আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আব্দুল মতিন: একজন সৎ মানুষের হাসি

যারা উত্তম কে উচ্চকন্ঠে উত্তম বলতে পারে না তারা প্রয়োজনীয় মুহূর্তে শুকরকেও শুকর বলতে পারে না। এবং প্রায়শই আর একটি শুকরে রুপান্তরিত হয়।

ধানমন্ডিতে গবেষণার কাজ শেষ করে মিরপুর প্রাথমিক শিা অধিদপ্তরের দিকে যাব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার জন্য সবচেয়ে সহজ হয় ধানমন্ডি 32 থেকে বাসে ওঠা। দীর্ঘ সময় একটা বদ্ধ ঘরে ইন্টারভিউ আর জরিপ প্রশ্নমালা শেষ করে যখন বের হলাম তখন রৌদ্র্য ঝাপিয়ে পড়েছে সারা ধানমন্ডি জুড়ে।

মার্চের প্রথম সপ্তাহেই শুষ্ক প্রকৃতি, নিষ্ঠুর নিশ্চয়তায় আমার হৃদয়ের কথা জানান দিচ্ছে। তাই পুরোনো এবং আদি প্রেমিকা, 'কাজ' এর প্রতিই তীব্র মন:সংযোগ দেবার চেষ্টায় ধানমন্ডি 32 বলে একলাফে রিকশায় উঠে বসলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই হঠাৎ জ্যাম। ম্যাপেল লিফ ইন্টারন্যাশনাল এর নতুন নতুন লিফ, অর্থাৎ শিার্থী আর তাদের মায়েদের তস্ত্র ব্যস্ততায় একটা উচ্চবিত্ত জ্যাম তৈরী হয়েছে। হঠাৎ চোখে পড়ল রিকশাচালকের স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের গেঞ্জী।

আমি অনেকটা স্বগত উক্তির মত করেই বললাম, 'এই ছোট ছোট রাস্তাতেও এত জ্যাম"। প্রতি উত্তর এল খুবই গোছানো চিন্তাভাবনা প্রসূত ঢংয়ে। আব্দুল মতিন বললেন, দেখেন লেখা আছে "নো পার্কিং" কিন্তু এখানেই সবচেয়ে বেশি গাড়ী পার্ক করা। তিনি পার্কিংয়ের দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বললেন, কি ভাই নো পার্কিং এ এত গাড়ী কেন ? আর বলেই দারুন বিদ্রুপে হেসে উঠলেন। আমি বললাম ভাই আমরা দরিদ্র মানুষেরা তো সবাই রিকশায় চড়ি, কিন্তু যাদের গাড়ী আছে তাদের এই বিশাল জিনিসগুলো রাখার তো একটা জায়গা থাকা দরকার।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই দুজনে একসাথে হেসে উঠলাম। উনি জিগ্গেস করলেন আমি কি করি, আমি জানালাম নৃবিজ্ঞানী হবার চেষ্টায় আছি, মানুষ নিয়ে গবেষণা করি। কোথায় পড়ালেখা করছি জানাতেই তিনি মুচকি হেসে উঠলেন। তারপর বললেন আসলে "অনেস্টি ইজ দ্যা বেস্ট পলিসি'। আমি সহমত হলাম।

তিনি বললেন এই যে দেখেন পিডিবি তে লাইন ম্যান হিসেবে 25 বছর কাজ করেছি মোটরসাইকেল চালিয়েছি কিন্তু টাকা পয়সা করতে পারিনি। আমার অনেক সহকর্মীরই ঢাকায় নিজের বাসা আছে। আমি বললাম এখন রিকশা চালাতে কেমন লাগছে? তিনি বললেন কাজের কোন ছোট বড় নাই যা করছি তাতে ভালো আছি আর সুখে আছি। নিজের এলাকায় গেলে তো আবার শার্ট প্যান্ট পড়ে আমি ভদ্র মানুষ। জানতে চাইলাম এখন তিনি কোথায় আছেন, উত্তরে বললেন সাভারে ব্যাংক টাউনের কাছাকাছি।

দুই ছেলে স্ত্রী নিয়ে একই বাসায় 12 বছর ধরে ভাড়া থাকেন। বাসা ভাড়া 3000 টাকা। জানালেন দেশের বাড়ী মানিকগঞ্জ। আমিও বললাম আমার দেশের বাড়ী ঢাকাতেই। তিনি বললেন ঢাকার মানুষের মত মানুষ হয় না।

আমি খানিকটা পপাতি হয়েই সম্মতি জানালাম। বয়স কত জানতে চাইলে জানালেন 63। তবে এ বিষয়ে আমার খানিকটা সন্দেহ রয়েই গেল। ইতোমধ্যে 32 নম্বরে পৌছে গেছিলাম আর তাই নামার আগে একটা নৃবৈজ্ঞানিক ক্রস চেক করতে ইচ্ছে করল। তাকে বললাম ধানমন্ডি 9 নম্বর থেকে এখানে কত ভাড়া আমি জানি না, আপনি যা বলেন তাই দেব।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন আপনার যা ইচ্ছে করে দেন এবং উপযুক্ত ভাড়াটাই নিলেন। একটুও বেশি বা কম নয়। রিকশা থেকে নামতে নামতেই বললেন তার দুই ছেলে জাবি থেকে পাশ করেছে। একজন অর্থনীতিতে এবং একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। আমি তার মুচকি হাসির কারণটা অবশেষে বুঝতে পারলাম।

তিনি ছেলেদের শক্তভাবে বলে দিয়েছেন যা সৎভাবে আয় করা সম্ভব ঠিক সেটাই অর্জন করতে। প্রয়োজনে তার কাছ থেকে 2-3 হাজার টাকা নিয়ে সংসার চালাতে, কিন্তু কখনো অসৎ পথে যাবার চেষ্টা যেন তারা না করে। আব্দুল মতিনের জন্য আমার কোন সংবাদপত্রীয় সমবেদনা তৈরী হয়নি। বরং মনে হয়েছে একজন দৃঢ় ও সুখী মানুষের সহজ বয়ান। আমি দারুণ অনুপ্রাণিত হলাম।

মনে হল বাংলাদেশ জুড়েই এমন সৎ মানুষ ছড়িয়ে রয়েছেন, আমাদের প্রয়োজন এমন সৎ মানুষের স্বাভাবিকতাকে তথাকথিত শিেিতর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.