আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রেমচাঁদের গল্প--লটারি--শেষপর্ব

চাঁদটা গোল হলেই গোল বাধে ভেতরে...!!!

লটারি মূল: মুনশি প্রেমচাঁদ রূপান্তর(মূল হিন্দি থেকে): মোসতাকিম রাহী ..... প্রকাশ ছোটো ঠাকুরের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বললো,‘আরে কাকা, পাথর তো নয়, মনে হয় গোলা ছুঁড়ে মারছে! পালোয়ানের মতো শরীর, এক ঘুষিতে বাঘকে পর্যন্ত পরাস্ত করতে পারেন। কতো লোক যে একটা মাত্র পাথরের আঘাতে পটল তুলেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অথচ আজ পর্যন্ত কোনো মোকদ্দমাই হয় নি তুফান বাবার বিরুদ্ধে। আর বাবাও দু’-চারটে পাথর মেরেই ক্ষান্ত হন না, যতোক্ষণ না আপনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন, ততোক্ষণ মারতেই থাকবেন। আর রহস্য এই, জখম যতো বেশি হবে, লক্ষ্য হাসিলের সম্ভাবনা ততোই বাড়বে।

’ প্রকাশ এমন গল্প ফেঁদে বসলো যে, ছোটো ঠাকুর কুঁকড়ে গেলেন ভেতরে ভেতরে। তুফান বাবার আস্তানায় গিয়ে মার খাওয়ার সাহস হলো না। শেষ পর্যন্ত ভাগ্য নির্ণয়ের দিন এসেই গেলো জুলাইয়ের বিশ তারিখ। কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। আশা আর ভয়ের দোলাচলে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি নি রাতভর।

বড়ো-ছোটো দুই ঠাকুর গঙ্গাস্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিতে গেলেন। আজ আমার মনেও ভক্তি জেগে উঠলো। ভাবলাম মন্দিরে গিয়ে পূজা দিয়ে আসি। ‘হে প্রভু! তুমি অনাথের সহায়, আশ্রয়হীনের আশ্রয়, তুমি অন্তর্যামী, আমরা কতো কষ্ট করে টিকেট কিনেছি সেটা তুমি জানো প্রভু। তোমার কৃপাদৃষ্টি কি আমাদের ওপর পড়বে না প্রভু? আমাদের চেয়ে তোমার কৃপা পাওয়ার যোগ্য আর কে আছে?’ বিক্রম একেবারে সুটবুট পরে মন্দিরে হাজির।

আমাকে ইশারা করে বললো,‘আমি ডাকঘরে যাচ্ছি!’ তারপর হাওয়া হয়ে গেলো। একটু পরে প্রকাশ মিষ্টির থালা হাতে নিয়ে মন্দিরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে গরিবদের মাঝে বিলি করতে শুরুকরলো। দুই ঠাকুর তখনো ভগবানের চরণ ছুঁয়ে পড়ে আছেন। মাথা নিচু করে, চোখ বুজে একমনে প্রার্থনা করে চলেছেন। হঠাৎ বড়ো ঠাকুর মাথা তুলে পুরোহিতের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ভগবান বড়োই ভক্তবৎসল, তাই না, পুরোহিত মশাই?’ পুরোহিত সমর্থন করলেন তাঁর কথা।

বললেন,‘হ্যাঁ, বড়ো ঠাকুর, ভক্তের সুরক্ষার জন্যেই ভগবান ক্ষীরসাগর পাড়ি দিযেছেন, আর গজকে বাঁচিয়েছেন কুমিরের কবল থেকে। ’ একটু পরে মাথা তুললেন ছোটো ঠাকুর। পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভগবান তো সর্বশক্তিমান, অন্তর্যামী, সবার মনের খবর জানেন, তাই না পুরোহিত মশাই?’ পুরোহিত তাঁর কথাও সমর্থন করলেন। বললেন,‘অন্তর্যামী না হলে সবার মনের কথা কী ভাবে বুঝতে পারেন? শবরীর প্রেমের গভীরতা দেখেইতো তার মনোকামনা পূর্ণ করলেন। ’ পূজা সমাপ্ত হলো।

