আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মবিস্মৃত আওয়ামী লীগ এবং

নামের সাথে কামের কিছু মিলতো থাকবোই

আত্মবিস্মৃত আওয়ামী লীগ এবং ‘এই মাঝি, নৌকা ভিড়া; আমি শামসুল হক’ আবু হাসান শাহরিয়ার : ঘরোয়া রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সংক্ষিপ্ত পরিসরে দলের ৫৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনে আওয়ামী লীগকে বাধা দেয়নি সরকার। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং দলের প্রতীকতুল্য ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে দিনটিকে স্মরণ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। কিন' কারও মুখেই উচ্চারিত হয়নি দলটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামসুল হকের নাম। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাম নেওয়া হয়েছে মর্মেও কোনও সংবাদ চোখে পড়েনি। আওয়ামী নেতা-নেত্রীরা প্রায়ই ইতিহাসবিকৃতির কথা বলেন।

ইতিহাসবিস্মৃতিও যে সমান অপরাধ, সেকথা কখনও বলতে শুনিনি তাদের। তারা যখন আত্মবিস্মৃতও, তখন শামসুল হককে নিয়ে দুটি স্মারক-প্রতিবেদন পড়লাম ‘আমার দেশ’ ও ‘আমাদের সময়’-এ। লিখেছেন যথাক্রমে মহব্বত হোসেন ও আবুল বাশার নূরু। যে-কাজ আওয়ামী লীগের করণীয় ছিল, সেই কাজই সম্পাদন করেছেন এ দুই প্রতিবেদক। সে-কারণে মহব্বত ও নূরুর কাছে দলটির কোনও বড় নেতা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বলে মনে হয় না।

(দলটিতে অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ মাঠনেতা-মাঠকর্মী থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় নেতা হন অকৃজ্ঞরা। দুধকলা দিয়ে পোষা হয় কৃতঘ্নদেরও। খোন্দকার মোশতাক আহমেদই এর বড় প্রমাণ। ) আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার বরাত দিয়ে লেখা ‘আমাদের সময়’-এর প্রতিবেদনটিতে কিছু তথ্যবিভ্রাট আছে। না, মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের কোনও নেতা শামসুল হকের খোঁজ নেওয়ার তাগিদবোধ করেননি।

শামসুল হকের স্ত্রীও নন। তিনি তো তখন অন্যের ঘর করছেন। প্রতিবেদন দুটিতে যা নেই কিংবা যেটুকু তথ্যবিভ্রাট ঘটেছে, তা আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘আত্মস্মৃতি : সংগ্রাম ও জয়’ বইয়ে আছে। প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ উদ্ধার করছি- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাকে (শামসুল হককে) আটক করা হয়। তখন তিনি বিবাহিত, একটি কন্যা সনত্মানের পিতা।

স্ত্রী নরসিংদির সেকান্দার মাস্টার সাহেবের কন্যা আফিয়া খাতুন এম.এ কলেজের লেকচারার। ঃজেলখানায় শামসুল হকের মসিত্মষ্কবিকৃতি ঘটে। ঃনিজ পরিবারের প্রতি তাঁর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। আফিয়া খাতুন তাঁকে ত্যাগ করেন। আফিয়া এখন পাকিসত্মানে মিসেস আফিয়া দিল।

ঃশামসুল হক সম্পূর্ণ বিকৃতমসিত্মষ্ক অবস্থায় জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শামসুল হকের চিকিৎসায় আওয়ামী মুসলিম লীগ কোনো উদ্যোগ নিয়েছিল বলেও মনে পড়ে না। শামসুল হক ঢাকার রাসত্মায় রাসত্মায় ঘুরে বেড়াতেন- কখনও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে টাকা ধার চাইতেন, কেউ সমাদর করলে আহার করতেন। ঃটাঙ্গাইলের ওয়ার্টারলু বিজয়ী শামসুল হকের মৃত্যু কোথায় কি অবস্থায় হলো তার কোনো বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখিনি। শোকসভাও করেনি কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্যরা।

