আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'বহমান হে উদার অমেয় বাতাস'

ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা

এখন থেকে 20 বছর আগে আমেরিকায় এসে অনেককিছু ওলট-পালট হয়ে গেলো। বিশুদ্ধ বঙ্গদেশীয় পরবাসী হয়েছে, তার ভালোমন্দ প্রতিক্রিয়া কিছু হবেই। কালচারাল শক (বাংলায় কি বলা যায়, সাংস্কৃতিক ধাক্কা বা চমক?) বলে একটা কথা জানা ছিলো। ছোটোখাটো কিছু বিষয় তেমন গায়ে লাগে না। দেশে দেখেছি, লোকে রাস্তার ডান দিক দিয়ে হাঁটে, গাড়ি বাঁ দিকে।

এদেশে ঠিক তার উল্টো। রাইট হুইল ড্রাইভের বিপরীতে এখানে লেফট হুইল ড্রাইভ। যে শব্দটিকে বরাবর জানতাম সেমি-ফাইনাল, এখানে শুনি তা সেমাই ফাইনাল। শিডিউল হয়েছে স্কেজু্যল। ঢঁ্যাড়সের ইংরেজি শিখেছিলাম লেডিজ ফিঙ্গার, বেগুন ব্রিঞ্জাল।

আমেরিকায় তারা যথাক্রমে ওকরা এবং এগপ্ল্যান্ট। পেট্রল শব্দটি এখানে চলে না, বলতে হবে গ্যাসোলিন বা সংক্ষেপে গ্যাস। ফলে, পেট্রল পাম্প এখানে গ্যাস স্টেশন। সেই সময় বাংলাদেশে ফাস্ট ফুড বলে কিছুর অস্তিত্ব দূরে থাক, ধারণাও ছিলো না। এ দেশে ম্যাকডোনাল্ডস, বারগার কিং, কেএফসি জাতীয় ফাস্টফুড-কেন্দ্রিক মানুষের খাদ্যাভ্যাস।

এরকম আরো অনেককিছুর একটা বড়োসড়ো তালিকাই তৈরি করে ফেলা সম্ভব। প্রতিদিনের ব্যবহার্য এইসব আস্তে আস্তে সয়ে যায়, বলতে, শুনতে এবং চর্চা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। কিন্তু যা আজও হজম করা সম্ভব হয়নি _ আমেরিকায় লিবারেল শব্দটি প্রায় একটি গালিবিশেষ। আমেরিকা নামের যে দেশটি ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা ইত্যাদির স্বনির্ধারিত পাহারাদার, সেখানে উদারপন্থী হওয়া দোষের, ভাবা যায়! এ দেশীয়রা ব্যক্তিগত জীবনাচরণ ও পোশাক-পরিচ্ছদে উদার, বিশেষত করে অনেক মেয়েরই পরিধেয় যা থাকে তাকে শুধু উদার বললে নিতান্ত কমই বলা হয়। ফ্যাশনে যা কিছু নতুন তা নিতে উদারতার অভাব নেই।

তারা ভারতীয় নারীদের অনুকরণে নাক ফুটো করতে রাজি, হাত মেহেদিতে রাঙাতে আপত্তি নেই। ন্যায্য-অন্যায্য যৌনসম্পর্ক স্থাপনেও উদারপন্থা প্রচলিত (বস্তুত, ক্লিনটন-মনিকা কাহিনী এ দেশের ঘরে ঘরে পাওয়া যাবে এবং সম্ভবত সে কারণেই ইমপিচমেন্টের কালেও ক্লিনটনের জনপ্রিয়তায় কিছুমাত্র ঘাটতি হয়নি), সেখানে ধর্মীয় বা নৈতিক অনুশাসনের কামড় নেই। অথচ ওই উদার সম্পর্কের প্রতিক্রিয়ায় গর্ভসঞ্চার হলে বাচ্চাটি রাখা বা না রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা মেয়েদের দিতে আপত্তি। তখন তা আর ব্যক্তিগত বিষয় নয়, সামাজিক ও সামষ্টিক। অজুহাত মূলত ধর্মীয় অনুশাসনের হলেও মুখে বলা হবে ভ্রুণহত্যা অনৈতিক।

