আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুয়ালালামপুরের পথে

কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্‌ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ সিংগাপুর থেকে বাসে করে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । সিংগাপুর-মালয়েশিয়া বাসষ্ট্যান্ড বেশ বড় এলাকা জুড়ে ।

এখানে আরামদায়ক সুপরিসর বাসে করে যাত্রীরা সিংগাপুর মালয়েশিয়া যাতায়াত করে । শুরুতেই একটা ঝামেলাতে পড়ে গিয়েছিলাম যা সিংগাপুরের মত সুশৃংখল দেশে কেউ আশা করে না । যথারীতি ট্যাক্সি নিয়ে বাস ষ্ট্যান্ডে এলাম, আসার পথে ট্যাক্সি ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল কবে এসেছি । ড্রাইভার চাইনিজ বংশোদ্ভুত । আমাকে দেখেই বুঝল বিদেশী ।

আমি বল্লাম সপ্তাহ খানেক হলো এখানে এসেছি । লোকটা কিছু বলল না । ট্যাক্সি যখন বাসষ্ট্যান্ডে আসল তখন হঠাৎ করে দুই ডলার এর কিছু বেশী ভাড়া মিটারে উঠল তারপর দেখি সে একটা বাটন টিপে ছয় ডলার করে দিয়েছে । আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি ব্যাপার সে আমতা আমতা করে বলল এই টাকা দিতে হবে । পার্কিং না কি যেন আছে ।

আমি মোটামুটি সংরক্ষিত এলাকার আলাদা ফি সম্বন্ধে জানি এবং এটা সেই জোনে না। তাই বললাম আমি আগের টাকাই দিব । সে চেঁচামেচি করার চেষ্টা করছিল । আমি তখন পুলিশকে ব্যাপারটা জানাবো বললাম । বাইরে তাকিয়ে দেখি রাত জাগা চাইনিজ অনেক গুলো শ্রমিক ও ড্রাইভার আসছে ।

ভাবভংগী ভাল না । টুরিষ্ট ও পুলিশ এর কথা বলায় ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল ৪ ডলার দিতেই হবে। আমি তা দিয়ে বের হলাম। বিদেশে ফ্যাসাদ বাড়াতে চাইলাম না। যাক বাস ষ্ট্যান্ডে মালয়েশিয়া গামী অনেক কোম্পানীর বাস এর টিকেট কাউন্টার ।

মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারে কারো সাথে কনসাল্ট করিনি আগে । ইচ্ছা ছিল ট্রেনে যাব মালয়েশিয়া । সিংগাপুর ট্রেন জার্নি নাকি বেশ চমৎকার। ষ্টেশনে গিয়ে শুনলাম সামনে ছুটি থাকায় ১৫ দিনের মধ্যে কোন টিকেট নাই। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এখানে আসা ।

ছবি দেখে সব বাসই একরকম মনে হলো । ২৫ সিংগাপুর ডলার দিয়ে টিকেট কিনলাম পরে রাতে যখন মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য বাস ষ্ট্যান্ডে এলাম তখন বুঝলাম আরো ভাল বাসও আছে । আবার ট্যাক্সিতে করে ফিরে এলাম এবার কোন সমস্যা হলো না । রাত সাড়ে এগারোটায় বাস ছাড়ার সময়। আগেই বাস ষ্ট্যান্ডে পৌছে গেছি লোকজন আসছে।

বাস মেইটেনেন্স হচ্ছে, আগে উঠার নিয়ম নেই । সব যাত্রীরা দাড়িয়ে আছে । হঠাৎ একজন শিখ এর সাথে দেখা । কথা বলতে এগিয়ে আস। সে সিংগাপুর এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার পাইলট ।

সামনে দুই দিন ছুটি তাই মালয়েশিয়ার জহুর বারো শহরে যাচ্ছে ছুটি কাটাতে । সিংগাপুরের নাগরিক তবে ভারতীয় বংশোদভুত জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই সিংগাপুরেই । সিংগাপুরের অনেক নাগরিকের মালয়েশিয়াতে থাকার ব্যবস্থা আছে এবং অনেকের পরিবার পরিজন মালয়েশিয়া থাকে এবং সপ্তাহ শেষে সিংগাপুর থেকে তারা পরিবারের কাছে ফিরে যায় । এর কারন হিসেবে বলল, সিংগাপুরে জীবনযাত্রা বেশ ব্যয়বহুল । তাই মালয়েশিয়াতে দুই দিন সস্তায় কাটিয়ে আবার কাজে যোগ দেবে ।

বেশ ভালই আইডিয়া মনে হলো । মানুষ কতভাবে যে প্রতিকুলতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয় । দুই জায়গায় এভাবে পরিবার সামলানো ব্যয়বহুল কিনা জিজ্ঞাসা করায় সে বলল যে সিংগাপুরে একজায়গায় তাদের রাখার চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী । সময় মত বাস ছেড়ে দিল । দুই জন ড্রাইভার, একুশ সিটের বাস, প্লেনের মত একদিকে দুইটা ও অন্যদিকে একটা সিট এক সারিতে ।

