আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ইরানবেলা-৩ (ইরান-সউদি দ্বন্দ্বে চিড়ে-চ্যাপ্টা ঈদ)

আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে

৮০র দশকের শেষদিকের কথা বলছি , আমার বয়স তখন ৫/৬ , কিন্তু আপনাদের এখন রীতিমত পন্ডিতি অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিব । ইরানীদের সাথে আরবদের দ্বন্দ্ব ২০০০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে । ৮০ এর দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের কারণে আরব-ইরান সম্পর্কে জটিল মেরুকরণ হতে থাকে । আরবদের বেলায় ইরানের পররাষ্ট্রনীতি ছিল শত্রুর শত্রু = বন্ধু শত্রুর বন্ধু = শত্রু ১৯৭৯ তে ইরানে বিপ্লব,আশির দশক জুড়ে ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরানের শত্রুর তালিকায় শীর্ষ তিনটি দেশের স্থান দখল করে যুক্তরাষ্ট্র , ইরাক এবং ইসরায়েল । আরব দেশগুলোর মধ্যে সিরিয়া ইরাক বিরোধী , এবং লিবিয়া মার্কিন বিরোধী, ফিলিস্তিন ইসরায়েলের বিরুদ্ধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সুবাদে হওয়ার সুবাদে দেশ তিনটি ইরানের বন্ধুতে পরিণত হয় ।

মিশর ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলায় ইরান মিশরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে । এদিকে সউদী আরব , কাতার , কুয়েত , আরব আমিরাত ইরাক কে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করার কারণে ইরানের শত্রু তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে । শেষ তালিকায় সউদী আরবকে নিয়ে ইরান বড় ধরণের বিপদে পড়ে । ইরানী হাজীদের হজ্জব্রত পালন করার জন্য ইরানকে স্উদি আরবের সাথে সম্পর্ক রেখে চলতে হয় । সউদি আরবকে শায়েস্তা করার জন্য ইরান ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে , হজ্জের সময় মক্কায় ইসরায়েলের দখলদারিত্বের প্রতিবাদে ইরান প্রতি বছর সমাবেশ আয়োজন শুরু করে ।

যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনায় সৌদি আরবের উপর অসন্তুষ্ট হলে সউদী কতৃপক্ষ কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৭ সালে হাজ্জ মওসুমে মক্কায় ইসরায়েল বিরোধি সমাবেশে সউদি নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে ৪০২ জন ইরানী হাজি প্রাণ হারায় । ইরান সউদি আরবের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং হাজি প্রেরণ বন্ধ ঘোষনা করে । ১৯৯২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিরোধের মাশুল দিতে হয় রমজানের রোজা এবং ঈদুল ফিতর কে। ভৌগলিক ভাবে ইরান সউদি আরবের ঠিক উত্তরে হওয়ায় একই দিনে রোজা শুরু হওয়ার কথা ,প্রকাশ্যে না হলেও ইরান সাউদিদের সাথে একই দিনে ঈদ পালন থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয় ।

এই পাচ বছরে ইরানের রমজান ও ঈদ নিয়ে অদ্ভূত ঘটনা ঘটতে থাকে । প্রতি বছর ইরান নিজেদের দেখা চাদের উপর নির্ভর না করে , সউদিদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে থাকে । ১৯৯০ সালে শাবান মাসের ২৯ তারিখে চাদ না দেখা গেলেও ইরান চাষ দেখা এবং রোজা শুরুর ঘোষণা দেয় । ঈদের তারিখ ঘোষণা করা হয় ঠিক ৩০ দিন পর । কিন্তু সউদি আরবে ২৯ রোজা শেষে চাদ দেখা গেলে ইরান সউদির ঈদ একই দিনে পড়ে যায় ।

আরো একদিন পেছাতে গেলে ৩১ রোজা করতে হয় বলে সিদ্ধান্ত বদলানো সম্ভব হয়নি। পরের বছর থেকে ইরান দেরি করে রোজা ও ঈদ করার পরিকল্পনা করে । আমাদের প্রদেশটি সুন্নি প্রধান হওয়ায় ঈদ নিয়ে শিয়াদের সাথে মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে । ১৯৯০ থেকে ৯৩ এর মধ্যে প্রতি বছরই সুন্নিদের অনেকেই সারা দেশের চাইতে একদিন আগে ঈদ পালন করতে থাকেন । ফলে তাদের রমজান প্রতি বছর ২৯ দিনে হতে থাকে (আমরা সহ বেশির ভাগ ৯০এর মত মজার ঘটনার অপেক্ষায় থাকতাম)।

ঘটনাটি আবার ঘটে ১৯৯২ সালে । এবছর ইরানে সউদি আরব থেকে একদিন পর রোজা শুরু করা হয়। কিন্তু ২৯ রোজা হয়ে যাওয়ার পর প্রায় সারাদেশেই পরিস্কার বড় চাদ দেখা যায় (প্রকৃতপক্ষে তখন ৩০ রোজা হয়ে গেছে)। রাতে কোন সিদ্ধান্ত না আসায় , আমাদের পরিবার ও আরেকটি বাংলাদেশি পরিবার ঈদ উদযাপনের জন্য একটি মাইক্রোবাসে করে ৩০ তম রোজার দিন ভোরে ইরাক সীমান্তের কাছাকাছি "তাজাবাদে"এক ডাক্তার আংকেলের বাসায় রওনা হই ,সকাল ৮ টার দিকে রেডিওতে ঈদ উদযাপনের ঘোষণা আসতে থাকে । বুঝতে বাকি থাকে না , রাতভর সরকারের নীতি নির্ধারক মহলে ব্যপক বিতন্ডা শেষে সউদি আরবের আনন্দের দিনে ইরানও আনন্দে শরীক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ..............সকাল ৯ টার দিকে তাজাবাদ পৌছানোর পর ঈদের জামাতে শরিক হই ।

১৯৯২ সালে সাউদি আরবের সংগে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে ঈদ রাজনীতির প্রভাব কমতে শুরু করে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।