আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার সিঁধেল চুরি!

যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে

ছোট্টবেলা আশ্চর্যরকমের অবাক হয়েছিলাম যে জিনিসটা দেখে সেটা হচ্ছে সিঁধেল চুরি। অভিনব, আয়োজনে ব্যতিক্রমী, অনন্য প্রতিভাধর মানুষটিকে চোর অভিধাতে তখন যারপরনাই অবাক হতাম। ভাবতে শুরু করলাম চোর বোধহয় আসলে খারাপ কিছু নয়, প্রচন্ড সৃজনশীল, কিন্তু সবাই তাকে কেন মারে এ নিয়ে আমার বিষ্ময়ের সীমাপরিসীমা থাকলো না। এরও আগে আমার ধারণা জন্মেছিল চোর মানে হচ্ছে এক ভিন্ন প্রানীর নাম। যার মাথায় দুটো শিং থাকে।

সেই শিং দিয়ে সে মাটির ঘরে গর্ত খুঁড়ে ভেতর ঢোকে এবং সব জিনিস নিয়ে যায়। পরে একবার এক চোর দেখে আমার ভুল ভেঙে গেল। সেটা ছিল ছিঁছকে চোর। সে গর্তখুড়েও ঢোকেনি। কিন্তু রাতের বেলা পাড়াপড়শী যখন তাকে ধরে মেরে গাছের সাথে বেঁধে রাখলো, তখন আমি অবাক হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, চোরটার শিংগুলো কই? বাবা আমাকে কোলে নিয়ে ভুল ভাঙান, চোরের আসলে শিং থাকে না।

তারা আমাদের মতই মানুষ। তারপরে একদিন সিঁধেল চুরি দেখলাম। নানাবাড়ী গেছি শীতের বাৎসরিক ভ্রমনে। ফাইভে পড়ি। মামাতা, খালাতো ভাইবোনে পুরো বাড়ী তখন সরগরম।

সবাই ঐসময়ে নানাবাড়ী বেড়াতে যেত। সব বাড়ীতেই শহুরে অতিথিদের ভিড়। সিঁধেল চুরিও তখন বেড়ে যেত। একদিন সুবহেসাদিকের মোরগডাকার আগে লোকজনের হৈচৈ রৈরৈতে ঘুম ভেঙে গেল। শীতের লেপের মধ্যে নানীর বুকের ওম গেল চলে।

জানা গেল চোর ধরা পড়েছে। পাশেই মামার বাড়ী সিঁধ কেটেছে। একদংগল মামাতো-খালাতো ভাইবোন বিছানা ছেড়ে দৌড়ে নামি উঠনে। মামার ঘরের পেছনের দিকের মাটির ফ্লোরে একটা বড়সড় সিঁধ। সেটা গিয়ে উঠেছে ঘরের ভেতরে।

চোর সেই গর্ত দিয়ে ভেতরে ঢুকে আলমারীর তালা ভেঙে জামাকাপড়, টাকাপয়সা, স্বর্নালংকার নিয়েছে। কিন্তু ঘরের কেউ টের পায়নি। তবে হতভাগ্য চোর এ তাবৎ কর্মযজ্ঞ চালাতে বোধহয় বেশী দেরী করে ফেলেছিল। ফলশ্রুতিতে ভোররাত্রির লঞ্চ ফেরত নতুন অতিথিদের সামনে পড়ে যায়। সহযোগীবিহীন একাকী চোরকে হাতেনাতে পাকড়াও করা হয়।

আমরা সেই সিঁধ দেখে মহানন্দে নেচে উঠলাম। আমার শখ হলো ঐ সিঁধ বেয়ে ঘরের মধ্যে ঢোকা। চোরের তুলনায় সাইজে অনেক ছোট হয়েও সে গর্ত বেয়ে ঘরের গভীরে প্রবেশ করা এক রোমাঞ্চকার এডভেঞ্চারের মত মনে হলো। আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে মামাত বোনদের সামনে পড়লাম। বড় মামাত বোন আমাকে ধরে মজা করে চোর চোর বলে চ্যাচাতে শুরু করলো।

মামী এসে মহাধমক, চোরে জান নিয়ে গেল, আর তোরা মজা করছিস! মামীর ধমকে আমরা দৌড়ে পালাই। চোর দেখতে যাই বৈঠকখানায়। নাদুশনুদুশ চোর লুংগি কাঁছা দেয়া। হাত পেছনে মুড়ে বৈঠকখানার মাঝের একটা থামের সাথে বাঁধা। সমস্ত শরীরে তার মাটি লেগে থাকলেও হাত, পা আর চেহারা তেলচকচকে।

পরে জেনেছিলাম, সিঁধ কেঁটে ঘরে ঢোকার আগে সিঁধেল চোরেরা নাকি সমস্ত শরীরে তেল মেখে নেয়। সেই চোরকে পরে কি করা হয়েছিল তা আর মনে পড়ছে না। কিন্তু তার রাত্রিভর পরিশ্রমের ফসল সিঁধ দেখে আমার তার উপরে মায়া জন্মেছিল। মাঝে মাঝে স্বপ্নও দেখতাম, বড় হলে একদিন সিঁধেল চোর হবো! কিন্তু আমার বৃদ্ধিকালীন সময়ে ক্রমশ বাড়ীঘর গুলো কংক্রীটের হতে থাকায় দিনদিন সিঁধেল চোরের পেশা কমতে থাকলো। এ বিপুল আয়োজনের অভিনব চুরির পদ্ধতি ক্রমশ বিস্মৃত হতে থাকলো গ্রামবাংলা থেকে।

অথচ বাংলায় চুরিশিল্পে সিঁধেল চুরি অনেক রূপকথাকেও হার মানায়। লোককাহিনীতে এর নানা উপাখ্যান আছে, নববিবাহিত বধু চোরের সাথে ভেগেছে, সন্তানহীন পিতা চোরকে সন্তানের মত আগলে রেখেছে - এমন গল্পে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধও হয়েছে। লুপ্ত প্রায় সিঁধেল চুরি বাংলার আবহমানকালের ঐতিহ্য - এর ইতিহাস সংরক্ষন করা উচিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.