আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আর্ট গ্যালারিতে গিয়েছিলাম

জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।

সেদিন ব্রডওয়ে নামের বইয়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ মনে পড়ল, ব্রডওয়ের কাপড়ের ব্যাগটা দেখতে দারুণ। কালোর উপর সাদায় লেখা। কাপড়, সেলাই সব মিলিয়ে বেশ পোক্ত। ইউনিতে ভারি ভারি বই নেয়ার জন্য আদর্শ ব্যাগ।

তো ঢুকে পড়লাম ব্যাগ কিনতে। তখন 'সেইল' চলছিল। একটা বই দেখে কেনার ভীষণ রকমের লোভ হলো! সেটাকে 'আর্ট' এর এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যায়। গত এক হাজার বছরে পেইন্টিং যে সব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, সেগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া বিশাল বই। সাথে বিখ্যাত সব আর্টের ছবি, সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

কি যে লোভ হলো কেনার! নিতান্তই আনকালচারড মুর্খ টাইপের মানুষ আমি। পড়লে যদি কিছু শিখি টিখি! দামটাও হাতের নাগালে। কিনেই ফেললাম। এখন প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে ওকে বিছানায় নিয়ে যাই। পাতা উল্টিয়ে বেশ সময় সম্পর্কে পড়ি।

গভীর মনযোগ দিয়ে দেখে 'আর্টিস্টিক' মাইন্ডের ভিতরে কি হয় বুঝার চেষ্টা করি। সেদিন পাতা উল্টাতে গিয়ে রবি ঠাকুরের একটা পেইন্টিং পেয়ে গেলাম। বেশ লাগলো! আমার এরকম হয়, মাঝে মাঝেই ঝোঁক উঠে, ঝোঁকের মাথায় অনেক কিছু নিয়েই পড়ি, নেশার মত। সময়ের সাথে সাথে শিল্পকলার বিবর্তন, সেই শিল্পকলায় মানুষের বিশ্বাস এবং সময়ের প্রতিফলন, প্রভাব, এগুলো গত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে বেশ আকৃষ্ট করছিল আমাকে। তখনই শহরের এখানে সেখানে, বাস স্টপ থেকে শুরু করে নানা জায়গায় একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো--একটা একজিবিশনের-- 'দ্যা আর্টস অফ ইসলাম' সবচেয়ে বড় পত্রিকা--'সিডনী মর্নিং হেরাল্ড' এর সাথেও বিজ্ঞাপন দেখলাম।

আর্ট গ্যালারিতে ইসলামের শিল্পকলা শিরোনামে একটা একজিবিশন হচ্ছে। 'নাসের খলিলী' নামের একজনের ব্যক্তিগত সংগ্রহে গত চোদ্দশ বছরে ইসলামের প্রভাবে হওয়া যে কোন শিল্পকলার প্রদর্শনী। তিনি আরব, ভারত, চীন, ইউরোপ, আফ্রিকা প্রতিটা মহাদেশ থেকে বিভিন্ন আর্টিফেক্ট সংগ্রহ করেছেন। আমাকে যেটা বেশ অভিভূত করল তা হলো নাসের খলিলী নিজে একজন ইহুদী, ইরানী ভদ্রলোক। ইহুদী একজন ইসলামের শিল্পকলার প্রতি খুব মমত্ববোধ পোষণ না করলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত সংগ্রহ থাকতো না নিশ্চয়ই ইসলামী শিল্পকলার।

কৃতজ্ঞ বোধ করলাম খলিলীর প্রতি, আনকালচারড মুসলিমদের প্রতি অভিমানও হলো। কাজটা কেন কোন মুসলিম করতে পারল না? ইসলামের স্বর্ণযুগ নিয়ে এক একজনের গলাবাজির তো শেষ হয় না! সে যাক গে, আমার যা করার নূন্যতম সামর্থ ছিল তাই করলাম--বন্ধুদের সাথে গেলাম আর্ট গ্যালারীতে। বেশ বিশাল অবস্থা। পোস্টের ছবিটা আর্ট গ্যালারীর বাইরের। নিউ সাউথ ওয়েলসের আর্ট গ্যালারীর বাইরে প্রিয় শব্দ 'ইসলাম' এত বড় করে ঝুলতে দেখে ঝট পট ক্যামেরার শাটার চাপলাম।