যখন ভজন শুরু হলো দুই ভাই মিলে জোরে জোরে ভজন গাইতে লাগলেন। বড়ো ঠাকুর দুই টাকা দান করলেন পুরোহিতের সামনে রাখা থালায়। তা দেখে ছোটো ঠাকুর দান করলেন চার টাকা। বড়ো ঠাকুর কোপনজরে কিছুক্ষণ চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তারপর পুরোহিতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,‘আপনার মন কী বলছে পুরোহিত মশাই?’ ‘ আপনার জয় সুনিশ্চিত, বড়ো ঠাকুর!’ ছোটো ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন,‘আর আমার?’ ‘আপনারও জয় হবে, ছোটো ঠাকুর!’ বড়ো ঠাকুর সশ্রদ্ধ চিত্তে ভজন গাইতে গাইতে মন্দির থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

আর তার পিছে পিছে ছোটো ঠাকুরও চললেন প্রভুর গুনগান গাইতে গাইতে। আমিও বেরিয়ে এলাম তাদের পিছুপিছু। বাইরে এসে প্রকাশ বাবুকে সাহায্য করতে চাইলাম মিঠাই বিতরণে। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘আমি একাই করতে পারবো, মাস্টার বাবু। আর বেশি তো বাকি নেই, ধন্যবাদ!’ আমি লজ্জা পেয়ে ডাকঘর অভিমুখে রওনা দিলাম।

এমন সময় দেখলাম বিক্রম হাসিমুখে সাইকেল চালিয়ে এদিকেই আসছে। তাকে দেখার সাথে সাথে সবাই যেন পাগল হয়ে গেলো। দুই ঠাকুর হামলে পড়লো তার ওপর বাজপাখির মতো। প্রকাশের থালায় তখনো অল্প মিঠাই পড়ে ছিলো, সেগুলো সহ থালাটা সে মাটিতে ফেলে দৌড়ে এলো বিক্রমের কাছে। আর আমি একফাঁকে বিক্রমকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে শুরু করলাম।

সবাই মিলে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। কিন্তু কেউ জানতে চাইছে না লটারির ফলাফল কী ! বড়ো ঠাকুর আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে বললেন, ‘জয়, রাজা রামচন্দ্রের জয়!’ ছোটো ঠাকুর আরো জোরে বললেন, ‘জয়, হনুমানের জয়!’ প্রকাশও তার ভক্তি জাহির করলো: ‘তুফান বাবার জয় হোক!’ বিক্রম সবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আলাদা আলাদা দাঁড়িয়ে বলো দেখি সবাই, যার নামে লটারি উঠবে সে আমাকে একলাখ টাকা দেবে। বলো, রাজি?’ বড়ো ঠাকুর বিক্রমের হাত ধরে বললেন, ‘আগে বল্ কার নাম উঠেছে!’ ‘জি না,’ বিক্রম জবাব দিলো। ‘আগে বলুন, আমার শর্তে সবাই রাজি?’ ছোটো ঠাকুর রেগে গিয়ে বললেন,‘শুধু নাম বলার জন্যে একলাখ? শাবাশ!’ প্রকাশও গলা চড়িয়ে বললো, ‘আমরা কি ডাকঘর চিনি না?’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে, যার যার নাম শোনার জন্যে তৈরি হয়ে যাও তবে!’ সবাই অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। ‘হুঁশ-জ্ঞান ঠিক রেখো সবাই।

’ সবাই পূর্ণ সচেতন হয়ে, কান সজাগ করে দাঁড়ালো। ‘আচ্ছা, তো মন দিয়ে শুনুন সবাই। এই শহরের মানুষের বড়ো দুর্ভাগ্য, শুধু এই শহরের নয়, সমগ্র ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য! লটারি জিতেছে আমেরিকার এক হাবশি লোক। ’ ‘মিথ্যে কথা!’ হুংকার দিয়ে উঠলেন বড়ো ঠাকুর। ‘ডাঁহা মিথ্যে কথা!’ ছোটো ঠাকুরও যোগ দিলেন তার সাথে, ‘এটা কিছুতেই সত্যি হতে পারে না।

