেষ্টা করেছেন কি না তা দেশবাসীর, বাঙালি জাতির অজানা নয়। অগ্রজপ্রতিম প্রয়াত ড. হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আবারও তাই বলতে ইচ্ছে করে­ এমন বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? দুই. না চাইলেও এমন একটি বাংলাদেশের মুখোমুখি আজ আমরা। আলবদর কমান্ডাররা দাম্ভিকতার সঙ্গে বলছে, ‘বাংলাদেশে কোন স্বাধীনতাবিরোধী নেই।

’ আর কিছুদিন পর হয়তো তারা বলবে, রাজাকাররাই যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। এমন কথা শোনার জন্যই কি প্রস্তুত হচ্ছি আমরা? উপমহাদেশে মওদুদিবাদ এমন একটি বিষাক্ত তত্ত্ব যা সব সময়ই সুবিধাবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এরা ব্রিটিশ থেকে পাক ভারতের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। পরে পাকিস্তানের গুণগানই বেশি গাইতে চেয়েছে সুবিধাবাদী সেজে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাও তারা মেনে নেয়নি।

পরে স্বাধীন বাংলাদেশে এসব রাজাকার চক্রই সুবিধা (বিশেষ করে আর্থিক) পেয়েছে কিংবা নিয়েছে সবচেয়ে বেশি। দেখুন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের বিশ্লেষণ। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন এরা কিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়েছে। ঘাপটি মেরে বসে থাকা এই চক্রের দুই নেতা মন্ত্রী হয়েছে চারদলীয় জোটের নামে। যারা একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি-সেক্রেটারি ছিল তারাই বর্তমান জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি বলে মন্ত্রী হয়েছে বিএনপির ছত্রছায়ায়।

সেই মুজাহিদ-নিজামী চক্র ২০০৭ সালেও পশ্চিমা খান সেনাদের ভাষায় কথা বলে আলোচিত হতে চাইছে। অথচ বাংলার মাটি থেকে শহীদের রক্তের দাগ এবং ধর্ষিতার আর্তনাদের চিহ্ন এখনও মুছে যায়নি। কথা হচ্ছে এরা এত শক্তি পাচ্ছে কোথেকে? তবে কি তারা এই জরুরি অবস্খার মধ্যেও ব্যাপক শক্তি সংগ্রহের চেষ্টা করছে? কিংবা তারা সে চেষ্টায় সফল হতে চলেছে? ভাবিত হওয়ার কারণ আরও আছে। অতি সম্প্রতি বিএনপির একাংশের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার বলেছেন তারা ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনে আবারও জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করতে পারেন। কী ভয়ানক অগ্রিম তথ্য দিলেন খোন্দকার দেলোয়ার।

তিনি খুব সহজেই মনের কথাটি বলে দিয়েছেন। তাহলে অনুমান করা খুবই সহজ বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি আগামী নির্বাচনের আগে কী রূপ ধারণ করতে পারে, যা দেশের জনগণ, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। বাংলাদেশের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ সম্প্রতি নিউইয়র্কে বলে গেছেন, দেশ ওয়ান ইলেভেনের পুর্বাবস্খায় কোনমতেই ফিরে যাবে না। প্রত্যেকটি বাঙালিই মনেপ্রাণে চান তার এই কথা বাস্তবতার পরশ পাক। কিন্তু দেশে রাজাকার-জামায়াত চক্রের এই যে নগ্ন আস্ফালন, এ সóþöর্কে বর্তমান সেনাপ্রধান কি বলবেন? এরা এত শক্তি কোথা থেকে পাচ্ছে? কেন এখনও জামায়াত-শিবিরের অস্ত্র ভাণ্ডারগুলো উদ্ধার করা হচ্ছে না।

যারা বিডি ফুডসের ব্যানারে বিদেশে হেরোইন পাচারে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্খা নেয়া হচ্ছে না। তিন. ‘দেশে রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধী নেই’­ নরঘাতকদের এসব বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও গর্জে উঠেছে বাঙালি জাতি। দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ হচ্ছে। আমি দেখে এবং শুনে ভীষণ আনন্দিত হয়েছি যে নতুন প্রজন্মের অনেকেই এর তীব্র প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন কঠোর ভাষায়। লেখালেখির মাধ্যমে, মত-ঐক্য-সৌহার্দ্য বিনিময়ের মাধ্যমে একটি জোরাল ডাক এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।

