আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাফ নদীর তীরে...কিম্বা তীরের পাশেই নাফ নদী...(শেষ পর্ব)

কখনো চাই নাই দূরে থাকি...তবু দূরগুলো বারে বারে আসে...

এখনো বার্মিজ পণ্যই রোহিঙ্গাগো মধ্যে জনপ্রিয়। আমারে আলমগীর মাস্টর দাওয়াত দিছিলো চা খাওনের, কিন্তু চায়ের বদলে যা দিলো সেইটার ভয়ে বাল্যকালে আমি বহুতবার ছাদের কোনায় গিয়া পালাইয়া থাকতাম...সেই হুইট বেইজড সেরিয়াল, আমরা খাইতাম ব্রিটিশ কোয়েকার ব্র্যান্ড। আলমগীর মাস্টর আমারে ঐ বার্মিজ ক্যালসাম মিনিপ্যাকের গায়ে লিখা সব গুণাগুণ পইড়া শুনাইলো...তার ইংরেজী পঠন ঝরঝরে। ক্যাম্পে বার্মিজ পণ্য কোত্থেইকা আসে? এই প্রশ্নের উত্তর তারা সবসময় এড়াইয়া গেছে...আলমগীর একবার বলছে বামর্া থেইকা যারা আসে তারা নিয়া আসে। বার্মায় লোকজনের যাতায়াত এখনো আছে...আর সেইটা বলা যায় নির্বিঘনেই ঘটে...দশ টাকার মতো দেনিক আর পণ্যভেদে মাসোহারা...এই হইলো অবস্থা।

তয় চোরাচালানের এই বাস্তবতা কেউ স্বিকার করে নাই, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এই দেশে অবস্থানের জন্য হুমকী হইতে পারে এইরম কোন তথ্য ছাড়া নিজেগো আর সব কিছু মেইলা দিতে পারে। আলমগীর আমারে প্রায় জোর কইরাই তার ঘরে নিয়া গেলো। ছোট্ট একটু ঘর। 10 ফিট বাই 15 ফিট। আমি গিয়া দেখি তার বাড়ির সবাই আমার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে।

তার বাবা চেয়ার ছাইড়া দিয়া উইঠা দাঁড়াইলো...আমারে বসতে জায়গা কইরা দেওনের লেইগা। তার মা শাড়ি পরছে কুচি দিয়া। একদম বাঙালী পরিবার য্যান! ঘরে ঢুইকা দেখি ঘরময় খাট...তাতে বইসা আছে দুইটা মেয়ে, আর এককোনায় একটা বাচ্চা ছেলে মোমবাতি জ্বালাইয়া পড়তাছে... আমি অন্ধকার আর ঘরের আটকা আটকা ব্যাপারটা নিতে না পারনে, বের হইয়া আসলাম সাথে সাথে। বের হইয়া আসনের পর আলমগীরের বায়না তার মা বাবার ছবি নিতে হইবো ক্যামেরায়। পেছনে দ্্বীন মুহাম্মদ মাঝির নিষেধাজ্ঞা...তারপরও আমি তুললাম ঘরের ছবি, আলমগীর মাস্টরের মেম্বার মা আর প্রাক্তন মাঝি নুর ইসলামের ছবি।

ছবি তোলাতে ভীষণ আগ্রহ দেখলাম রোহিঙ্গা পল্লীতে...এরপরেই আমার যাইতে হইলো আলমগীর মাস্টরের বৌয়ের বাড়ির সামনে, সেইখানে আরো সখি সমেত সে সাজগোজ করতেছিলো, থামি আর টপ পরনে, চন্দন চক্রে এই সব মেয়েদের মুখের সাথে আমি রাখাইন মেয়েদের পার্থক্য খুব একটা পাই নাই, চোখের টানাটানা ভাবটা ছাড়া। আমি বের হইয়া আসার মুখে আবার ইনসপেক্টরের সাথে দেখা করতে গেলাম। সে দেখলাম বেশ খোশমেজাজে তখনো...শুনলাম বদলী হইছেন কক্সবাজার শহরে, মানে সমূহ পয়সার মুখ দেখবেন শীঘ্রই। তিনি আমারে ঢোকার আগেই ছবি তোলার ব্যাপারে সতর্ক করছিলেন অথচ ফেরার সময় যাইচাই কইলেন আমি পত্রিকায় লেখালেখি করি কিনা, যদি লেখনের সুযোগ থাকে তাইলে যাতে রোহিঙ্গাগো বার্মায় ফেরত পাঠানের ব্যাপারে কোন কিছু লেখি। এই জনগোষ্ঠীরে আসলে বাংলাদেশে রাখনের কোন যৌক্তিক ভিত্তি নাই।