রেয়ার ঘটনা বলতেই হয়! কি যে ভালো লাগে ধ্বংসাত্মক কিছু নয়, বরং খুব সৃষ্টিশীল কিছুর সাথে মুসলিমদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে এত বড় একটা প্রদর্শনী, শহরের প্রানকেন্দ্রে! ভিতরে ঢুকেও বেশ লাগলো, অনেক মানুষ। মুসলিম আমরা আর আরেকটা গ্রুপ, এই তো। সবই তো অমুসলিম! অন্তত: চেহারা আর পোশাক আশাকে। প্রদর্শনীটা ফ্রি নয়, অতএব যারা ঢুকেছে, তারা সত্যিকার জানার আগ্রহ থেকেই ঢুকেছে। সেটা বুঝা গেল সবার খুব মনযোগ দিয়ে সব পড়া দেখে, সেগুলো নিয়ে আগ্রহী আলোচনা দেখে।

আমিও মুগ্ধতা নিয়ে দেখলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। একটা ব্যপার আমার বেশ ভালো লাগল। 'আর্টি' মানুষ বলতেই এখন ইমেজটা এমন খাড়া হয়ে গিয়েছে, যেন সে নিজের জীবন নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করে, এবং সেটা অবশ্যই মাদকদ্রব্য এবং সেকজুয়ালিটি সংক্রান্ত হতে হবে। সেই এক্সপেরিমেন্টের প্রকাশ ঘটে তার সৃষ্টিতে। একটা অল্টারনেইট রিয়েলিটি খুঁজার প্রানান্তকর চেষ্টায় মাদকদ্রব্য এবং সেকজুয়ালিটি থাকতেই হবে! আর্টের একসাইক্লোপিডিয়া পড়ার সময়ও সেটা মনে হচ্ছিল।

প্রাচীন গ্রীক শিল্পকলায় এগুলোই তো বড় মটিফ ছিল। কিন্তু ইসলামিক আর্টে, চোদ্দশ বছর ধরে তিন মহাদেশে--ইউরোপ, আফ্রিকা আর এশিয়ার কোথাও এই দু'টোর কোন ডমিনেন্স ছিল না একদম, কোন প্রভাব দেখলাম না একটা টুকরোতেও। অবশ্যই আরবের বাইরে যখন ইসলাম গেল, তখন সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের শিল্পের প্রভাবে ফিউশন ঘটে নতুন ধারা সৃষ্টি হলো, যেমনটা হয়, কিন্তু কখনও মাদকদ্রব্য আর সেকজুয়ালিটির কোন স্থান স্থান হয় নি। যেমন প্রাথমিক যুগের শিল্পচর্চা সীমাবদ্ধ ছিল পশুর চামড়া বা কাগুজে ক্যালিগ্রাফীতে। আফ্রিকায় শ্বেত পাথরের স্ট্রাকচারে বা দেয়ালের সিরামিক টাইলসে সোনা রূপায় কোরআনের আয়াত লিখে রাখার চল শুরু হলো।

ইরানে যাওয়ার পরে ফুলদানী, কালির দোয়াত বা খাওয়ার বাটিতে ক্যালিগ্রাফী শুরু হলো। এখানে মাধ্যম বদলে যাওয়ার সাথে সাথে ধারাটাও একটু বদলে গেল--ক্যালিগ্রাফীগুলো দেখে হঠাৎ আরবি মনে হয় না মোটেই, পাখি বা ফুলের ছবি মনে হয়। এই ধারার বিবর্তনটা হয়েছে নতুন দেশের ভিন্ন রকমের মানুষের প্রভাবে। কিন্তু বিবর্তনটা কখনও মাদকদ্রব্য আর সেকজুয়ালিটির দিকে যায় নি। খেয়াল করে বেশ লাগলো! ইহুদী ভদ্রলোক খলিলীর প্রতি আমি ভীষণ রকমের কৃতজ্ঞ--দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠির সামনে ইসলামের এই সৃষ্টিশীল চেহারা তুলে ধরার জন্য।

এখানে সেখানে টুকরো ইনফরমেশনগুলোতে কোথাও ভুল ছিল না। দু'ঘন্টা থাকতে না থাকতেই বের হয়ে যেতে হলো সবার জ্বালায়। আবার যাওয়ার ইচ্ছা আছে। এবার যাওয়ার আগে একটু পড়াশোনা করে নিতে হবে। তারপরে হয়তো আরও লিখব!


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।