আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিতাস কোন নদীর নাম নয় - ৪র্থ পর্ব

খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।

মুসা দাদার বড় ছেলে নজরুল ইসলাম আমাদের বাড়িতে বছর বান্ধা মুনিষের কাম করে৷ সে দাদাজির সাথে সাথে থাকে, দাদাজি বাজারে গেলে সাথে বাজারে যায়, দাদাজিকে সাথে করে ক্ষেত দেখাতে নিয়ে যায় ৷ কোন ক্ষেতে কত ধান হইলো, এখনই কি কাটা হবে না আরও দুই দিন লাগবে? দাদাজি বলে একটু যেমুন কাঁচা কাঁচা লাগেও নজরুল ইসলাম৷ কাইলকার দিনডা যাউক পরশু সকালে আল্লার নাম লইয়া ধান কাডা শুরু কর৷ নজু চাচা দাদাজির সাথে জামাতে ( একসাথে) নামাজ পড়ে৷ দাদাজির খুব ইচ্ছা বাড়িতে একখান মসজিদ দিবেন ৷ এই পাড়ায় ও আশে পাশের নেতুলহাটি, মোড়াহাটি পূবপার মুন্সিবাড়ি কোথাও কোন মসজিদ নাই৷ মসজিদ আছে সেই মাইঝগাঁওয়ে ৷ যেখানে দাদাজি শুধু শুœ²বারে জুম্মার নামাজ পড়তে যান ৷ বর্ষাকালে তাও যেতে পারেন না ৷ আর প্রতিদিন পাঁচ বেলার নামাজ দাদাজি এই বাংলা ঘরে পড়েন ৷ অল্প কয়েকজন নামাজি আসেন, কখনো জায়গির মুন্সি জসিম নামাজ পড়ায় কখনও দাদাজি নিজেই ইমামতি করে নামাজ পড়ান ৷ সামনের বাড়ির মুসা দাদা আর নজু চাচা এই নিয়মিত নামাজিদের দু'জন৷ সকালে নাশতার পর আর বিকেলে দুই বেলা দাদাজি বাংলাঘরের বারন্দায় পাতা কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে থাকেন ৷আশে পাশের বাড়ির , মহিদ লস্কর, জাহেদ লস্কর, মুসা পাগলা, আসাদ আলি'রা সব এসে বসেন তখন দুপাশে পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চে ৷ মাঝে মাঝে আমি গিয়ে দাদাজির কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে পড়ি ৷ দাদজি একহাতে তার লাঠি ধরে রাখেন অন্য হাতে আমাকে ৷ আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাদাজির ছোট করে ছাঁটা পাকা চুলে বিলি কেটে দিই৷দাদাজি আমাকে বলেন বুবু, তোমার ঘোড়ার ল্যাজডা আমারে দিবা? আমার চুলগুলো উঁচু করে ফিতে দিয়ে ঝুটি বাঁধা থাকে বলে দাদাজি আমার চুলকে ঘোড়ার লেজ বলেন! সকলে নিজেদের সুখ দু:খের কথা বলে, কখনও সুখা নিয়ে তো কখনও বন্যা নিয়ে আবার কখনও বা মসজিদ নিয়ে ৷ দাদাজি নিজের ইচ্ছের কথা বলেন, একখান মসজিদ বানাতে চান তিনি,যাতে পাঁচবেলা মাইকে আজান হবে, মসজিদের পাকা দালান হবে, আর মসজিদ ভরে সবাই নামাজ পড়তে আসবে ৷ মুসা দাদা বসে আপশোস করে নিজের ছেলে কালাকে নিয়ে ৷ বলে, পোলাডা গাঞ্জা খাইয়া আর জুয়া খেইল্যা অমানুষ হইয়া গ্যাসেগা ভাইসাব ৷ নাইলে এই মোলি বাড়ির ( মৌলভি বাড়ি) লগে পাল্লা দিয়া হ্যায় বাড়িত মাজার বানাইয়া ফ্যালাইসে! আমি বাঁইচা থাকতেই এই অবস্থা মইরা গেলে হেরা কি করবো! দাদাজি বলেন মুসা, আল্লার কাছে কও, আল্লায়ই পারেন