সুখি হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় বিবেক হীন হওয়া।
কোন এক অদৃশ্য কারনে মানুষের জন্মদিন আর বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার কেন যেন উপস্থিত থাকা হয় না। ব্যাপারটি মোটেও ইচ্ছাকৃত নয়। অনেককে কথা দিয়েও আমি শেষ পর্যন্ত কথা রাখতে পারি না। দেখা যায় ওই দিনই অফিসের অথবা ব্যক্তিগত কোন ঝামেলা এসে বাগড়া দিয়ে আমার সব প্ল্যান এলোমেলো করে দেয়।
তাই আজকাল কাউকে আর কথা দিইনা এ ব্যাপারে। এ পর্যন্ত আমি হাতে গোনা চার পাঁচটা বিয়েতে এটেন্ড করেছি। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে আমার এটেণ্ড করা বিয়ে গুলির পরিনতি খুব একটা সুখকর হয়নি। বিষয়টা মাঝে মাঝে আমাকে যথেষ্ট ভাবায়। এমনকি নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানেও আমাকে কিছুটা ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
এ কারনে তসলিমা নাসরিনের লেখা একটা চিঠি আমার ভীষণ প্রিয়। ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অপারগতার কথা জানিয়ে লেখা সে চিঠির শুরুটা ছিল এ রকমঃ
প্রিয় অহনা
আমার আসবার কোন অবস্থা নেই। আসবই বা কেন? পোড়ামুখী, অপয়া আর অলু ক্ষুনে মেয়েদের তো মানুষের জন্ম, মৃত্যু আর বিয়েতে থাকতে নেই। থাকলে অমঙ্গল হয়।
আমার নিজের মধ্যে কোন কুসংস্কার নেই।
কিন্তু সম্প্রতি আমার এটেণ্ড করা একটি বিয়ের পরিণতি দেখে আজকাল নিজেকে ও বড্ড অপয়া বলে মনে হয়।
ঘটনাটা বছর দুয়েক আগের। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে অবকাশ যাপন করছিলাম। এর মধ্যে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিয়ের দাওয়াত পেলাম। বিকেল বেলার আড্ডায় বন্ধুটির চোখে মুখে হবু বউকে নিয়ে মুগ্ধতার আভা দেখে বেশ ভাল লাগল।
যাক অবশেষে সে খুঁজে পেয়েছে তার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যাকে। উল্লেখ্য, সে এ পর্যন্ত ঘটা করে অনেক পাত্রী দেখলেও যুতসই পাত্রী খুঁজে পাচ্ছিলো না। অবিবাহিত কয়েকজন বন্ধু মজা করে বলত - দোস্ত, তুই এভাবে সব পাত্রী দেখে ফেললে তো আমাদের জন্য আর ফ্রেশ কোন পাত্রী এলাকায় থাকবে না রে।
শুনে মুচকি হাসত সে।
বিয়ের আর বেশি দিন বাকি নেই।
বন্ধুটির বিয়ের সব কেনা কাটা ও প্রায় শেষ। দেখলাম হবু বউয়ের জন্য সে নতুন মোবাইল কিনে ফেলেছে। ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল গিফট আর কি। আমার সামনে সে হবু বউকে প্রায়ই ফোন দিয়ে বিভিন্ন রকম গল্প করত; বিয়ের পর এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, ওটা করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বলতাম- কিরে শালা, জীবনে তো প্রেম কপালে জুটে নাই।
এখন হবু বউয়ের সাথে প্রেমালাপ করে দুধের সাধ ঘোলে মেটাচ্ছিস? সে কপট রাগ দেখিয়ে বলত, শালা তোমরা কি কম করেছ? ভুলে গেছি মনে করেছ সব? তখন মনে পড়ল আমার নিজের কথা। আমি তো হবু বউ কে নিয়ে সংসদ ভবন আর চন্দ্রিমা উদ্যানে ডেটিংও করেছি। সে এক বিরাট ইতিহাস, বলা যাবে না। তাই বন্ধুটির এ ফোনালাপ ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হল।