অথচ এই শামসুল হক একদিন ছিলেন বাংলার তরুণ মুসলিম ছাত্রসমাজের প্রিয় নেতা- ১৯৫২ সালেও ভাষাসংগ্রামী এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। (পৃ : ২৬৩-২৬৪) শামসুল হক যখন (১৯৪৯) টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন, তখন তিনি সবে বিএ পাশ করেছেন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। সম্বল : আদর্শ, নিষ্ঠা ও সততা। সারা পাকিসত্মানে এমনকি তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্মানেও তখন মুসলিম লীগের একচেটিয়া প্রাধান্য।

তা সত্ত্বেও ভোটগণনার পর দেখা গেল, নিঃসম্বল শামসুল হকের কাছে মুসলিম লীগের খুররম খান পন্নী বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছেন। সম্ভব? সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভালবাসার কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। দুই. ছেলেবেলার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ১৯৭০ সাল। নির্বাচনি পালে তখনও জোর হাওয়া লাগেনি।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সবে রেহাই পেয়েছেন। আমি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়ি। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একদিন শহরের নামী আওয়ামী লীগ নেতা রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার বাড়ির সামনে ছোট একটি জমায়েতে শেখ মুজিবকে ভাষণ দিতে দেখি। শ্রোতার সংখ্যা বড় জোর শ তিনেক। সেই প্রথম আমার শেখ মুজিবকে সামনাসামনি দেখা।

আমার বাবা তখন আনন্দমোহন কলেজের অধ্যক্ষ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ি আর আমাদের বাড়ির মধ্যে একটি মাত্র মাঠের ব্যবধান। সৈয়দ নজরুল আমার সম্পর্কে নানা হন। ডাকি ‘গোলাপ নানা’। বিকেলে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে মিছিল করি। স্লোগান দিই- ‘আমার নেতা তোমার নেতা/শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘বাংলার বুলবুল/সৈয়দ নজরুল’।

(এখানেই বলে রাখা ভালো, ছেলেবেলায় মুজিব আর নজরুলকে নিয়ে স্লোগান দিলেও কিংবা বরাবরই রাজনীতিসচেতন হলেও আমি কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। আমি কবি; আমার দলের নাম মানুষ)। তো, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার বাড়িবর্তী মাঠের সভাশেষে শেখ মুজিব নিশ্চয় গোলাপ নানার বাড়িতেও একবার ঢু মারবেন, এ ভাবনা থেকে বাড়ি না-ফিরে নানার বাড়িতে ঢুকে অপেক্ষা করতে থাকি। নানি এক বাটি গুড়ের পায়েস দেন। খেয়ে অপেক্ষা করতে থাকি।

শেখ মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে গোলাপ নানা আসেন না। আমার শৈশবের সাথী, সৈয়দ নজরুলের ছোট ছেলে ও দুই মেয়ে শরিফ, লিপি ও রূপার সঙ্গে লুডু খেলি। শেখ মুজিব আসেন না। নানি ভাত বেড়ে দিলে খেয়ে হাই তুলি। আমাকে নিয়ে যেতে বাড়ি থেকে মা লোক পাঠান।

শেখ মুজিব আসেন না। রাতে দূরের শহর থেকে নানির কাছে আসা টেলিফোনে জানতে পাই, গোলাপ নানাকে নিয়ে শেখ মুজিব কিশোরগঞ্জে ঐরকম ছোট-ছোট জনসভা করে বেড়াচ্ছেন। এ ঘটনার এক বছরের মধ্যেই শেখ মুজিব এসেছিলেন। সৈয়দ নজরুলের কলেজ রোডের বাড়িতে নয়; ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। সঙ্গে ছিল উত্তাল জনসমুদ্র।

পূর্ববর্তী অজস্র ছোট-ছোট জনসভার যোগফল সেই সমুদ্র। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। সেদিন মুজিব স্বজাতির উদ্দেশে যে-ভাষণ দিয়েছিলেন, তা পৌঁছে গিয়েছিল পৃথিবীর সব দেশের সব মুক্তিকামী মানুষের কাছে। সে-অভিজ্ঞতায় আমার কবিতায় একটি পঙ্‌ক্তিও আছে- ‘কে আছে শোনেনি সেই রাখালের বজ্রচেরা বাঁশি?’ তিন. শেখ মুজিবের ডাকে ’৭১-এর মার্চে সমগ্র জাতি বাঁশের লাঠি হাতে সশস্ত্র পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। অকুতোভয় সেই প্রতিরোধ দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ মুক্ত-স্বাধীন।

