আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বন্যার্তদের সহায়তায় এগিয়ে আসুন

নিজের পরিবর্তন এবং দেশের পরিবর্তন

- মোজাফ্ফর আহমদ ও বদিউল আলম মজুমদার বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের বন্যাপরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী দেশের ৩৬টি জেলার ১৫৯ উপজেলার প্রায় এক কোটি মানুষ বন্যাকবলিত। প্রতিদিনই পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা এবং আক্রান্ত হচ্ছে অধিকসংখ্যক মানুষ। সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী অনেক দুর্গত এলাকা এখনো ত্রাণ কর্মসূচির বাইরে রয়ে গেছে।

যোগাযোগব্যবস্থাও বিপর্যয়ের মুখে। এর মধ্যেই মৃতের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে। অনেকের আশঙ্কা, বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং এর ভয়াবহতা ২০০৪ ও ১৯৯৮ সালের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। অতীতে যতবার এ ধরনের জাতীয় দুর্যোগ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিবারই দেশের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত তরুণ সম্প্রদায়, ছাত্রসমাজ, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি-বেসরকারি-স্বেচ্ছাব্রতী সব সংগঠন, সেনাবাহিনী একযোগে দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত।

অনেক ক্ষয়ক্ষতি, মৃত্যু, মহামারি সত্ত্বেও সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর প্রবল সংগ্রামী মনোভাবের জোরে এ জাতি সব দুর্যোগ মোকাবিলা করে কঠোর জীবনযুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। আজকের এ সংকটে অতীতের শিক্ষা নিয়ে আমরা কীভাবে একত্র হতে পারি, তা দ্রুত ভাবা প্রয়োজন। আক্রান্ত জনগোষ্ঠী এর মধ্যেই কঠোর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ। এ সংগ্রামে তাদের পাশে দাঁড়াতে আগ্রহী ব্যক্তি-গোষ্ঠী-সংস্থার সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। এই দুর্যোগে প্রতিটি ব্যক্তিমানুষেরই কিছু করণীয় রয়েছে।

জরুরি কাজগুলো চিহ্নিত করে প্রত্যেককেই সম্পৃক্ত হতে হবে সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের সঙ্গে। দুর্যোগ মোকাবিলার সব পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে−জনগণের শক্তি, সামর্থ্য ও সাহসিকতার প্রতি সশ্রদ্ধ আস্থা। আক্রান্ত জনগোষ্ঠী দুর্গত, কিন্তু করুণার পাত্র নয়। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা লালন করে চলেছে। এ আকাঙ্ক্ষাই তাদের দুর্যোগ মোকাবিলার প্রেরণা।

যাঁরা বন্ধুর মতো তাদের পাশে দাঁড়াতে চান, তাঁদের মূল কাজ সেই আকাঙ্ক্ষাকে জীবন্ত রাখা এবং শক্তিশালী করা; পাশাপাশি জীবনধারণের জরুরি সামগ্রীগুলোর সরবরাহ নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক বন্ধুদের করণীয় মূলত দ্বিতীয়টি। আমাদের প্রত্যাশা, জরুরি ভিত্তিতে তাঁরা সহযোগিতার হাত বাড়াবেন আমাদের সংগ্রামী জনগোষ্ঠীর সুদৃঢ় মনোবল আর সুতীব্র জীবনসংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। বন্যাকবলিত জনগণকে পানিবাহিত রোগ থেকে এবং শিশুদের ডায়রিয়া থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। তাদের খাদ্যের সংস্থান করা আরও জরুরি।

বর্তমানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হলো প্রয়োজনীয় তথ্যের জোগান দেওয়া। রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজ, বেসরকারি সংস্থার কর্মীসহ সবার এখন দায়িত্ব হলো বন্যাকবলিতদের জানানো, কীভাবে পানি বিশুদ্ধ করা যায় (প্রতি লিটারে একটি আয়োডিন/হ্যালোজেন ট্যাবলেট), কোথায় হ্যালোজেন/আয়োডিন ট্যাবলেট পাওয়া যায় (স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও এনজিওকর্মী) এবং প্যাকেট স্যালাইনের পরিবর্তে কীভাবে স্যালাইন তৈরি করা যায় (চার চা-চামচ চিনি, আধা চামচ লবণ এবং এক লিটার পানির মিশ্রণ) ইত্যাদি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত জরুরি তথ্য। মানুষ যদি যথাযথ তথ্য পায়, তাহলে তারাই নিজেদের করণীয় অনেকাংশে সম্পাদন করতে পারবে। বিভিন্ন মাধ্যমের প্রচারিত সংবাদ অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ-কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু প্রয়োজন আরও অনেক বেশি।

