আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্রোহের রাস্তায় : ওরহান পামুক ( পর্ব ২ )

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে

আগের দিনটিতে ট্রাফিক বিশৃঙ্খলার স্থানটিতে আমরা একের পর এক অকল্পনীয় বিষয় দেখেছিলাম। লোকটি আমার কাছে সমালোচনা করে বলে, এই পর্যন্ত কেউই তেহরানে পুরোপুরি আইন মেনে চলে না। মেনে নেয়ায় সে মৃদু হেসেছিল। তবে সারাটি দিনই আমরা পরিপূর্ণ ট্রাফিক জ্যামের বসে কাটিয়েছিলাম। একপাশে স্থানীয়ভাবে তৈরি গাড়ি দেখতে পেয়েছিলাম।

ড্রাইভারগুলো একে অপরকে আশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করছিল। আমরা তাদের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছিলাম। পরিপূর্ণভাবে আধুনিক লোক হয়ে থাকলে কেইবা হাইওয়ে কোডের বিষয়টি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করবে। অন্যদিকে আমার চিন্তা নিবদ্ধ ছিল আমার ড্রাইভারের হাসির দিকে। সে মোড় নেবে কি নেবে না এ নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিল।

আমি মনে করতে পারছিলাম যুবক বয়সে ইন্তাম্বুলের ট্রাফিকে আমারও এই রকম চিন্তিত অনুভূতি হয়েছিল। চালকটি কেবল কিছু সময় বাচানোর জন্যই আইন অমান্য করবে! সে ভালো করেই জানে তাকে একাকিই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সকল সম্ভাবনাময় রাস্তা দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হবে। তাকে তখন তার নিজের জীবন এবং তার সঙ্গে জড়িত অন্য জীবনগুলোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। আপনি এখানে বলতে পারেন, আমাদের ড্রাইভারটি নিয়ম ভঙ্গ করে এবং নিজস্ব স্বাধীনতা নেয়ার কারণে তার মধ্যে একাকীত্ব এসেছিল।

কিন্তু আমাদের ড্রাইভারটি যদি স্বাধীন পছন্দ বেছে না নিতো তাহলে হয়ত বিষয়টি অন্য রকম হতো। তবে আমি বলব শহর এবং শহরের চালকদের সম্পর্কে সে ভালো করেই জানে। যদি আপনি মডার্ন ট্রাফিক আইন মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেন প্রয়োগবাদী লোকদের একাংশ আপনাকে এড়িয়ে যাবে। শহরের কেন্দ্রস্থলের বাইরে তেহরানে প্রতিটি চালকের দৃষ্টিভঙ্গি হলো লাইট এবং আইনের দিকে মনোযোগের পাশাপাশি যেসব চালক এড়িয়ে যাবার চিন্তা করে তাদের দিকেও মনোযোগ দেয়া। মজার ব্যাপার হলো- আপনি দুরন্ত ট্রাফিক ব্যবস্থায় আপনার পথ খুঁজে পেতে চেষ্টা করবেন।

এখানে রাষ্ট্র বলে সকলকেই পবিত্র গ্রন্থের ধর্মীয় আইনে সম্মান দেখাতে হবে। জাতীয় ঐক্যের নামে আইনগুলো নির্মমভাবে প্রয়োগ করা হয়। এটা পরিষ্কার যে কারাগারে বন্দি হবার আশা করলেই কেবল আইন ভাঙা সম্ভব হবে! শহরের চালকরা জানে, রাষ্ট্র সবকিছু দেখছে তারপরও কেউই হাইওয়ে কোর্ট মান্য করে না বললেই চলে। যে কেউ যে কোন কিছু করার আশা করেন। তারা রাস্তাকে স্বাধীনতার সীমার পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে ভাবে।

সে সাথে তাদের কল্পনাশক্তি এবং উদ্ভাবনপটুতার ক্ষেত্রও ভাবে। পশ্চিমে কোন চালক কোন লেন সহজেই পরিবর্তন করতে পারেন। সে নিশ্চিত থাকতে পারে চারপাশের সকলেই নিয়ম মানছে। অন্যরা মনে করবে, হয়তো লোকটি মিউজিক শুনছে। ঠিক আছে, তাকে ফৃ থাকতে দিই।

তেহরানে একজন চালক এক্ষেত্রে ভিন্ন রকমের স্বাধীনতা উপভোগ করেন। কিন্তু এর কোনটিই তাদের শান্তি দিতে পারে না। গত মে মাসে আমি তেহরান ভ্রমণে গিয়েছিলাম। তখনো চালকদের মধ্যে একই ধরনের বিশৃঙ্খল মনোভাব দেখতে পেয়েছিলাম। নিজস্ব মনোভাব থেকে হাইওয়ে কোড রক্ষায় তারা উত্তেজনা এবং উদ্ভাবনপটুতা নিয়ে বাগবিত-া করে।

