আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পর্ব-৪- ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের মাঝে ঝগড়া ও বিরোধের ইতিহাসঃ শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতা

ভাল কথা বলুন শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতাঃ পর্ব-১ - হাদীস সংকলনের ইতিহাস। পর্ব-২- বুখারী হাদীস গ্রন্থ ত্রুটিমুক্ত নয়ঃ শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতা পর্ব-৩- ইমাম বুখারীর হাদীস সত্যায়ণ করার পদ্ধতির ভুল ভ্রান্তিসমূহঃ শরীয়া আইন এর অনুপযোগিতা বিস্তারিত আলোচনা করার আগে একটি কথা বলে নেয়া দরকার যে এই পোস্টে কোন শিয়া আলেম বা গ্রন্থের রেফারেন্স দেয়া হচ্ছেনা। আমার পোস্ট পড়ার পর অনেকে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর মত টপ ক্লাস সুন্নি ইমাম যার বদৌলতে আপনাদের ঘরের লাইব্রেরীতে দশ খন্ডের বুখারী শরীফটি শোভা পায় সেই ইমামকেই শিয়া ইমাম বলে মনে করছেন। তাই কিছু ভেবে নেয়ার আগে সাবধানে ভাবার অনুরোধ রইল। মোহাবিষ্ট মুসলিমের ধারণা ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম ছিলেন ফেরেশতা তুল্য মহান আলেম।

এই ইমামদ্বয় মিলেমিশে বহু কষ্ট করে হাদীস সংকলণ করেছেন, তারা ছিলেন একে অপরের সম্পূরক, পরিপূরক। কিন্তু বাস্তব সত্য এইসব ধারণার পুরোপুরি বিপরীত। এই ইমামদ্বয় ও তাদের হাদীস শিক্ষক ইমাম যুহলীর মাঝে ছিল ব্যাপক বিরোধ। ইমাম বুখারীর সার্টিফিকেট প্রাপ্ত কিছু হাদীস বর্ণনাকারীকে ইমাম মুসলিম অগ্রহণযোগ্য বলে পরিত্যাগ করেছিলেন আবার ইমাম মুসলিমের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত কিছু হাদীস বর্ণনাকারীকে ইমাম বুখারী অগ্রহণযোগ্য বলে পরিত্যাগ করেছিলেন। সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইমাম ত্রয়ের মাঝে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিবাদ লেগে যায় যাতে ইমাম বুখারীর ক্যারিয়ার পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যায়।

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানীর ''ফাথ আল বারী'' গ্রন্থের ''ইমাম বুখারীর জীবনচড়িত'' অধ্যায় থেকে জানা যায়ঃ ২৫০ হিজরীতে ইমাম বুখারী নিশাপুর বসবাস করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাকে অভ্যররথনা জানাতে ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইমাম যুহলী উপস্থিত ছিলেন। নিশাপুরে ইমাম বুখারীর তিনিদিন ব্যাপী একটি ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। ইমাম যুহলী বিশ্বাস করতেন যে পবিত্র কোরআন কোন সৃষ্টি নয়, কিন্তু তিনি জানতেন যে ইমাম বুখারীর বিশ্বাস ভিন্ন ছিল। তাই নিশাপুরের জনসাধারণকে ইমাম যুহলী পূর্বেই বলে রেখেছিলেন যে ''কোরআন একটি সৃষ্টি কিনা'' এই বিষয়ে কেউ যেন ইমাম বুখারীকে কোন প্রশ্ন না করে।

ইমাম যুহলী এই চিন্তায় ভীত ছিলেন যে ইমাম বুখারীর উত্তর শুনে লোকে ইমামদেরকে হাস্যাস্পদ মনে করবে আর বলবে যে ইমামদের মাঝেই সমঝতা নেই। ইমাম বুখারীর প্রথম দুই দিনের ভাষণ ভালয় ভালয় শেষ হয়েছিল, কিন্তু তৃতীয়দিনে এক ব্যাক্তি ঠিকই প্রশ্ন করে বসেন যে পবিত্র কোরআন একটি সৃষ্টি কিনা। যথারীতি ইমাম বুখারীর উত্তর হয় ইতিবাচক। এতে সেখানে গোলযোগ লেগে যায়। ভাষণের স্থানের মালিক সবাইকে তার বাড়ি ত্যাগ করতে বলেন।

পরে ইমাম যুহলী ঘোষনা দেন - ''কোরআন কোন সৃষ্টি নয়। যে কোরআনকে সৃষ্টি বলে সে আসলে ধর্মে নতুনত্ব আনতে চায়, তাই সকলেই যেন সেই লোককে এড়িয়ে চলে। এরপর যে কেউ ইমাম বুখারীর সভায় যোগদান করবে তাকেও ধর্মে নতুনত্ব সৃষ্টিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। '' এরপর থেকে সকলেই ইমাম বুখারীকে পরিত্যাগ করেছিলেন। ইমাম মুসলিম আর ইমাম বুখারীর হাদীস তার গ্রন্থে স্থান দিতেন না।