নিজেরাই আমরা জনসংখ্যার ভারে টিকতে পারি না, তার উপর রোহিঙ্গারা আসলে ঘনত্ব আরো বাড়বো। রোহিঙ্গারা খুবই খারাপ জাতি এইটা বলতে গিয়াও সম্ভবতঃ আমার আগ্রহী চোখ দেইখা সুযোগসন্ধানী পুলিশ কর্মকর্তা থাইমা গেলেন। আমি বের হইয়া আসলাম ক্যাম্প থেইকা, টেকনাফ শহরে ফিরতে হইবো। মৌসুমরে নিয়া একবারে বাইর হইয়া যামু, মাইক্রোবাসে কক্সবাজার শহর তারপর অনিশ্চয়তার ভ্রমণ আবার। টেকনাফ ফিরা দেখি মৌসুম ব্যাগ গুছাইয়া ফেলছে, আমরা রওনা দিলাম।

টেকনাফ থেইকা ঢাকা ফিরা আসনের পথে মনে হইলো fortune favours the brave চিটাগাং পর্যন্তলোকাল বাসে আইসা গ্রীন লাইনের স্ক্যানিয়া বাসের টিকেট পাইয়া গেলাম! তারপর নিশ্চিত ঘুমে চইলা আসলাম নিজের জায়গায়...নিজের শহর ঢাকায়! উপসংহারঃ রোহিঙ্গারা এই দেশে আছে বেশ ভালোই, এনজিও আর বাংলাদেশ সরকার ভালোই রাখছে রিফু্যজি ক্যাম্প গুলিরে...জীবন যাপন যদি খাওয়া দাওয়া, ঘুম আর যৌনতার চাহিদা হয় তাইলে রোহিঙ্গারা গড়পড়তা বাঙালীগো চেয়ে আছে রাজার হালেই, কিন্তু আসলেই জীবন মানে কি খালি এইসব? নিজের পরিচিত শহরে ঢোকার মুখে আমার মনে হইছে এই শহরের মালিকানা আমার, এইখানেই আমার সকল ছায়া-ছোঁয়া কিম্বা আহ্লাদ মিশা আছে। নিজের শহরে অনেক একলা থাকলেও যেন সঙ্গ দ্যায় ইট-কাঠ-বালু-পিচ ঢালা রাস্তা। এই অনুভুতি অনেক শক্তিশালি করে নিজেরে। রোহিঙ্গাগো এখন উৎসব-পার্বণ হয় এনজিও ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। তারা বিশ্ব এইডস দিবসে অনুষ্ঠান করে।

কিন্তু এইচ আই ভি সংক্রমিত হওনের সম্ভাবণা তারা নিজেরা প্রায় নাকচ কইরাই দিলো...দোষ চাপাইলো সাদা চামরার এনজিও প্রতিনিধিদের উপর। রোহিঙ্গা মেয়েগো সাথে তাগো যৌন অভিজ্ঞতার কথা আলমগীর আর দ্্বীন মুহাম্মদ দুইজনই স্বিকার করলো...আমি এতে যেন এক চাপা ক্ষোভ টের পাইলাম। তারা আসলে কারো সিদ্ধান্ত মতে পরিচালিত হইতে চায় না, যে কোন সাধারণ মানুষের মতোই। নাফ নদীর সৌন্দর্য্যে ধোয়া শরীরে তারা এখন আর স্বপ্ন আঁকতে পারে না। পালানের স্বপ্ন দেখে প্রত্যেক রোহিঙ্গা, এই পলায়ণ কোন গহীনে না...বরং জনারণ্যে....মানুষের আরো গভীরে...অনেক মানুষের ভীরে...


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।