তিনমাসের একনিষ্ঠ প্রার্থনা কিছুতেই বিফল হতে পারে না। ’ ‘হাত-মাথা ফাটিয়েছি কি এমনি এমনি, মশকরা করছিস, অ্যাঁ?’ প্রকাশের ক্ষিপ্ত উক্তি। এরকম আরো জনা পঁচিশেক লোক উদয় হলো কাঁদো-কাঁদো চেহারা নিয়ে। তারাও আসছে ডাকঘর থেকে, নিজেদের স্বপ্নের সমাধী রচনা করে। ‘নিয়ে গেছে সব লুট করে, হারামজাদা হাবশি! বদমাশ, শয়তান!’ প্রলাপ বকছে সব ক্লান্ত শ্রান্ত হতাশ মানুষ ।

বিশ্বাস না করার আর কোনো উপায় নেই। বড়ো ঠাকুর হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলেন মন্দিরের দিকে। পুরোহিতকে ডিসমিস করে দিয়ে বললেন, ‘এজন্যে এতোদিন ধরে পালছি আপনাকে? হারাম খেয়ে খেয়ে চর্বি বাড়ানোর জন্যে?’ ছোটো ঠাকুরকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার কোমর ভেঙে দিয়েছে। দু’-তিনবার কপাল চাপড়ে রাস্তার মাঝখানেই বসে পড়লেন। কিন্তু প্রকাশের অবস্থা আরো ভয়ংকর।

ক্রোধে অন্ধ হয়ে সে লাঠি হাতে ছূটে গেলো তুফান বাবার আস্তানার দিকে। আজ তুফান বাবাকেই মেরামত করা হবে। ঠাকরুন বললেন, ‘আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। নিশ্চয়ই সবাই বেঈমানী করেছে। দেব-দেবতার আর কী দোষ! তাঁরা কি অন্যদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনবেন?’ রাতে কেউ খাবার মুখে দিলো না।

আমি উদাস হয়ে বসে ছিলাম। বিক্রম এসে বললো, ‘চলো হোটেল থেকে কিছু খেয়ে আসি। আজ তো চুলা-ই জ্বলে নি ঘরে। ’ আমি বিক্রমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা তুমি যখন ডাকঘর থেকে ফিরে এলে তখন তোমাকে খুব খুশিখুশি লাগছিলো। ব্যাপারটা কী?’ ‘আমি যখন ডাকঘরের সামনে হাজার হাজার লোকের ভিড় দেখতে পেলাম, তখন আমাদের পরিবারের লোকদের বোকামির কথা ভেবে ভীষণ হাসি পেলো।

একটা শহরে যেখানে এতো লোক টিকেট কিনেছে, সারা হিন্দুস্তানে তো এর চেয়ে হাজারগুন বেশি হবে। আর সারা দুনিয়ার কথা ভাবো, লাখোগুন বেশি হবে না! আর আমি কিনা পর্বতপ্রমাণ আশা নিয়ে দৌড়ে গেলাম ডাকঘরে! যেই ফলাফল ঘোষণা করলো, আমার বিষম হাসি পেলো। এ যেন কোনো দানশীল ব্যক্তির তামাশা: একমুঠো ভাত নিয়ে যে ছড়িয়ে দিয়েছে লাখো লোকের মাঝে। আর আমাদের এখানে লোকজন কতো কিছু যে.... আমিও হেসে ফেললাম ওর কথায়। বললাম, ‘ঠিকই বলেছো, আমরা দু’জনও লেখাজোকা করে নেওয়ার জন্যে কতো না বাড়াবাড়ি করেছি! আচ্ছা, একটা কথা সত্যি করে বলো তো, তোমার নিয়ত কি আসলেই খারাপ ছিলো?’ ‘কী করবে এখন আর জেনে,’ মুচকি হেসে বললো বিক্রম।

‘রহস্যটা পরদার আড়ালেই না হয় ঢাকা থাক! শেষ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।