ঠিক তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে, বোমা ফেলে ইরাকে শিশুহত্যার ঘটনায় তাদের নৈতিকতার বোধ নিদ্রামগ্ন। ব্যাপারটিকে তখন জাতীয় শৌর্য-বীর্য ও দেশপ্রেমের মোড়কে বেঁধে ফেলা হয়। অথচ অন্য একটি সংস্কৃতিকে বা সেই সংস্কৃতির মানুষদের সম্মানসূচকভাবে দেখার বা তাদের বোঝার ধৈর্য ও উদার বিবেচনা সেখানে অনুপস্থিত। বছর কয়েক আগে ভারতে ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের মৃতু্যর খবরে একটি রেডিও টক শো-তে একজনকে বলতে শুনলাম, এমন তো হবেই, ওরা যে যীশুখ্রীষ্টকে মানে না! শুনে বিশ্বাস করা কঠিন, একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ এমন অযৌক্তিক ও তীব্র সামপ্রদায়িক কথা উচ্চারণ করতে লজ্জাবোধ করে না। আমেরিকার সামপ্রতিক হারিকেন কাটরিনা ও রিটার প্রতিক্রিয়ায় মানুষের যে অভূতপূর্ব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার বেলায় রেডিওর ওই লোকটি কী বলে যদি জানতে পারতাম! ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর অধিকাংশই তো যীশুর অনুসারী।

ধর্মান্ধরা সব দেশেই এসব ক্ষেত্রে আল্লাহর গজব আবিষ্কার করে থাকে। সাধারণ যুক্তিতেই বোঝা সম্ভব, প্রকৃতির শক্তি ও তাণ্ডব তার শিকার মানুষগুলির বা অন্য সকল প্রাণীর ধমর্ীয় পরিচয় মোটেই বিবেচনায় রাখে না। অথচ রক্ষণশীল প্রচারে তাকে একটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা হয়ে থাকে। কৌশলটি অতি পুরনো। এ দেশে সর্বত্র লিবারেলদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়।

নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া বা জন কেনেডির অঞ্চল ম্যাসাচুসেটস রাজ্য ছাড়া আমেরিকার প্রায় সর্বত্র রক্ষণশীলদের প্রবল দাপট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোটের জয়-পরাজয়ও নির্ধারিত হয়ে যায় সেখানেই। নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যে গায়ে লিবারেল ছাপটি লাগিয়ে দিতে পারলেই হলো। আমেরিকার গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জন কেরির পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিলো তাঁর লিবারেল পরিচয়। বুশ জুনিয়রকে দ্বিতীয় টার্মের নির্বাচন ঠেকানোর জন্যে মুক্তচিন্তার অনেক মানুষই মাঠে নেমেছিলেন।

রক গায়ক ব্রুস সপ্রিংস্টিন যদিও কোনোদিন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হননি, তিনিও এবার সারা আমেরিকায় কনসার্ট করে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এই সপ্রিংস্টিন তাঁর বিখ্যাত বর্ন ইন দ্য ইউএসএ গানটি রক্ষণশীল রেগ্যানকে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহারের অনুমতি দেননি এবং দক্ষিপন্থী দর্শনের তিনি প্রত্যক্ষ বিরোধী। এদিকে মাইকেল মোর ফারেনহাইট নাইন ইলেভেন নামে ডকুমেন্টারি তৈরি করলেন বুশ ও রক্ষণশীলদের কাণ্ডকীর্তি বিবৃত করে। ছবিটি নিয়ে প্রচুর হৈ চৈ হলেও তা নির্বাচনে কেরির বাঙ্ েভোট হিসেবে রূপান্তরিত হয়নি। মজার কথা, যাঁরা সত্যিকারের লিবারেল বা উদারপন্থী, তাঁরাও বিপুল পরিমাণ সময় ও সামর্থ্য খরচ করেন নিজেদের রক্ষণশীল প্রতিপন্ন করার জন্যে।

