আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক মিনিটের গল্প- এক স্বর্গীয় দেবদূত।

ঘাটের এই পারে বসে আছি ঐ পারে যাওয়ার অপেক্ষা। মুসাফিরের ব্লগ। হাসনাত যখন প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষায় প্রথম হলো, তখন ওর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো। অদ্ভূত এক সুন্দর,বিনয়ী,মার্জিত হাসনাত। ভাবগম্ভীর কন্ঠে যখন ও আবৃত্তি করে আমার মুগ্ধতা আরো বেড়ে যায়।

সত্যিই এবার বুঝি আমি ওর প্রেমে পড়লাম। চোখের কালো চশমা যখন ও খুলে রাখে কদাচিৎ ,সাদা ছড়ি নিয়ে হলের দিকে পা বাড়ায় অথবা পরীক্ষার হলে রাইটার নিয়ে আসে তখনই বুঝা যায় হাসনাতের সাথে পৃথিবী বড় বেশী বেঈমানি করেছে, বিধাতা ভুল জায়গায় পাশা খেলেছেন। আমি যে কোনো ছেলেকেই পাত্তা দেইনি, সে হাসনাতের সাথে জড়িয়ে গেলাম। সকাল নটা থেকে রাত নটা অবধি ক্লাশ, লাইব্রেরী, নোট,লান্চ ইত্যাদি সব ওর সাথে করা শুরু করলাম। আমিও যেন অল্প অল্প করে কাগজে আংগুল দিয়ে স্পর্শ করে ব্রেইলি অক্ষরগুলো আয়ত্ত করতে লাগলাম।

আমি নিয়মিত ক্লাসনোট, বইয়ের পৃষ্ঠা হাসনাতকে বলে যাই ও নিজের মতো করে কাগজে টুক টুক করে তোলে নেয়। কী সুন্দর এ ছন্দময় জীবন। মাঝে মাঝে আফসোস হয়-সারা জীবন প্রথম হয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ পর্যায়ে একটা অন্ধ ছেলের কাছে হেরে গেলাম। মা-বাবার স্বপ্ন ছিলো- প্রথম হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েই থেকে যাবো। আমারও সাধ ছিলো তাই।

কিন্তু হাসনাতের যে প্রখর শ্রবণ শক্তি, বিশ্লেষণের এতো পারদর্শিতা, বাগ্মীতার এতো নিপুনতা ,মনে হয় বিধাতা শুধু একদিকে না দিয়ে আর সবদিকে ওকে অন্য সবার চেয়ে হাজার গুন বেশি দিয়েছেন। তারপরও আমি নিয়মিত লাইব্রেরীতে মুখোমুখি বসে হাসনাতকে প্রতিটি কোর্সের নোট, বইয়ের পৃ্ষ্ঠার পর পৃষ্ঠা একাগ্রচিত্তে পড়ে শুনাই। আর ও পড়ালেখার ক্ষেত্রে অনেকটা আমার ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষার রেজাল্ট হয়। আমি হই প্রথম, হাসনাত অল্প মার্কসের ব্যবধানে ২য়।

আমার মনটা ভারী হয়ে যায়। ক্লাসে দেখি হাসনাত একটা রজনি গন্ধা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর পাশে যাই। হাসনাত বলে - শিউলি রজনিগন্ধা দিয়ে তোমাকে অভিবাদন জানালাম। এরপর কতদিন চলে গেছে, আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তুমুল জনপ্রিয় অধ্যাপিকা।

আর হাসনাত বিসিএস দিয়ে চলে গেছে কোনো এক মফস্বলের কলেজে। একদিন সন্ধ্যার ঠিক আগে ক্লাশ শেষ করে লাইব্রেরির সামনে দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছি। দেখি চোখে কালো চশমা আর সাদা ছড়ি হাতে একটা ছেলে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দেখে ভীষণ মায়া হলো। বুকের ভিতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠলো।

বাসায় এসে মনস্থির করলাম-যাই একবার হাসনাতকে দেখে আসি। বন্ধদের কাছ থেকে ফোন সংগ্রহ করে , ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হাসনাতের কলেজে এসে জানলাম- ওর কয়েকদিন থেকে বেশ জ্বর। ক্লাশে আসতে পারেনি। আমি একটা রিকসা নিয়ে ওর বাসায় আসি।

কপালে হাত দিয়ে দেখি বেচারা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। আমার হাতের স্পর্শেই হাসনাত বলে- এতোদিন পরে তুমি আসলে শিউলি। আমার বুকের ভিতর কেমন যেন করে- আর কতদিন চেপে রাখা যায়। আজকে যদি না বলি- জানিনা আর কবে বলা হবে। কবে আসা হবে আর এই মফস্বলে।

সবচেয়ে বড় কথা জীবনে এতো বড় পাপ -যদি হাসনাত ক্ষমা নাকরে তবে বিধাতাও মাপ করবেননা। হাসনাত আলতো করে -আমার হাতখানা ওর হাতের মুঠোয় নেয়। বলে এতো চুপ করে রইলে কেন। ক্ষমা চাইতে এসেছো বুঝি। আমিতো নিজেই তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

তুমি যখন বই থেকে পাঠ দিচ্ছিলে -আমেরিকান সিভিল ওয়ার শুরু হয়েছিলো ১৮৭১ সালে, এর পরদিন আবার বললে-ট্যারিফ ল লিখা হয়েছিলো ১৮৪০ সালে ই্ত্যাদি,ইত্যাদি। প্রতিদিন কিছু খুব সুক্ষণ ভুল পাঠ দিচ্ছিলে। তখনই আমি বুঝেছিলাম- স্যার বলেছিলেন-সাধারণত যারা ক্লাসে প্রথম হয়, তাদেরকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়া হয়। বিধাতা আমাকে দৃষ্টি শক্তিকে বন্চিত করেছেন, সুতরাং না পাওয়ার কষ্ট আমি বুঝি। তাই বলো তোমাকে আমি প্রথম হওয়া থেকে বন্চিত করি কেমন করে।

আমি ঢুকরে কেঁদে ওঠি। অতি ক্ষুদ্র কীট মনে হয় নিজেকে। নীরবে, নিভৃতে, গোপনে কত সহজে ও আমাকে হারিয়ে দিলো। মনে হলো -আমি যেন এক স্বর্গীয় দেবদূতের শিয়রের পাশে পতংগ হয়ে বসে আছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।