অথচ ২০০৬-এ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার ডাকা লগি-বৈঠার আন্দোলন রাজপথের হানাহানিতেই অসত্ম গেছে। কেন? রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাবার কাছে না-গিয়ে হাসিনা কানে তুলেছিলেন আশপাশের নীতিভ্রষ্ট ‘শিক্ষিত’দের পরামর্শ। (নীতিভ্রষ্টতাও দুর্নীতি। বড় দুর্নীতি। কিন' প্রচলিত আইনে সব নীতিভ্রষ্টকেই দুর্নীতিবাজ বলা হয় না।

) ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি দলের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে শেখ মুজিব ঐ নীতিভ্রষ্টদের স্পষ্ট ভাষায় শনাক্ত করেছিলেন, “আমরা যারা শিক্ষিত, আমরা যারা বুদ্ধিমান, তারাই ওষুধের মধ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষকে খাওয়াই। নিশ্চয় গ্রামের সাধারণ মানুষ এসব পারে না; নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক ভাইয়েরা পারে না। ” শেখ মুজিব টের পেয়েছিলেন, কিছু নষ্ট-ভ্রষ্ট মানুষ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছেন। (কী ক্ষমতাকালে, কী অক্ষমতাকালে, শেখ হাসিনার আশেপাশেও ওদেরই দৌরাত্ম্য। ) তখনও মুজিব বুঝতে পারেননি যে, ওদের চক্রানেত্মই তার পাশ থেকে মুছে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক তাজউদ্দিন আহমদ।

তবু নিজে বাঁচতে এবং জাতিতে বাঁচাতে শেষচেষ্টা হিসেবে শেখ মুজিব বাকশাল করেছিলেন। অনেকেই বাকশালের অনেকরকম সমালোচনা করেন। বাকশালে কিছু ভুল যে ছিল না, তা নয়। যেমন : ১. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা-সংকোচন, ২. একদলীয় শাসনব্যবস্থা। আড়ালে কোনও ভালো উদ্দেশ্যও কি ছিল না? আওয়ামী লীগের কোনও নেতার মুখ থেকে আজ অবধি এর কোনও সনেত্মাষজনক ব্যাখ্যা পাইনি।

বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা ছিল শেখ মুজিবের প্রথম স্বপ্ন। তার নেতৃত্বে জাতি সেই স্বপ্ন বাসত্মবায়িত করেছে। দ্বিতীয় স্বপ্ন ছিল সন্ত্রাস, দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। সে জন্যই তিনি বাকশাল করেছিলেন। এ স্বপ্নের সুফল জাতিকে হাতে-নাতে বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই তাকে হত্যা করা হয়।

মুজিবের মুখ থেকেই শোনা যাক বাকশালগঠনের পর ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত গভর্নরদের উদ্দেশে তিনি কী বলেছিলেন- আপনারা লোকালি ঘুরতে থাকুন। আপনারা নৌকায় ঘুরুন; গাড়ি নিয়ে ঘুরুন- মানুষ যাতে শানিত্মতে ঘুমাতে পারে। যে-থানায় চুরি ডাকাতি কমবে না, সেখানকার সরকারি অফিসারদের ডেকে কনফারেন্স করে বলুন, চুরি-ডাকাতি তোমাদের এরিয়ায় বন্ধ করতে না-পারলে তোমরা বিদায় হবে। সাফ সাফ কথা। রেসপনসিবিলিটি নিতে হবে।

তোমরা যারা ঐখানে আছো, তাদেরই এসব বন্ধ করতে হবে। ঃসাবধান আপনাদের সবাইকে আমি এসব বলে রাখছি এখানে। যারা এখানে আছেন, তাদের সবাইকে সাবধান করে রাখছি। আমি এ ব্যাপারে সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছি। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐ সেন্টিমেন্টকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার।