ইমাম বুখারীও ইমাম যুহলীর বর্ণনা করা হাদীস অন্য ব্যক্তির নাম দিয়ে লিপিবদ্ধ করতেন। এর কিছুদিন বাদে ইমাম যুহলী আবার বলেন যে ইমাম বুখারীর সাথে একই শহরে বসবাস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অগত্যা ইমাম বুখারীকে নিজ শহর বুখারায় যাত্রার উদ্দেশ্যে নিশাপুর ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু নিজ শহর বুখারায় এসে ইমাম বুখারী আবিষ্কার করেন যে এখানকার জনসাধারণ তার প্রতি আরও বেশী শত্রুভাবাপন্ন। নিজ শহরে বাস করাই তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ালো।

এজন্য তিনি সমরখন্দের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে জানতে পারেন যে সেখানেও একই অবস্থা। এর কিছুদিন পরেই ইমাম বুখারী মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম মুসলিম তো ইমাম বুখারীর হাদীস সংকলণের পদ্ধতিকেই মিথ্যা ও নতুনত্ব বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বুখারীকে ইঙ্গিত করে নিম্নোক্ত কথাগুলো তার সহিহ মুসলিম গ্রন্থের মুয়ান'আন অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করেনঃ আমাদের সময়ে কিছু লোক মনে করেন যে তারা হাদীসের স্কলার।

তারা হাদীস সত্যাসত্য করার জন্য মিথ্যা শর্ত বানিয়েছেন। তাদের মাঝে একজন (ইমাম বুখারী) বলেন, '' যখন আপনি কোন হাদীস বর্ণনাকারীর কাছ থেকে হাদীস শুনবেন তখন আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে বর্ণনাকারী এবং তার আগের বর্ণকারীর মাঝে সম্মুখ সাক্ষাত ঘটেছিল। এটা যথেষ্ট নয় যে তাদের জীবণকাল একই সময়ে ছিল। '' এই শর্তটি একটি মিথ্যা শর্ত কেননা আগের কোন মহান স্কলার এমন কোন শর্তের কথা উল্লেখ করেন নাই। এই শর্তটি মহা ভুল, আমি এই শর্তের বিরোধীতা করি যাতে স্বল্প জ্ঞানীরা এটা বিশ্বাস না করে।

এছাড়া ইমাম মুসলিম কিছু কিছু হাদীস বর্ণনাকারীকে অনির্ভরযোগ্য মনে করতেন, তাদের সমালোচনা করতেন এবং তাদের বলা হাদীস গ্রহণ করতেন না অথচ তাদের বলা হাদীস বুখারীর বইতে ঠিকই স্থান পেয়েছে। ইমাম আসকালানীর ''তাহজিব আল তাহিজিব'' গ্রন্থের ভলিউম ১০ পৃষ্ঠা ৪৬১ এ এমন কিছু উদাহরণ দেয়া আছে। যেমন, বুখারী শরীফে একজন বর্ণনাকারী আছেন যার নাম نعیم بن حماد مروزی নাঈম বিন হাম্মাদ যাকে ইমাম মুসলিম গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না। পরবর্তী বহু স্কলারও উনাকে নির্ভরযোগ্য মনে করতেন না। অন্যদিকে ইমাম মুসলিম নিজেও যে খুব পন্ডিত ছিলেন তা কিন্তু নয়।

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী তো ইমাম মুসলিমকে একজন নকলবাজ অসৌজন্যময় হাদীস সংকলক বলে অভিহিত করেছিলেন। ইমাম আসকালানী ''ফাথ আল বারী'' গ্রন্থের ''ইমাম বুখারীর জীবনচড়িত'' অধ্যায়ে লিখেছেনঃ ইমাম বুখারী মূল হাদীসগুলো সংগ্রহ করেছিলেন এবং মানুষকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। ইমাম বুখারীর পর যে হাদীসই লিখিত হয়েছে তা বুখারী শরীফের রেফারেন্সেই হয়েছে। ইমাম মুসলিমের গ্রন্থটি বুখারী শরীফের হাদীস দ্বারা পরিপূর্ণ। ইমাম মুসলিম বুখারী শরীফ থেকে নকল করে একটি হাদীস গ্রন্থ লিখেছেন অথচ ইমাম বুখারীর নাম উল্লেখ করার মত সৌজন্যতাটিও দেখাননি।

ইমাম দার কুতনি বলেছিলেন যে যদি ইমাম বুখারী বলে কেউ না থাকত তাহলে ইমাম মুসলিম এর নামই কেউ শুনত না। ইমাম মুসলিম বিষেষ কিছুই করেন নাই, তিনি যা করেছেন তা হচ্ছে বুখাড়ি শরীফ থেকে বেশিরভাগ হাদীস নকল করে নিজে কিছু হাদীস সংগ্রহ করে তার হাদীস গ্রন্থটি সম্পন্ন করা। এসব ঘটনা থেকে এই প্রশ্নই মনে আসে যে হাদীস সংকলনের মত মহান একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই সব ইমামদের মাঝে সামান্য কারণে এত ভেদাভেদ সৃষ্টি হয় কিভাবে? আসলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে কারণটি সামান্য মনে হলেও রাজনৈতিক ও ক্ষমতার দিক থেকে এটি সামান্য কারণ ছিলনা। এই ইমামরা ছিলেন সমাজের সবচেয়ে বরেণ্য ব্যক্তি। এই ক্ষমতা ও সম্মান তারা উপভোগ করতেন।