নির্দিষ্ট দিনে একটা মাইক্রোবাস সহযোগে আমরা যাত্রা করলাম পাত্রীর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
আমাদের সাথে রয়েছেন বন্ধুর বাবা, ছোট দুই ভাই, বড় বোন আর দুলা ভাই। পাত্রীর বাড়ি আমাদের পার্শ্ববর্তী থানায়। ওই এলাকায় আমার ইতিপূর্বে যাওয়া হয়ে উঠেনি। তাই নতুন জায়গা দেখার একটা আগ্রহবোধ ও ছিল আমার। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা জার্নির পর ও রাস্তা দেখি আর শেষ হয়না।
আর রাস্তা ঘাটের ভঙ্গুর দশা টের পেতে লাগলাম গাড়ির ভেতরে ভয়াবহ ঝাঁকুনি খেতে খেতে। মনে মনে বন্ধুকে অভিসম্পাত করলাম- ব্যাটা, বিয়ে করার আর জায়গা পেলিনা। এত দূরের গ্রামে শহরের কেউ আজকাল বিয়ে করতে আসে?
গাড়িতে বসে ওদের কথা বার্তায় বিয়ের প্ল্যান প্রোগ্রামের কোন আগা মাথা খুঁজে পেলাম না। আমাকে বলল ওর বাবা আজকে প্রথম দেখবে পাত্রীকে। বাবার যদি পাত্রী পছন্দ হয় তবে আজ শুধু কাবিন হবে।
বাকি আনুষ্ঠানিকতা হবে পরে। এ কথা শুনে বিয়ে কি বন্ধুর না বন্ধুর বাবার এ নিয়ে কিঞ্চিত সন্দেহের উদ্রেক হল আমার মনে।
যা হোক, অবশেষে বিকাল নাগাদ আমরা পৌঁছুলাম কনের বাড়িতে। সদ্য নির্মিত একতলা এক বাড়ি। বাড়ির এখানে সেখানে পড়ে আছে ইট, পাথর, সিমেন্ট।
বাইরে প্যান্ডেল টাঙ্গানো হয়েছে। আমি বাড়ির আশে পাশে ঘুরে বেড়ালাম। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে দেখলাম এখনো ভেতরে প্লাস্টার করা বাকি। বাড়ির এ অবস্থায় বিয়ের আয়োজন আমার কাছে একটু খটকা লাগল। গ্রামের মানুষ সাধারণত বাড়ির নির্মাণ কাজ ফেলে বিয়ের কাজে হাত দেয় না।
কনের বাবা স্থানীয় স্কুল শিক্ষক। পেশা বিবেচনায় আনলে অবশ্যই তিনি পরম শ্রদ্ধার পাত্র হওয়ার কথা। কিন্তু তাকে দেখে , তার কথা বার্তা শুনে মনে বিন্দু মাত্র শ্রদ্ধা জাগল না আমার। তাকে ভিলেজ পলিটিশিয়ান বলেই মনে হয়েছে।
বন্ধুর বাবা কনে দেখার পর সায় দিলেন বিয়ের।
কাজি রেডি ছিলেন। তাই বিয়ে পড়াতে বেশি বিলম্ব হল না। খাওয়া দাওয়ার পর বাকি আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারে আলাপ আলোচনা শুরু হল। কনে পক্ষ চাইল জামাই আজ থেকে যাক তাদের বাড়ি। কিন্তু বরপক্ষের মুরুব্বীগন বললেন – নাহ, আজ তারা বরকে নিয়ে ফিরে যাবেন।
বর থাকার প্রিপারেশন নিয়ে আসে নাই। আলাপ আলোচনা করে তারা পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতার দিন তারিখ ঠিক করে ফেললেন। এ দিকে আমার বন্ধুটি তো দেখি হবু পত্নীকে নিয়ে মশগুল। আমি অন্দর মহলে ঢুকে পড়লাম বন্ধুটির কার্যকলাপ দেখতে। দেখলাম, নতুন মোবাইল নব বধুর হাতে তুলে দিয়ে সে বলছে - ঘন ঘন ফোন দিবা কেমন।
আমি তাকে এক প্রকার জোর করে উঠিয়ে নিয়ে আসলাম। বললাম- বাছাধন, আজকে চল, সামনে অনেক সময় পাবে। সবার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসলাম আমরা।
