আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আরবীয় ধর্মবিশ্বাস অন্ধকার থেকে দীনের আলোকে

আমি আঁধারে তামাসায় ঘেরা জীবন দেখেছি, আমার বুকের ভেতর শূন্যতা থেকে শূন্যরা এসে বাসা বেঁধেছে, আমি খুঁজেছি তোমাকে সেই আঁধারে আমার মনের যত রঙলীলা; আজ সাঙ্গ হতেছে এই ভবের বাজারে। নাসর বা শকুন এবং আওফ বা বড় পাখি এর মত নিকৃষ্ট ধর্মের অন্যান্য দেবতাগুলিও প্রাণীর নাম বহন করে এবং তা স্বাভাবিকভাবেই টোটেম জাতীয় উৎসবের কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। আনন্দবাদী সেসময়ের আরবিয়রা জীবনের আশু বিষয়গুলোতে এমনভাবে মগ্ন হয়েছিল যে অন্য বিষয়ে তারা বিশেষ চিন্তা করতে পারেনি। এ ব্যাপারে একজন চারনকবি গেয়েছেন ; আমরা চরকা কাটি এবং জীবনের পথে পথে ঘুরে বেড়াই তারপর, ধনী ও দরিদ্র সকলেই অবশেষে বিশ্রাম নিই মাটির নীচে স্লেট – পাথরে ঢাকা ফাঁকা গহবরে আমরা বাস করি। জাহিলিয়া যুগের বেদুঈন উপজাতির ধর্ম বলে প্রায় কিছুই ছিলনা।

আরবে একটি গল্প প্রচলিত আছে যে ইমরু-আল-কায়িস নামে এক বেদুঈন তার বাবার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবার জন্য পথে বেড়িয়ে তিনি তীর এঁকে দৈব শক্তির সঙ্গে আলোচনা করার জন্য জু-আল-খালাসা নামক মন্দিরে থেমেছিলেন। বারতিনেক আকার চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে তিনি ভাঙা তীরগুলি দেবমূর্তির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, “ হতভাগা তোমার বাবাকে যদি হত্যা করা হত তাহলে তুমি আমাকে প্রতিশোধ নিতে বারণ করতে না “ বেদুঈনদের ধর্ম বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে সেমেটিক ধর্মমতের সবচেয়ে প্রাচীন ও আদিম রূপের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। নাক্ষত্রিক বৈশিষ্ট্য , অতিমাত্রায় সজ্জিত মন্দির, ব্যাপক ধর্মীয় আচার – অনুষ্ঠান ও দেব – দেবীর উদ্দেশ্যে বলি – সমন্বিত আরব সংস্কৃতি ছিল প্রধান ধর্মীয় চিন্তাধারার সূচক। পেটরা ও পালমিরা সম্প্রদায়ের মধ্যে সূর্য পূজার ওপর গুরুত্ত দেয়া হত। সে সময় ধর্ম বিশ্বাস ছিল মূলত সর্বপ্রাণবাদমূলক।

চাষ যোগ্য জমির উর্বরতার জন্য যে দেবতার ভূমিকা ছিল, তাকে তারা উপকারী দেবতা মনে করে পূজা করত; পক্ষান্তরে চাষহীন জমির জন্য দায়ী দৈব শক্তিকে তারা অপদেবতা বা শয়তান বলে গন্য করত এবং তাকে তারা ভয় করত। দেবতা সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ধারনা গড়ে ওঠার পরেও গাছ, কূপ, গুহা, পাথর ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তিগুলো তাদের কাছে পবিত্র বস্তু হয়েই রইল। সৌরজগৎ সংক্রান্ত বেদুঈন উপজাতির ধারনাটি ছিল চন্দ্রকেন্দ্রিক, কারন চাঁদের আলোতেই তারা তাদের গবাদি পশুদের তৃণক্ষেত্রে চরিয়ে বেড়াত। চাঁদের পূজা পশুপালন সমাজকে বুঝায় আর সূর্যের পূজা নির্দেশ করে পরবর্তীকালে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার স্তর। তারা মনে করত তাদের জীবন চাঁদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় আর সূর্য বেদুঈন সহ সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদকে ধ্বংস করতে চায়।