ইমাম যুহলী সেই ভয়েই চাইতেন না যে তাদের মাঝে মতপার্থক্যের কারনে সমাজে তাদের ক্ষমতা ও সম্মান ক্ষুণ্ণ হোক। কিন্তু ইমাম বুখারীর সেই ভাষণে এক বেয়াড়া প্রশ্নকারীই মূল ঝামেলাটা বাধিয়ে ফেলে। তখন নিজ ক্ষমতা ও সম্মান বজায় রাখার জন্য এক মুহুর্তে ইমাম যুহলী ইমাম বুখারীর সমস্ত হাদীস অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা দিতে একবিন্দু দ্বিধা করলেন না অথচ এই হাদীস গুলোই এতদিন সত্য বলে স্বীকার করে আসছিলেন। এই ইমামরাই বলেন যে যারা সত্য হাদীস গোপন করেন তারা জাহান্নামী, তবে ইমাম যুহলী নিজেই কি জাহান্নামী হয়ে গেলেননা? নবীর রওজা মোবারকের পাশে বসে যখন বর্তমান যুগেও লোকে মিথ্যা বলে, নামাজ পড়ার আগে পরে যখন একালেও লোকে মিথ্যা বলে আর ইমাম বুখারী রওজা মোবারকের পাশে বসে হাদীস সাজানো, প্রতিটি হাদীস লিখার আগে আলাদা করে গোসল করে ২ রাকাত নামাজ পড়ার উদাহরণ দিয়ে হাদীসকে সত্য মহাসত্য বলে ঘোষণা দেন তখন সেখানে সম্মান ও ক্ষমতার উদ্দেশ্য কি খুব একটা চাপা থাকে? এই পোস্টের ২য় পর্বে আলোচিত সকল সুন্নি আলেম কর্তৃক স্বীকৃত বুখারী শরীফের ভুলগুলোই তো প্রমাণ করে যে ইমাম বুখারীর এই পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছিল। যা সত্য তা এমনিতেই সত্য, এর জন্য রওজা মোবারকের দোহাই দেয়া লাগেনা।

কারণ রওজা মোবারকের পাশে বসলেই যে সকল মিথ্যা সত্য ইথেকে চট করে আলাদা হয়ে যাবে এমন আজগুবি প্রমাণ কেউ পায়নি। এছাড়া ইমাম বুখারী দাবী করতেন যে তার গ্রন্থে মিথ্যা হাদীস যেন না ঢুকে সে জন্য তিনি সবসময় নবীর একটি চুল মোবারক সঙ্গে রাখতেন। স্বভাবতই এখানেও প্রশ্ন আসে, নবীর মৃত্যুর ২৫০ বছর পর নবীর চুল মোবারক ইমাম বুখারী কিভাবে পেলেন? এতদিন কি চুল তাজা থাকতে পারে? চুলের সাথে সত্য মিথ্যার সম্পর্ক কি? নবীর চুল দিয়ে তো বরং নবীর উপর যাদু টোনা করা হয়েছিল। অথচ দুঃখের বিষয় হচ্ছে হাদীসের সত্যতা পরীক্ষার এইসব হাস্যকর নমুনা শুনে মোহাবিষ্ট মুসলিম এগুলোর ফাঁকিগুলো ধরা দূরে থাক এগুলোকেই অলৌকিক মনে করে ভেবে নেয় যে বুখারী, মুসলিম শরীফে ভুল হাদীস থাকতেই পারেননা ! এতকিছুর পরও আরও কথা আছে। বর্তমান যে বুখারী শরীফ আমাদের হাতে আছে, অনেকেই সেটিকে একটি অবিকৃত নির্ভেজাল গ্রন্থ বলে মনে করেন যা সরাসরী ইমাম বুখারীর তরফ থেকে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।

কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে বর্তমান বুখারী হাদীস গ্রন্থটি অনেক বিকৃতি, এডিটিং এর পর বহু ভেরিয়েশনে ভাগ হয়ে, এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে, কিছু অংশ চীরতরে হারিয়ে গিয়ে, কিছু অংশ কিছুটা পরিবর্তীত হয়ে অবশেষে একটি গ্রন্থ হয়ে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। অর্থাত বর্তমান বুখারী শরীফ আর ইমাম বুখারীর লিখা বুখারী শরীফ ঠিক একই রকম নয়। পরবর্তী পর্বে এ ব্যাপারে আলোচনা করা হবে। চলবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।