বন্যাকবলিত সব এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো জরুরি। পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ থেকে তাদের রক্ষা করা জরুরি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় কোনো কোনো অঞ্চলে ওষুধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার ও সেনাবাহিনীর একার পক্ষে এসব জরুরি কাজ করা সম্ভব নয়। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের পুরো মাত্রায় এ কাজে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।

আপৎকালে জনগণ সাধারণত তাদের প্রতিবেশী এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদেরই দ্বারস্থ হয়। তাই আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রথমেই স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় স্থানীয় সম্পদের সুষ্ঠু ও সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে; পাশাপাশি সরকারিভাবে পাওয়া সম্পদেরও সঠিক ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। বন্যার কারণে রাস্তা ভেসে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই দুর্গত এলাকায় হেলিকপ্টারের মাধ্যমে জরুরি ত্রাণ পাঠানো প্রয়োজন হতে পারে।

সম্ভাব্য সব যানবাহন ব্যবহার করে জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণসামগ্রী বন্যা-উপদ্রুত জেলাগুলোর উপজেলা সদরে পাঠানো জরুরি, যাতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার এবং অন্য স্বেচ্ছাসেবকরা উপজেলা থেকে নিয়ে তা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। সব এনজিও এবং স্বেচ্ছাব্রতী কর্মীকে এলাকাভিত্তিক সংগঠিত হয়ে পরিকল্পিত ত্রাণ-কর্মসূচি গ্রহণ ও পরিচালনা করা প্রয়োজন। ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য তাদের সম্মিলিতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করা আবশ্যক। স্থানীয় নেতৃত্ব ও জনগণের সৃজনশীল উদ্যোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের পালন করা প্রয়োজন অনুঘটকের ভূমিকা। এর ফলে সব ত্রাণ-কার্যক্রমে সমন্বয় বিরাজ করবে এবং বন্যা-উপদ্রুত সবার কাছে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পৌঁছাবে।

জাতিসংঘের সব অঙ্গসংগঠন এবং দ্বিপক্ষীয় দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সুযোগ-সুবিধা, দক্ষতা ও অবকাঠামো ব্যবহার করে জরুরি ত্রাণসামগ্রী ও ওষুধপত্র উপজেলা দলের কাছে দ্রুততার সঙ্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। বন্যাকবলিতদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ভবিষ্যতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিদ্যালয় এবং অন্যান্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে এ কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে আমরা যারা আক্রান্ত হইনি, তাদের এগিয়ে আসতে হবে; প্রদর্শন করতে হবে মানুষ হিসেবে নিজেদের দায়িত্ববোধ। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গত এলাকায় ডায়রিয়া ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগ দেখা দেবে।

এ জন্য এখন থেকেই সুবিধামতো স্থানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ‘ওআরটি কর্নার’ স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করার কাজ অবিলম্বেই শুরু করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের জন্য বীজ সরবরাহের পরিকল্পনা এ মুহূর্তেই হাতে নিতে হবে। নিষ্ঠাবান সংবাদকর্মীর অনুসন্ধিৎসা, সাহস আর পেশাগত দায়িত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনেরও এখনই সময়। তাঁদের কলম যেন এখন সোচ্চার হয় সব অব্যবস্থা, দায়িত্বহীনতা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে; একই সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবিলায় জনগণের সংগঠিত উদ্যোগের বীরোচিত সাফল্যও যেন প্রতিফলিত হয় তাঁদের লেখায়।

সচেতন নাগরিক ও বিত্তশালীদের কাছে আমাদের আহ্বান: আসুন, আমরা সবাই বানভাসি লাখো মানুষের বীরোচিত বাঁচার সংগ্রামে শরিক হই, সহমর্মিতা ও স্বেচ্ছাসেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করি; আমাদের আর্থিক সংগতিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাই। নিজ এলাকায় যাই, সাধ্যমতো সহায়তার হাত প্রসারিত করি। এ দুর্যোগ সাহসিকতার সঙ্গে কাটিয়ে ওঠা আমাদের জন্য হতে পারে পরম গর্বের বিষয়। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ: সভাপতি, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন।

গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট−বাংলাদেশ। দৈনিক প্রথম আলো' ০৭ আগষ্ট ২০০৭ তারিখে প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.