হেরে সুমতি দিতে ৷ জসিম হুজুর এসে জানতে চায়, চাচা, আজানের ওয়াক্ত হইসে, আজান দিয়া দেই? দাদাজি বলেন দ্যাও, আমি ওজু কইরা আসি৷ আমি ছুট্টে বাড়ির ভিতরে গিয়ে দাদাজির ওজুর বদনা নিয়ে আসি আর সামনের টিউবওয়েল থেকে জল এনে দেই৷ জলেখা বিবির "বাগ'এ প্রতিবার মেলা বসে শীতকালে৷ বিশাল এক ফলের বাগান, সকলে যারে বাগ বলে৷ মেলায় আসে নাগরদোলা, সাপের খেলা,বাঁদরনাচ আরও নানারকমের খেলা৷ দূর দূর থেকে লোকজন তাদের পসরা নিয়ে আসে৷ থাকে পোড়া মাটির সরা, কলসি, হাঁড়ি আর নানা রকমের পুতুল, বিভিন্ন রকমের খেলনা, রঙিন কাগজ দিয়ে বানানো কুমির হাঙর আর রবারের সাপ৷ থাকে নানা রকমের খাবারের দোকান আর থাকে জুয়া৷ সারাদিন মেলায় সব খেলনা পোড়ামাটির জিনিসপœ বিœ² হিয়, ছেলের দল স্কুল ফিরতি মেলা থেকে কাগজের হাঙর কুমির আর বাতাসা কিনে বাড়ি ফেরে৷ সন্ধ্যা ঘনালে সেখানে বসে জুয়ার আসর আর সাথে তাড়ি, গাঁজা৷ বিকেল বিকেল দাদি আহাদালির মা বুবুকে পয়সা দিয়ে মেলায় পাঠায় মাটির কলসি,সরা আর খোলা কিনে আনার জন্যে৷ এই খোলাগুলো দেখতে হাঁড়ির মত হলেও হাঁড়ি নয় ৷ এর মুখটা একদম খোলা থাকে অনেকটা কড়াইএর মত৷ যাতে চিতই পিঠে বানানো হয়৷ আহাদালির মা বুবুরা এই খোলাতেই রুঁটি সেঁকে৷ সারা বছরের মাটির মাটির জিনিসপত্র দাদি এই মেলা থেকেই কিনিয়ে রাখে ৷ এই মেলার মাটির কলসি, সরা , খোলা নাকি খুব ভাল হয়, দাদি বলে ৷ আমি মেলায় যাই পুতুল কিনতে ৷ মাটির পুতুল, নানা আকারের নানা ডিজাইনের ৷ মা পুতুল, মেয়ে পুতুল, ছেলে পুতুল আর বাবা পুতুল ৷ আর ছোট্ট ছোট্ট সব হাড়ি-কুড়ি,বাসন-পত্র আর থাকে ছোট উনুন ৷ দুমুখো তিন মুখো পোড়া মাটির উনুন ৷ আহাদালির মা বুবু আমাকে নিয়ে গোটা মেলাটা এক চক্কর ঘুরে চলে আসে মাটির হাড়ি কলসিওয়ালাদের কাছে৷ সে কেনে তার দরকারি জিনিসপত্র আর সবার শেষে আমার জন্যে আমার পুতুল বাসনপত্র আর দুমুখো উনুন ৷ সি এন্ড বি সড়কের ধারে যে বাজার বসে তাতেও এই মাটির পুতুল পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে আর আমাকে কে নিয়ে যাচ্ছে! মেলার একধারে একটা জায়গা একদম ফাঁকা পড়ে আছে, কিছু জিনিসপত্র ইতস্তত: ছড়ানো, ভাঙা বোতল, গেলাস আর রঙ বেরঙের ছবি আকা কিছু কাগজ, যাতে রাজা রাণীর ছবি আঁকা৷ হাতে নিয়ে দেখতে গেলে বুবু বারন করে, বলে, ওতে হত দিয়েন না আম্মা, সারা রাইত হারামিরা এইখানে জুয়া খেলসে আর গাঞ্জা তাড়ি খাইসে! জিজ্ঞেস করে জানতে পারি এই রাজা রাণীর ছবি আঁকা কাগজগুলোকে বলে "তাস' এগুলো দিয়ে জুয়া খেলে৷ কি করে খেলে তা অবশ্য বুবু বলতে পারলো না তবে গাঞ্জা আর তাড়িটা কি জিনিস সেটা বুবু জানে৷ তার ছেলে আহাদালিও নাকি রাতে এখানে বসে তাড়ি খেয়ে নেশা করে আর সারাদিন বাড়িতে পড়ে পড়ে