শুধু আমেরিকা নয়, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পতনের পর এটি সারা পৃথিবীতেই মহামারীর লক্ষণযুক্ত এক নতুন প্রবণতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। দেখেশুনে মনে হয়, বড়ো ধোঁয়াশাময় একটি সময় আমরা অতিক্রম করছি। উদারপন্থীদের মধ্যে প্রকৃত চরিত্র ও আদর্শ উহ্য রেখে নিজেদের অন্য কারো মতো, আরো স্পষ্ট করে বললে দক্ষিণপন্থীদের মতো করে, দেখানোর ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। উদারপন্থীরা স্পষ্টতই দ্বিধাগ্রস্ত আজ। কিন্তু তাতেও যে শেষরক্ষা হয় না।

আমেরিকায় এর উদাহরণ হয়ে রইলেন গত দুই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলীয় প্রার্থী জন কেরি এবং তার আগের অ্যাল গোর। বাংলাদেশে বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একই দশা হয়েছে, তারা সম্ভবত রক্ষণশীলদের চেয়েও বড়ো রক্ষণশীল হিসেবে দেখাতে চেয়েছে নিজেদের। পুরনো পাগলে যেখানে ভাত পায় না, নতুন পাগলের আমদানি হলে মানুষ তাকে সন্দেহের চোখে দেখবেই। এই শ্রেণীর রাজনীতিকরা নির্বাচকদের যতো অবোধ বিবেচনা করেন, তারা যে তা নয় তার প্রমাণও ভুরি ভুরি। লিবারেল তকমাটিকে উপেক্ষা করে বা পুঁজি করেই আমেরিকায় সর্বশেষ নির্বাচন জিতেছিলেন বিল ক্লিনটন।

ভারতে বিগত নির্বাচনে রক্ষণশীল বিজেপির নিশ্চিত বিজয়ের যাবতীয় হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে স্বচরিত্রে বহাল থেকেই ক্ষমতা দখল করেছে অপেক্ষাকৃত উদারপন্থীরা। আমরা যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী এবং সত্তর দশকে যুবকবয়সী, তাদের পক্ষে লিবারেলিজম বা উদারপন্থাকে গ্রহণ না করা একপ্রকার অসম্ভব। সেদিনের বাংলাদেশে, যখন সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখার মতো মানুষের অভাব ছিলো না এবং স্বপ্ন দেখানোর মানুষও কিছু ছিলেন, উদারপন্থী না হয়ে ওঠাটাই ছিলো অস্বাভাবিক। তখনো বাংলাদেশে রক্ষণশীল মানুষ ছিলো না, এমন নয়। সব দেশে সব সময়েই তারা থাকে।

কিন্তু তারা সেদিন ছিলো মূল স্রোতের একেবারে বাইরে। তাদের ধার এবং ভার কোনোটাই গ্রাহ্যের মধ্যে ছিলো না। আজ অবস্থা বদলেছে। উদারপন্থীরা পৃথিবী জুড়েই পিছু হটছে। হয়তো রক্ষণশীল হতে পারাটাই এখন বেশি ফ্যাশনেবল।

বাংলাদেশও সারা পৃথিবীর এই প্রবণতার, বিশ্বায়নের বাতাসের অংশীদার হতে ইচ্ছুক। নিজেদের মধ্যে তত্ত্বের বিভাজনে বিভক্ত হতে হতে উদারপন্থী মানুষেরা সংখ্যালঘু শুধু নয়, বিলীয়মান প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া মানুষগুলোকে কোনোভাবে আজকের বাংলাদেশে এনে হাজির করতে পারলে তারা যা প্রত্যক্ষ করবে, তা-ও কালচারাল শক বটে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।