সিটকে শোয়ার মত করে হেলানো যায় এবং ঘুমিয়ে এই ভ্রমণ শেষ করার আরাম দায়ক ব্যবস্থা । এসিবাস, আরাম দায়ক ভ্রমণ, বাস চলা শুরু করল । সিংগাপুরের বুক চিরে বাস চলছে । মালাক্কা প্রনালীতে দুই দেশের ইমিগ্রেশন চেক হয় । সিংগাপুর বা মালয়েশিয়ার নাগরিকদের তেমন ঝামেলা নেই ।

বাস থেকে যাত্রীদের এপারে নামিয়ে দেয়া হলো । ইমিগ্রেশন পার হয়ে ওপারে আবার বাসে উঠতে হবে। বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখে ইমিগ্রেশন অফিসার অবাক হয়ে চেহারা ও বেশভুষা দেখল । ভিসা চেক করার কাজে ব্যস্ত হয়ে বলল ভিসা ফির রিসিট কোথায় । ভাগ্য ভাল তা ছিল ।

কি বিব্রতকর অবস্থা । এরা বাংলাদেশী শ্রমিক দেখে দেখে দেশ সম্বন্ধে ভুল ধারণা করে বসে আছে । বাংলাদেশের পর্যটক তারা হয়ত আশা করে না । যাক সিল দিল এন্ট্রির । এক মাসের ভিসার মেয়াদ কমিয়ে সাত দিন করে দিল ।

যাক আমিও দুই তিন দিনের বেশী থাকব না এখানে হেটে বেশ দুরে বাস ষ্টপেজ এ গেলাম । বাসটা আমাদের মত দু’চার জন বিদেশীদের জন্যই অপেক্ষা করছিল । আমরা এখন মালয়েশিয়ার জহুর বারো স্টেটএ । বাস ছেড়ে দিল । দুই ঘন্টার মধ্যে বাস থামবে ড্রাইভার বদলীর জন্য ।

বাসের পেছনে ড্রাইভার একজন বিশ্রাম করছিল । পাম বাগানের ভেতর দিয়ে পিচঢালা রাস্তা। লোকালয় থেকে বহু দুরে অরণ্যের মত এলাকা। কোন জনমানব বা বাড়ী ঘরের আলো নেই । বাস যথারীতি থামল একটা পার্কিং এরিয়ায় এখানকার হাইওয়েতে এ ধরণের ব্যবস্থা আছে ।

হাইওয়ে ্েথকে একটু দুরে রাস্তা দিয়ে এ ধরনের রেষ্ট এরিয়াতে যাওয়া যায় । এখানে খাবার, টুকটাক জিনিষ, গোসল ও টয়লেটের ব্যবস্থা আছে । সিংগাপুরের মত পরিষ্কার না একটু ময়লা ও অপরিচ্ছন্ন । বাথরুমে গিয়ে টিকেট কেটে ফ্রেস হলাম । আধা ঘন্টার বিরতি, ড্রিংস কিনলাম কোক একটা ,তারপর নতুন ড্রাইভার।

আবার হাইওয়েতে বাস উঠে ছুটে চলল কুয়ালালামপুরের পথে । শেষ রাতের দিকে বাস আবারও থামল এরকম একটা জায়গায় এ জায়গা গুলো বাগানের মত সাজানো গোছানো । এবার আর নামা হলো না । দ্বিতীয় যাত্রা বিরতির পর বাস চলতে থাকল সকাল বেলায় ফজরের আযান শুনতে শুনতে আমরা কুয়ালালামপুর-সিংগাপুর বাস ষ্টেশনে চলে এলাম । এখানে বহুতল পার্কিং এ বাস গুলো এসে প্রবেশ করছে ধোয়া ও গ্যাসের এক মিশ্র বাতাস ।

বাস থেকে নেমে ট্যাক্সি নিতে বাইরে এলাম , ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম হোটেলে যাব । আমাদের নিয়ে কিছুক্ষণ পর জালান মসজিদ ইন্ডিয়া রোডে একটা হোটেলের সামনে নিয়ে এলো । ড্রাইভার নেমে বলল সিট নেই হোটেলে। কাছে আরও একটা হোটেল সেখানে থাকার ব্যবস্থা হলো। ভোর ও চোখে ঘুম বলে আর কিছু না দেখে হোটেলে চলে এলাম ।

ভাড়া ১০০ রিংগিত । ট্যাক্সি ড্রাইভারকেও অনেক টাকা দিতে হলো । হোটেলে এসে ঘুম দিলাম । সকাল ১০ টার দিকে উঠে নাস্তা করতে বের হলাম । জালান মসজিদ এলাকায় অনেক ভারতীয় থাকে ।

পরোটা ডিম দিয়ে ভালই নাস্তা হলো । তারপর ঘুরতে বের হলাম কুয়ালালামপুর শহর। মালয়ী,ভারতীয়,বাংগালী বিভিন্ন ধরনের মানুষের মিশন রাস্তায় । দোকান পাট একটু উন্নত মনে হলো। আমাদের তুলনায় মানুষ তেমন কম মনে হলো না ।