ঘুমায়! খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে যেমন গুড় হয় তেমনি তালের রস জ্বাল দিয়ে তাড়ি হয়, যা খেলে লোকের নেশা হয় ৷ নেশাটা কেমন জিনিস সেটা অবশ্য বুবু ঠিকঠাক বোঝাতে পারলো না ৷ গাঁজাও নাকি সেরকমই নেশার বস্তু, তামাক যেরকম হুকোর মধ্যে দিয়ে খায় এও সেইরকমই ছিলিমের মধ্যে দিয়ে খায় ৷ পড়ে থাকা গাঁজার ছিলিমও দেখা যায় মেলার মধ্যে ৷ জসিম হুজুর আমাদের বাড়িতে থেকে বড় মাদ্রাসায় পড়ে৷ আর একবছর পর সে মৌলভি হয়ে যাবে, এখনও সে ছাত্র ৷ দাদি সব সময়েই এরকম একজন ছাত্র বাড়িতে রাখেন, যে আমাদের বাড়িতে থাকে খায় আর পড়াশোনা করে ৷ কোন ছেলে অনেক দূরের কোন গ্রাম থেকে আসে ৷ একটু বড় বয়েসে এলে সে বেশিদিন থাকে না ৷ কয়েক বছরে তার পড়া শেষ হলে সে চলে যায় আর তার জায়গায় আসে অন্য আরেকজন ৷ জসিম হুজুরকে আমি দেখছি অনেকদিন ধরেই ৷ দাদি বলেন সামনের বছর জসিম চলে যাবে আর তার জায়গায় আরেকজন আসবে৷ পাঁচবেলা আজান দেওয়ার সাথে সাথে জসিম হুজুর আরেকটা কাজ করে, ভোরবেলা আমাদের বাংলা ঘরে এই পাড়া সহ আশে পাশের পাড়া থেকেও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আসে আরবি পড়তে, জসিম হুজুর এদের সবাইকে আরবি পড়ায় ৷ সকালের এই এক ঘন্টা পড়ানোর জন্যে দাদাজি জসিম হুজুরকে মাইনে দেন ৷ সব ছেলে মেয়েরা সুর কউ কোরাঅন শরীফ পড়ে তো কেউ আমপারা ৷ যারা আমপারা পড়ে তারা সেটা শেষ হলেই কোরাঅন শরীফ পড়া শুরু করবে ৷ অত বড় ঘরখানায় দু সারি করে ছেলে মেয়েরা সব বসে ৷ জসিম হুজুর প্রথমেই সুরা ফাতেহা দিয়ে শুরু করে, "আলহামদুলিল্লাহ হিরাব্বিল আ'লামিন৷ আর রাহমানির রাহিম ৷ মালিকি ইয়াওমিŸনি৷ ইয়্যাকা না'বুদু অ ইয়্যাকা নাশতায়িন ৷ ইহদিনাস সিরাতাল মুশতাকিন৷ সিরাতাল্লাযীনা আন আমতু আলাইকুম ৷ গাইরুল মাঘ্দু বিআলাইকুম ৷ অলাŸউউয়াল্লীন ৷ আমীন ৷' পড়িয়ে তারপর যার যার পড়া শুরু করতে বলে আর পড়ার শেষে সকলে একসাথে দরুদ পড়ে , "আল্লাহুম্মা সালিয়ালা সায়্যিদিনা ও নাবীয়ানা ও শাফিয়ানা ও মাওলানা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহে সাল্লাল্লাহু ওয়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৷' দুই হাত তুলে দোয়া করে পড়া শেষ করে ৷ পড়ার মাঝখানে সে হাতে একখানা বেত নিয়ে শুধু চারপাশে ঘোরে, কেউ চুপ করে থাকলে তাকে বেত উঁচু করে ধমকে বলে, অ্যাই, পড়স না ক্যান? আওয়াজ কই গলার? অমনি সে পড়া শুরু করে! -4- আকাশ আজো ঢেউয়ের মুখোমুখি, নদীর উজান ভেজায় ক'টি তারা ৷ অন্ধকারে স্রোতের কশাঘাতে হটাত্ বুঝি বুকের মাঝে নেই, আমার পাশে চলার ছিল যারা ৷ ( নির্মলেন্দু গুণ ) একে একে অনেকগুলো অঘটন ঘটে গেল এই পাড়ায়৷ সখিনার স্বামী বুড়ো হাসন আলি হঠাত্ করে মরে গেল ৷ বিকেলবেলা উঠোনে