মিনাইয়ান সর্ব দেবতার মন্দিরের মাথায় চন্দ্র দেবতা ‘অয়াদ’ বিরাজ করত। তারা খেজুর গাছের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য হিসেবে অস্ত্র, পোশাক, ও কম্বল দিত এবং ওই গাছে ঝুলিয়ে দিত। মক্কার অধিবাসীরা প্রতি বছরেই জাত-আনয়াত যার উপর জিনিষ ঝুলিয়ে দেয়া হত এর কাছে যেত এবং এর সঙ্গে নাখলাতে অবস্থিত আল-উজ্জার একটি গাছের কাছে যেত উপাসনা করতে। একটি বর্গাকার পাথর আল-তাইফ এ অবস্থিত আল-লাত এর প্রতিনিধিত্ত করত। আবার চার ফুট লম্বা ও দুই ফুট চওড়া একটি অখণ্ড ও চতুর্ভুজ আকারের কাল পাথর ছিল পেটরাতে অবস্থিত জু-আল-সারার প্রতিনিধি।

এই সমস্ত দেবতাদের অধিকাংশেরই একটি করে সংরক্ষিত হিমা বা চারন ক্ষেত্র ছিল। আল-কোরআন - সূরা আন-নাজম (মক্কায় অবতীর্ণ) এর আয়াত নং ১৯ - ২০ ১৯) তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও ওযযা সম্পর্কে। ২০) এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে? আল-হিজাজের শহুরে মানুষ ও মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৭ শতাংশের মধ্যে প্রথমদিকে ধর্ম বিশ্বাস হীন আমলের নক্ষত্রকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ছিল। তিনটি দেবী আল-উজ্জা, আল-লাত ও মানাহ এর উপাসনার জায়গা ছিল সেসব অঞ্চল । আল-লাতের নিজের পবিত্র এলাকা হিমা ও হারাম ছিল আল-তাইফের কাছাকাছি এবং মক্কা ও অন্যান্য এলাকার অধিবাসীরা তীর্থ যাত্রা ও বলিদানের জন্য সেই পবিত্র অঞ্চলে জমায়েত হত।

এই ঘেরা জায়গার মধ্যে গাছ কাঁটা, শিকার করা ও মানুষের রক্তপাত ঘটান ছিল নিষিদ্ধ। ওই এলাকায় যে দেবতা ছিল সন্মানিত , উদ্ভিদ ও প্রাণী ছিল সেই দেবতার অলঙ্ঘনীয় মর্যাদার অংশবিশেষ । ইজরাইলের উদ্বাস্তুদের শহরগুলো ছিল একই উৎসে সৃষ্ট। মক্কার পূর্বদিকে অবস্থিত নাখলা ছিল আল-উজ্জার আরাধনার কেদ্র। কুরাইশদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় দেবী।

তার উপাসনার জায়গাতে তিনটি গাছ ছিল। মানুষকে বলি দেয়া ছিল তার আরাধনার অঙ্গবিশেষ। মানাহ ছিলেন ভাগ্যের দেবী এবং সেই অর্থে তিনি ছিলেন ধর্মীয় জীবনের প্রথম দিকের প্রতিনিধি। তার মুল উপাসনাস্থল ছিল একটি কাল পাথর এবং মক্কা ও ইয়াস্রিব এর মধ্যকার রাস্তার মাঝামাঝি কুদাইদ নামে একটি জায়গায়। আওস ও খাজ্রাজ উপজাতির মধ্যে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে জনপ্রিয়।

জু-আল-সারার সঙ্গে একজন স্বাধীন দেবী হিসেবে তার নাম আল-হিজর এ অবস্থিত নাবাতিয়ান শিলালিপিতে দেখতে পাওয়া যায়। যেহেতু বাবার তুলনায় মায়ের রক্তই সেমেটিক উপজাতিগুলোর মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে তুলেছিল এবং যেহেতু আদিম পরিবারগুলি ছিল মাতৃ কেন্দ্রিক তাই আরাধনার পাত্র হিসেবে দেবতাদের তুলনায় আরবিয় দেবীরা অনেক বেশী গুরুত্ত পেত। আল-কাবার প্রধান দেবতা হুবাল এর ছিল মানবিক রূপ এর পাশে ছিল ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তাদের ভবিষ্যৎ কথনের প্রতীকরূপে ধর্মীয় তীর এবং এই ভবিষ্যৎ বানীর মাধ্যমে তারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। নবী হযরত মোহাম্মদ (সা) যখন মক্কা বিজয় করেন তখন কাবা ঘরে রক্ষিত ৩৬০ টি দেবদেবীর সাথে হুবালের মূর্তিটি ধ্বংস করা হয়। এই কাবা ঘর ছিল আদিম সারল্যে ভরপুর ঘন আকারের একটি ঘর।