তিন চারদিন পর দেখি বন্ধুর মুখ বেশ ভার। জিজ্ঞেস করলাম- কিরে বিরহে কাতর হয়ে পড়েছিস নাকি? মুখ এত শুকনো শুকনো লাগছে কেন? এর জবাবে বন্ধুটি যা শুনাল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
সে যা বলল তার সারমর্ম এ রকমঃ
বিয়ের পরদিনই একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে তার কাছে ফোন আসে। এক লোক ওই মেয়েটির স্বামী বলে দাবী করে নিজেকে। প্রেমের বিয়ে বিধায় অভিভাবককে না জানিয়ে তারা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছে। এর যাবতীয় প্রমাণ তার কাছে আছে। চাইলে সে কাবিন নামা দেখাতে পারবে।
ছেলেটির দাবি , কয়দিন ধরে অজ্ঞাত কারনে মেয়েটি তাকে এড়িয়ে চলেছে। বিয়ের দিন কেন আসেন নি জানতে চাওয়া হলে ছেলেটি বলে, মেয়ের বাবা এলাকায় রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী। তাই জীবন নাশের ভয়ে সে আসার সাহস করেনি। অনেক কষ্টে সে বন্ধুর নাম্বার জোগাড় করে তবেই ফোন দিয়েছে।
ঘটনাটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হল।
এ ও কি সম্ভব! ছেলে মানুষের প্রথম বিয়ে গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনেছি। কিন্তু কোন মেয়ে মানুষ এ ধরণের ঘটনা ঘটাতে পারে এটা ছিল আমার ধারণার ও অতীত। এ কেমন অভিভাবক? মেয়ে বিবাহিত জেনেও আবার প্রতারণা মূলক বিবাহের আয়োজন করে কোন আক্কেলে কিছুতেই বোধগম্য হলনা আমার কাছে। আর মেয়েটিই বা কেমন? সে তো ব্যাপারটি জানাতে পারতো আমাদের। এ মেয়ে কিভাবে এত চমৎকার অভিনয় করে গেল এত দিন ভেবে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই আমি।
মেয়েকে ফোন করে এ ব্যাপারে আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করলে সে পুরোপুরি অস্বীকার করে সব। উল্টো বন্ধুকে ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইল করার চেষ্টা করে। বলে- তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না? আমার উপর ভরসা রাখ। ওই ছেলের কথায় কান দিও না।
আমার ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ঢাকা চলে আসি।
পরে জানতে পারি সব ঘটনা সত্যি। বন্ধুটিকে প্রতারণা মূলক মামলা ঠুকে দিতে পরামর্শ দিই। কিন্তু বন্ধু বলে সে এক আইনজীবীর সাথে কথা বলেছে। মুসলিম বিবাহ আইনে নাকি নারীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তাই মেয়েটিকে ডিভোর্স দিতে হবে তাকে।
সাথে দেন মোহর ও পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে বড্ড অযৌক্তিক মনে হল, যে বিয়ের কোন বৈধতাই নেই তার জন্য কেন আবার দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। আইনের অতসব মার প্যাঁচ বোঝা সত্যি কঠিন। মুসলিম বিবাহ আইন কিভাবে এ বিয়ের বৈধতা দেয়, নাকি আইনজীবী ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছে বিষয়টি আমার কাছে আজও রহস্য হয়েই থাকল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।