অবশ্য এদের অনেক ফাঁকা জায়গা। জনসংখ্যাও অনেক কম বাংলাদেশ থেকে । প্রসিদ্ধ স্থান গুলো দেখতে বের হলাম, বাসে করে যাত্রা শুরু । আমাদের এক ছোট ভাই মালয়েশিয়াতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। সে বেশ দেশপ্রেমিক ও আন্তরিক ।

আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো। ফোন করে তাকে হোটেলের ঠিকানা দেয়াতে সে এখানে চলে এলো। আমাদের হোটেলটাও বেশ ভাল । বাথটাব ও উন্নত মানের ফিটিংস, অন্যান্য সব আরাম এর ব্যবস্থা আছে । লোকাল বাসের টিকেট কেটে শহর দেখতে বের হলাম ।

হায়রে এটাও তখনকার বাংলাদেশের মুড়ির টিন টাইপ বাস । বাংলাদেশের বাসের মান তখন একটু একটু ভাল হচ্ছিল। এখানে এধরনের বাসও প্রচুর । ঠেলাঠেলি, ভিড়, গরম, ধাক্কা সব মিলিয়ে ভাবলাম আর বাসে চড়া যাবে না । মারদেকা স্কোয়ার দেখলাম ।

বাস থেকে এখানে নেমে গেলাম । অনেক লোকজন বসে আছে এখানে । সুন্দর খোলা মাঠ । মারদেকা স্কোয়ার কুয়ালালামপুরে সুলতান আব্দুস সামাদ বিল্ডিং এর সামনে অবস্থিত সবুজ মাঠ । এই জায়গাতে ১৯৫৭ সালের আগস্ট মাসের ৩১ তারিখে ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা নামিয়ে স্বাধীন মালয়েশিয়ার পতাকা উঠানো হয়।

এখানে মালয়েশিয়ার জাতীয় দিবস কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় । এটাকে স্বাধীনতা চত্বর ও বলা হয় । এখানে বিকাল বেলা বহু মানুষের সমাগম হয়, বসে গল্প করে মানুষ এই খোলা জায়গাটিতে সময় কাটায় । এরপর সুভ্যেনির কিনতে গেলাম । আব্দুল্লাহ আমাকে বিশাল একটা মার্কেটে নিয়ে এলো ।

এখানে রিজনেবল দামে এ ধরনের স্যুভেনির পাওয়া যায় । মালয়েশিয়া লিখা সুন্দর সুন্দর কিছু শোপিস কিনলাম । বিকেলের দিকে আবার হোটেলের কাছাকাছি চলে এলাম । হোটেলের খুব কাছে বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ২/৩ তলা, সবই পাওয়া যায় ।

এসি মার্কেট, হোটেলের পাশেও স্পোর্টস এর দোকান। বাচ্চাদের জন্য কিছু সাঁতারের উপকরণ কিনলাম । টেনিস র‌্যাকেটটা কেনার ইচ্ছা ছিল কেন যেন কিনিনি । দুপুরে লাঞ্চ করলাম ভারতীয় এক দোকানে , ফল খেলাম তারপর । সন্ধ্যাবেলা আব্দুল্লাহ দাওয়াত দিল ডিনারের ।

বিকেলে হোটেলে এসে ফ্রেস হয়ে সন্ধ্যার প্রস্তুতি নিলাম । মাগরেবের পর আমরা খেতে বের হলাম । আমাদেরকে মালয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার খেতে নিয়ে গেল, খোলামেলা হোটেল। উপরে ছনের ছাউনি। চারপাশ খোলা, বাঁশের তৈরী বিশাল একতলা ঘরে সুন্দর খাওয়ার ব্যবস্থা ।

মালয়েশিয়ার খাবার এর অর্ডার দেয়া হলো । একটা একটা করে আইটেম আসে পরে দেখি শেষই হতে চায় না । বেশ ভুরিভোজন হলো । তবে বাংলাদেশী জিহ্বা বিদেশী খাবার এর চেয়ে দেশী জিনিষ বেশী পছন্দ করে । খাবার শেষে রাতের কুয়ালালামপুর দেখতে বের হলাম ।

রাস্তাগুলো সুন্দর ভাবে তৈরী ষ্ট্রাটলাইট আলোকিত করে রেখেছে আশপাশ। মানুষ তেমন নেই, রাস্তায় গাড়ী গুলো ছুটছে এর মধ্যে প্রায় অনেকাংশ এদেশে তৈরী। মালয়েশিয়া অনেকখানি এগিয়ে গেছে। পরদিন সকালের প্রোগ্রাম ঠিক করল আব্দুল্লাহ। জেন্টিং হাইল্যান্ড ভ্রমণের টিকেট সে কিনে আনল।

ভোর ৬টার দিকে বাসে করে সেখানে যেতে হবে । ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।