পত্র-পত্রিকা, টিভি, অনলাইন, নিউজ সব মাধ্যমেই জেগে উঠেছে বাঙালিরা দেশে-বিদেশে। লেখালেখির একটি নতুন মাধ্যম, ব্লগিং জগতে আমি নতুন। সামহোয়ার ইন ব্লগ নামে একটি জনপ্রিয় ব্লগে আমি গেল দুই সপ্তাহ থেকে লিখতে শুরু করেছি। এ ব্লগটি সৃজনশীল মুক্তমনা মানুষের ব্লগ বলেই আমার মনে হয়েছে। এখানে সিংহভাগ ব্লগারই আলবদর-রাজাকারদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণসহ যেভাবে যৌক্তিক বক্তব্য দিয়েছেন কিংবা দিচ্ছেন তা সব প্রজন্মের জন্যই নবীন সুর্যের জ্যোতি বলেই আমার মনে হয়েছে।

ব্লগে যারা লেখেন তারা কেউ স্বনামে, কেউ ছদ্মনামে লেখেন। কিন্তু তারপরও একটি নিবিড় মানবসত্তা তো এর পেছনে কাজ করছে। এরা কেউ স্বদেশে, কেউ বিদেশে বসবাস করছেন। তারপরও তারা সত্যের সপক্ষে যে দাঁড়াচ্ছেন তাই হচ্ছে আজকের সবচেয়ে বড় আশা জাগানিয়া। এই ব্লগে একজন সম্মানিত ব্লগার ‘এস্কিমো’।

রাজাকার, আলবদর, নরপিশাচদের বিরুদ্ধে তার যুক্তি, তর্ক, বক্তব্য একাই সহস্র বলে আমার মনে হয়েছে। এছাড়াও ‘লাল দরজা’, ‘কোবরা’, ‘মুকুল’, ‘বিহঙ্গ’, ‘রাশেদ’সহ আরও অনেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে ব্যাপকভাবে কাজ করছেন। এরই মধ্যেই মহান মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান এবং সম্মানিত সেক্টর কমান্ডারদের বক্তব্য আমরা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে দেখেছি। তারা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কনভেনশন করারও ডাক দিয়েছেন। সাবেক সেনাপ্রধান মে. জে (অব.) হারন-অর-রশিদকে আহ্বায়ক করে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।

খুবই মর্মাহত চিত্তে বলি, যদি এখনই এসব নরঘাতককে রোখা না যায়, তবে তারা বলতে শুরু করবে, তারাই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল। বদর কমান্ডার নিজামী-মুজাহিদরাই স্বাধীনতার নায়ক। বাংলাদেশে বারবার আমরা এদের চরিত্র দেখেছি। এরা হলো কচ্ছপ প্রজাতি। সুযোগ পেলে মাথা বের করে আবার শঙ্কিত হলেই মাথা গুটিয়ে নেয়।

আরও ব্যাপকভাবে দেশের মানুষকে এদের চরিত্র যত বেশি খোলাসা করা যাবে, ততই মঙ্গল। আবারও ফিরে আসি শহীদ জননীর কথায়। তিনি বলেছিলেন, যদি এখনও নাৎসিরা বিশ্বে নিষিদ্ধ হয়, তবে রাজাকাররা নিষিদ্ধ হবে না কেন? পরিতাপের কথা, দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল এদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। শেষ কথা হচ্ছে, এই হীন কীটদের সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে বয়কট করা।

এদের নির্মুল করা। শহীদ জননী অত্যন্ত উচ্চাশা নিয়ে বলেছেন, একদিন না একদিন এই প্রজন্ম, এই জাতি এদের বিচার করবেই। সে কথা আবারও বলি, এদের প্রেতাত্মার দাপটের কাছে বাঙালি জাতি মাথা নোয়াবে না। নিউইয়র্ক, ৩০ অক্টোবর ২০০৭

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।