বসেছিল হঠাত্ অসুস্থ বোধ করে ৷ খানিকক্ষণের মধ্যেই মাটিতে গড়াগড়ি ৷ তার কি কষ্ট হচ্ছে সেটুকুও সে বলতে পারে নি ৷ ধড়ফড় করতে করতে শেষ ৷ উঠোনে হাত পা ছড়িয়ে বুক চাপড়ে কাঁদছিল সখিনা, তার ছেলে মেয়ে তিনটে এক কোণে বসে আছে বুড়ো মইজুদ্দিনের কাছে৷ মইজুদ্দিন চুপ করে বাচ্চা তিনটেকে আগলে বসে আছে ৷ আশে পাশের বাড়ির মেয়েরা এসে সখিনাকে উঠোন থেকে তুলে ঘরের ভিতরে নিয়ে চলে গেল৷ সখিনার স্বামীর এখন দাফন কাফন হবে, পাড়ার পুরুষেরা এসে সে বন্দোবস্ত করতে লাগল ৷ ঘরের ভেতর থেকে শুধু সখিনার হেঁচকির আওয়াজ ভেসে আসছে ৷ আহাদালির মা বুবু আমার হাত ধরে বলল চলেন আম্মা, ঘরে যাই, আফনের দাদি আবার খুঁজতে আরম্ভ করব ৷ ওপাড়ার মুসা লস্করের ছেলে লিয়াকত চাচা মরে গেল সাপের কামড় খেয়ে৷ পাশের বেতঝাড়ে বেত কাটতে গিয়েছিল সে৷ বিষাক্ত সাপে ছোঁবল দেয় তাকে৷ কিচ্ছু করা যায়নি লিয়াকত চাচার জন্যে ৷ ক্বালা আলক্বিহা ইয়া মূসা ৷৷ ফাআলক্বাহা ফাইযা হিয়া হাইয়্যাতুন তাস্আ ৷৷ ক্বালা খুয্হা ওয়ালা তাখাফ্ সানুয়ীদুহা সীরারাহাল ঊলা ৷৷ ( সূরা তা-হা, 19-21 আয়াত) [ আল্লাহ বলেছেন, হে মুসা, তুমি লাঠি নিক্ষেপ কর৷ তিনি তা নিক্ষেপ করলেন, তখন তা অজগর সর্প হয়ে বিচরণ করতে লাগল৷ আল্লাহ বলেছেন, তুমি এটাকে ধর ভয় পেয়োনা; আমি প্রথম বার একে লাঠিতে পরিণত করে দিচ্ছি ] ওঝা এসে অনেক চেষ্টা করেছে বিষ নামানোর, কিছুই করতে পারেনি সে ৷ গোটা শরীর ক্রমশ নীল হয়ে গেছে লিয়াকত চাচার, মুখ দিয়ে গ্যাজলা উঠছে আর চোখ দুটো উল্টে যাচ্ছে খুব দ্রুত ৷ চার হাত পা মাটিতে দাঁপিয়ে দাঁপিয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হয়েছে সে ৷ এদিকে যতখানি দাঁপিয়েছে লিয়াকত চাচা তার চাইতে বেশি বুক চাপড়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছে তার মা,বাবা ৷ বড় কাকা খবর পেয়ে সাইকেল নিয়ে বাজারের হাসপাতাল থেকে ডাক্তার নিয়ে এসেছে কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না কারও ৷ ছেলের শোকে পাগল হয়ে গেল বুড়ি মা ৷ আর শোকে শোকে কয়েক মাসের ভেতর মরে গেল মুসা লস্কর৷ পাশের বাড়ির সুজন তার বউ বাচ্চা নিয়ে এসে দখল নিল তার চাচার বাড়ি বাগান আর পুকুরের৷ জমি-জমার দখল আগেই নিয়েছিল সে৷ মুসা দাদার অত সাধের বাগান শুকিয়ে যেতে লাগল অযত্নে ৷ বুড়ি দাদি সারাদিন ঘুরে বেড়ায় এ বাড়ি ও বাড়ি, যেখানে সন্ধ্যে হয় সেখানেই আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়ে ৷ সুজনের বউ সাফিনা সরাদিন বাড়িতে পাড়ার মেয়েদের নিয়ে আড্ডা দেয় পান খায় আর মোড়লি করে ৷ মুসা লস্করের বাগানে বসে পাড়ার ছেলে ছোকরাদের নিয়ে জুয়া খেলে সুজন ৷ (চলবে)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.