মূলত এর মাথার উপর কোন ছাদ ছিল না এবং এটি একটি কালো উল্কাপিণ্ডের আশ্রয়স্থল বলে গন্য হত। আর এই কাল উল্কাপিণ্ডকে ভক্তিযোগ্য রূপে শ্রদ্ধা করা হত। ইসলাম ধর্মের পুনরায় আবির্ভাবের পর ৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ওই কাঠামোটির পুনর্গঠন করা হয়। এর চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা অঞ্চলকে পবিত্র অঞ্চল হারাম বলে গন্য করা হয়। এখানেই হাজ্জ সংঘটিত হয় এবং কোরবানি করা হয়।

যেহেতু বেদুঈনরা তাদের পন্যের আদান-প্রদানের জন্য স্থায়ী শহরগুলিতে প্রায়ই আনাগোনা করত এবং বিশেষ করে পবিত্র যুদ্ধের সাময়িক বিরতির চার মাসে তারা শহরের অগ্রণী চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হত এবং তার ফলে তারা কাবার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এবং কোরবানি দিতে অভ্যস্ত হয়ে যেত। মক্কা ও অন্যান্য স্থানের বিভিন্ন পাথরগুলি বিশেষত যেগুলি মুরতি রূপে গন্য হত তাদের নিকট উত ও মেষ বলি দেওয়া হত। যাযাবর উপজাতির সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ ধর্মীয় অনুশীলন ছিল কোন বড় তীর্থস্থানের উদ্দেশ্যে শহরে আরব্দের তীর্থযাত্রা। পবিত্র যুদ্ধের সাময়িক বিরতির চারটি মাস মুসলিম পঞ্জিতে যথাক্রমে প্রতি বছরের একাদশ , দ্বাদশ ও প্রথম (জু-আল-কাদা, জু-আল-হিজ্জা ও মুহাররাম) এবং মধ্যভাগে চতুর্থ মাস (রাজাব) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত । প্রথম তিন মাস বিশেষভাবে ধর্মীয় আচরনের জন্য সংরক্ষিত এবং চতুর্থ মাসটি ছিল বানিজ্যের জন্য মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান।

সহজে প্রবেশ করার সুযোগ এবং উত্তর ও দক্ষিনের মধ্যে মুল মরু যাত্রীদের পথে অবস্থিত হবার ফলে আল-হিজাজ ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে অতুলনীয় সুযোগ – সুবিধা প্রদান করত। এভাবেই উকাজ মেলা ও তার পাশাপাশি কাবা ঘরের বিকাশ ঘটে। স্বর্গীয় আদিরূপের অনুকরণে নবী হযরত আদম (আঃ) এই কাবা ঘর তৈরি করেছিলেন। নবী হযরত নূহ (আঃ) এর মহাপ্লাবনের পর নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং তার পুত্র নবী হযরত ইসমাইল (আঃ) এটি পুনর্নির্মাণ করেন। এটির তত্ত্বাবধানের ভার ছিল ইসমাইল (আঃ) এর বংশধরদের হাতে যতক্ষণ না গর্বিত বানু-জুরহাম ও পরবর্তী সময়ে মূর্তিপূজার উদ্ভাবক বানু-খুজাহ এর দখল নিয়েছিলেন।

তারপর এল কুরাইশ উপজাতি তারা প্রাচীন ইসমাইলিয় আদর্শই অনুসরন করত। পুনর্নির্মাণ কাজে যখন ইব্রাহীম (আঃ) ব্যাস্ত ছিলেন তখনই ফেরেশতা জিব্রাইল (আঃ) এর কাছ থেকে ইসমাইল (আঃ) কাল পাথরটি পেয়েছিলেন। ওই কাঠামোর দক্ষিন – পূর্ব কোনে এই এখনো রক্ষিত আছে এবং হাজ্জের জন্য তিনি মহান আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে বিশেষ নির্দেশ পেয়েছিলেন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।