আমার কাছে মনে হয়েছে, শহর জীবনের নানা অনুসঙ্গে একনায়করা তাদের উপর আইনগুলো চাপিয়ে দিয়ে শাসন করছে। কিন্তু আইন ভাঙার ছোটখাটো বিষয়গুলোকে এসবের বিরুদ্ধে চালকদের নিজস্বতাবাদ বলা যেতে পারে। তারপরও জনজীবনের সবক্ষেত্রে এবং রাস্তায় চলাফেলার সময় সমমনা চিন্তাগুলো শেয়ার করলে সবারই একটা অনুভূতি উঠে আসে। এসব চিন্তাগুলো হলো-ইসলামিক একনায়কবাদ মহিলাদের ঘরে অন্তরীণ করে ফেলছে। বইয়ের সেন্সর করছে, সব সময়ই কারাগার পরিপূর্ণতা রাখছে সে সঙ্গে নগরীর উঁচু ভবনগুলো দেশ ও ধর্মের জন্য আত্মঘাতিদের পোস্টারে ছেয়ে ফেলছে।

ইরানিয়ান বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনার সময় আমি একই বিষয় লক্ষ করেছিলাম। তাদের স্বাধীনতাকে ধর্মীয় আইন দ্বারা কঠোরভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র ধর্মীয় আইনকে রাস্তায়, মাটিতে, শহরের বড় বড় এভিনিউ এমনকি অন্য সকল জনবহুল স্থানেও প্রয়োগ করেছে। আন্তরিকতার সাথে আমি লক্ষ্য করেছি তাদের অনেকেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে-“আমরা হিটলারের জার্মানী অথবা স্টালিনের রাশিয়াতে বাস করছি না”। তারা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, আমরা যা ইচ্ছা তাই নিয়ে আলোচনা করতে পারি, যা ইচ্ছা তাই পরিধান করতে পারি, যতো ইচ্ছা অ্যালকোহল পান করতে পারি।

তবে আমার উপলব্ধি এটি শুধু তাদের নিজের বাড়িতেই সীমাবদ্ধ। লোলিটা উপন্যাসের শেষ অংশে হামবার্ট কুইলটিকে হত্যা করে এবং গাড়িযোগে অপরাধ সংঘটন স্থান থেকে পালিয়ে যায়। পাঠক ভালোভাবেই জানতে পারে, হঠাৎ করেই হামবার্ট তার গাড়িটি দ্রুত বাম লেনে মোড় নেওয়ায়। ভুল বোঝাবুঝির অসঙ্গতিতে হামবার্ট পাঠকদের বিদ্রোহের প্রতীকী ইঙ্গিত হিসেবে বিষয়টিকে দেখার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে। কিন্তু সে এসবের আগেই একটি মেয়েকে ভ্রষ্ট হতে প্রলোভিত করেছে।

যে কিনা নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে। তারপর সে একটি খুন করেছে। মোট কথা সে মানবতার বড় নিয়মটি অমান্য করেছে। এসব কিছুই হামবার্টের গল্পে গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছিল। উপন্যাসটি এভাবেই স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিল।

উপন্যাসের একেবারে শুরু থেকেই আমরা নিঃসঙ্গ অপরাধের বিষয়টি শেয়ার করতে পেরেছি। তেহরানের শেষ প্রান্তে কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে আমদের চালকটি শর্টকার্ট রাস্তাটিই গ্রহণ করেছিল। সে ভুল একটি লেনে গাড়িটিকে চালনা করেছিল। শেষে কোন রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই গাড়িটিকে মোড় নেয়াতে পেরেছিল। এমনটি আমি নিজেও যুবক বয়সে ইস্তাম্বুলে বহুবার করেছিলাম।

আমরা দুজনেই উপলব্ধি করলাম, নিয়ম ভাঙার মধ্যের অন্যরকম একটি বিষয় রয়েছে। নিজেদের চাতুর্যের কথা মনে করে পরস্পর হাসি বিনিময় না করে পারলাম না। দুঃখের বিষয় হলো-জনসমক্ষে আমরা তখনই আইন ভাঙতে পারি যখন আমরা গাড়ির চাকার একেবারে সামনে পড়ে যাই। তখন যে আইন আমরা ভাঙছি সেটাওতো নির্ধারিত ট্রাফিক ব্যবস্থারই আইন। তাছাড়া তো অন্য কিছু নয়।

অনুবাদ : একরামুল হক শামীম

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.