বরং ঐ মহার্ঘ সেন্টিমেন্টটি বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে দৃশ্যমান। দুর্নীতিদমন কমিশনের চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধূরীর মধ্যে ষোল আনা। (তবে এখনও এ সরকার সম্পর্কে চূড়ানত্ম কথা বলার সময় আসেনি। একই সঙ্গে এ-ও না-বললে নয়, হাসিনার শাসনকালে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল, যা জোট সরকারের সময় ছিল না এবং এখন আরও নেই। ) নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শামসুল হকের মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের ইয়ার মোহাম্মদকেও টেনেছিল শুরুর আওয়ামী লীগ।

না, আরও বিত্তবান হওয়ার লোভে ইয়ার মোহাম্মদ আওয়ামী লীগের প্রতি আকৃষ্ট হননি। দুর্নীতি কিংবা চাঁদাবাজি করতেও নয়। তাহলে? আবারও আবু জাফর শামসুদ্দীনের বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে কিছু অংশ উদ্ধার করা যাক- আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশেম গ্রুপের আধিপত্য এবং পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের শক্তিবৃদ্ধির জন্যে ইয়ার মোহাম্মদ অকাতরে অর্থব্যয় করেন। পিতার কণ্ট্রাকটরি এবং পারিবারিক ইটসুরকীর ব্যবসা ত্যাগ করে তিনি হয়ে পড়লেন সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী।

যুক্তফ্রন্টের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য নেতা এবং শক্তি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন : ওদের মধ্যে তুমি-তুমি সম্পর্ক ছিল। শেখ সাহেব তাঁর বাড়ীতে প্রায় আসতেন। ঃ রাজনীতি করতে গিয়ে ইয়ার মোহাম্মদকে বসতবাড়ীসহ তাঁর পুরনো ঢাকার সকল বিষয়সম্পত্তি, বাসাবোর বাগানবাড়ী এবং সন্নিহিত বহু ফসলের জমি বিক্রয় করতে হয়। (পৃ : ২৩৭) শামসুল হক নেই; ইয়ার মোহাম্মদও গত হয়েছেন।

রাজনীতি এখন নেতা-নেত্রীদের জীবিকা অথবা উপজীবিকা। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে কিংবা চাঁদাবাজি করে ‘দেশসেবা’ করেন একালের রাজনীতিকরা। প্রদত্ত ঘুষের অথবা ছিনতাইকৃত চাঁদার টাকা জনগণের কাছ থেকে উসুল করতে দ্বিগুণ-তিনগুণ মুনাফা করেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে গরিব আরও গরিব হয়। (রাজনীতিকদের অসাধুতা নিয়ে বিবৃতিদানকারী ‘গরিবপ্রেমী’ প্রফেসর ই্‌উনূসের গ্রামীণ ফোনও কি আটগুণ-দশগুণ কলরেট নিয়ে জনগণের সঙ্গে রক্তচোষার মতো আচরণ করে না? ফিরিঙ্গি ‘ডিজুস’ ভাষায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় না ভাষা আন্দোলনকে?) জাতির দুর্ভাগ্য, ‘অগত্যা’র মতো মিডিয়াও এখন বিরল।

প্রতি সংখ্যাতেই সমাজের ভ্রষ্ট মানুষগুলোকে তুলোধুনো করত পত্রিকাটি। একবার লিখেছিল- ‘প্রতিকার আছে জানা/উহাদের মাথায় সুপারি রাখিয়া কাষ্ঠপাদুকা হানা। ’ সঙ্গীন-উঁচানো ওয়ান ইলেভেনের আগে আমাদের তথা গণতন্ত্রীদের হুঁশ ফেরেনি। বছরের পর বছর অপকর্ম করে এখন যারা ‘সংস্কার সংস্কার’ বলে বেহুঁশ, তাদের মাথায় সুপারি রেখে জনগণ যদি কাষ্ঠপাদুকা (খড়ম) হানতে চান, দোষ দেওয়া যাবে কি? আরেক শামসুল হকের কথা জানা যাক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ এক মাঠনেতা ‘বুড়ো দা’।

গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগে ইংরেজরা তাকে কারাবন্দি করেছিল। শারদ ১৪১৩ সংখ্যা ‘আজকাল’এ প্রকাশিত স্মৃতিচারণমূলক এক গদ্যে পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ বামপন্থী নেতা জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন- বুড়োদা জেলে বসে নিজে হাতে সুতো কেটে আমাকে একটা তেরঙ্গা পতাকা উপহার দিয়েছিলেন। গ্রামে একটা মঠ ছিল। তার সামনের মাঠে একটা সভায় মায়ের শিখিয়ে দেওয়া বক্তৃতা ঠিকঠাক বলতে পারার পুরস্কার। ভারত স্বাধীন এবং বাংলা বিভাজিত হওয়ার পর ‘বুড়ো দা’ও পাগল হয়ে পথে-পথে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন শামসুল হকের মতো।

একদিন ‘পাগল পাগল’ কলরবে একপাল ছেলেকে ছিন্নবস্ত্র, উস্কোখুস্কো চুলের এক বৃদ্ধকে উত্যক্ত করতে দেখে বাধা দিতে গিয়ে চমকে উঠেছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ, ‘আপনি বুড়ো দা’ না!’ ‘হ্যাঁ, তাতে কী?’ বলেই থু-থু-থু করে রাসত্মায় খানিকটা থুতু ছিটিয়ে হনহন করে চলে গিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উপেক্ষিত মাঠ-নৃপতি। চোখ থাকলে আমাদের ভ্রষ্ট রাজনীতিকরা নিজেদের গালে-মুখে ঐরকম ঘৃণার নিষ্ঠীবন টের পেতেন। চার. মহব্বত হোসেনের প্রতিবেদনটিতে আছে, পাগল হওয়ার পর শামসুল হক নদীর তীরে-তীরে ঘুরে বেড়াতেন এবং হঠাৎ-হঠাৎ হাঁক দিতেন- ‘এই মাঝি, নৌকা ভিড়া; আমি শামসুল হক। ’ শামসুল হকের ডাকে আওয়ামী লীগের নৌকা আর ভেড়ে না। বুড়ো দা কিংবা শামসুল হককে পাগল বানিয়ে দল থেকে ছুড়ে ফেলতে না-পারলে দলের নষ্ট নেতারা জনগণের সম্পদ লুটপাটই বা করবেন কীভাবে আর নৌকা নিয়ে প্রমোদবিহারেই বা বেরুবেন কোন ভরসায়? ভারতের রাজনীতিতে এখনও বুড়ো দা’কে স্মরণ করার জন্য জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধায়ের মতো কিছু নেতা আছেন; আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শামসুল হককে স্মরণ করার মতো কেউ নেই।

মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাও যখন থাকবেন না, শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়ার নেতাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না দলটিতে। এখন শুধু এটুকুই বাকি আছে। দেরি করছেন কেন ‘সংস্কারপন্থী’রা? আপনারা মাঠে খেলছেন; আমরা জনগণ গ্যালারিতে বসে দেখছি। আমরা খেটেখাওয়া মানুষ। বেঁচে থাকার জন্য সবারই নানারকম কাজ আছে।

চোর-বদমাশদের কবল থেকে ঘর-গেরসত্মালিও সামলে রাখতে হয় নিজেদেরই। কিছু লুটেরা ধরা পড়েছে বলে আমরা খুশি। নতুন করে কেউ সিঁদ কাটবে না জনগণের ঘরে, সেই গ্যারান্টি তো কেউ দিচ্ছেন না। অতএব নেতারা, যা করার তাড়াতাড়ি করুন। গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের একটা কথা পৃথিবীর বহু বিপ্লবের রূপকার এঙ্গেলস তার ‘এ্যান্টি-ডুরিং’-এ গ্রহণ করেছিলেন- “সব কিছুই যেমন আছে, তেমনি নাইও বটে; সব কিছুই পরিবর্তমান।

সব কিছুই প্রতিমুহূর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে, অসিত্মত্বমান হচ্ছে এবং অসিত্মত্ব থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে। ” হিরাক্লিটাসের কথার সঙ্গে আমি আরও একটু যোগ করতে চাই। সংস্কার এক নিরনত্মর নদী। সংস্কৃতিই তার ঢেউ। গোটা দুনিয়াই এখন বাজার বটে; তারপরও এমন কোনও দোকান চালু হয়নি, যেখানে রেডিমেট সংস্কার কিনতে পাওয়া যায়।

ধযংযধযৎরধৎ@ফযধশধ.হবঃ আমাদের সময়: ২৭-০৬-২০০৭

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।