আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাড়ি ফেরার কদম গাছ-6

খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।

ভিখিরিদেরকে খাওয়ানো হয়ে গেলে আমরা ঝর্নার ওপারের কুয়োতে যাই । জায়গাটার নাম ঝর্নার পার । কোন এক কালে এখানে হয়ত এক ঝর্না ছিল যার থেকে জায়গাটার নাম ঝর্নার পার ।

দরগাহ চত্ত্বর পেরিয়ে সরু ছোট্ট এক গলি দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই সেই কুয়ো । যাতে থাকে সোনালী মাগুর, সোনালী কই, নীল কই ও আরও অদ্ভুত সব রঙের মাছ । কুয়োটা ঘিরে বেশ বড় একটা জায়গা ঘরের মত ঘিরে আছে দেওয়াল। কিন্তু কোন ছাদ নেই । সরু দরজা দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে ছোট্ট এক পুকুর যাতে খুব জোর হাঁটু অব্দি জল ।

আর সেই পুকুরের চারধারের সাথে তলাটাও বাঁধানো । যেখানে লোকজন টাকা ফেলে । দশ পয়সা পঁচিশ পয়সা পঞ্চাশ পয়সা এক টাকা পাঁচ টাকা দশ টাকার সব নোট। জলের মধ্যে মানুষ টাকা ফেলছে । তিরতির করে সরু নালি বেয়ে যেখান থেকে জল পড়ছে সেটা পাশের ঐ কুয়ো।

বাঁধানো চত্ত্বরে দুই থাক সিড়ি বেয়ে কুয়োর দেওয়াল যেখানে শেষ হয়েছে আমি দাঁড়ালে আমার গলা আব্দি সেই দেওয়াল। কুয়োআর মুখ ঢাকা মোটা লোহার জালি দিয়ে । জালির ফাঁক গলিয়ে কুয়োর দেওয়ালে হাত দিয়ে পিটে পিটে ডাক দেই, আয়, মাদারি আয় । । আয়, মাদারি আয় ।

। জলের তলা থেকে উপরে এসে মুখ বাড়ায় সোনালী মাগুর, সোনালী কই । নীল কই । আরও সব অদ্ভুত সুন্দর মাছ । বিভিন্ন রঙের।

জলের উপরে উঁকি দিয়েই আবর পালিয়ে যায় জলের তলায় । কেউ একবার দেখেই চলে যায়। কেউ বা বারবার দেখতে চায় বলে বারে বারে ওদের ডাকে। আয়, মাদারি আয় । ।

কুয়োর পাশের ঐ পুকুরে সরু নালি দিয়ে যেখানে জল পড়ছে অনেকে সেই জল বোতলে করে ভরে নিয়ে যায় । এত আস্তে জল গড়ায় যে ছোট্ট একটা বোতল ভরতে আধ ঘন্টা লেগে যায় । কাকিমা প্রতিবার বোতলে করে সেই জল নিয়ে আসে । গেটের পাশে এক লোক বসে এই জল বিক্রীও করে । সে আগে থাকতে বোতলে জল ধরে রাখে ।

যাদের তাড়া থাকে তারা ঐ আগে থেকে ভরে রাখা জলের বোতল কিনে নিয়ে যায় । কাকিমার মত অনেকে আছে যারা দাঁড়িয়ে থেকে বোতলে জল ভরে, তবে নিয়ে যায়। ভক্তিভরে সেই জল প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েক ফোঁটা খায় । এই পবিত্র জলের কল্যাণে যদি মনোস্কামনা পুর্ণ হয় । আর ছিল আমার প্রিয় সেই জায়গাটা, সেই চারপাশ বাঁধানো পুকুর।

আমি সিঁড়িতে এসে দাড়ালে পায়ে এসে আদর করত বিশাল বিশাল গজার (মহাশোল) মাছ । এখন সেই মাছগুলো আর নেই । জামাত-ই-ইসলামীরা একদিন রাতের অন্ধকারে বিষ ছড়িয়ে দেয় । তাদের কথায়, মাছ পোষার নাম করে পুজো করা হচ্ছিল । তাই বিশাল এক পুকুর ভরতি বিরল প্রজাতির সব মাছ মরে গেল ।

ওয়া মিনান্নাসি মাইঁ ইয়াত্তখিযু মিন্ দূ নিল্লাহি আন্দাদাইঁ ইউহিব্বূ নাহুম কাহুব্বিল্লাহি ওয়াল্লাহি ওয়াল্লাযীনা আমানু আশা্বউ হুব্বাল্ লিল্লাহি ওয়ালাও ইয়ারাল্লাযীনা যালামু ইয্ ইয়ারাওনাল আযাবা আন্নাল কুওয়্যাতা লিল্লাহি জামীয়াওঁ ওয়া আন্নাল্লাহা শাদীদুল আযাব । ( সুরা বাক্বারাহ, 165 আয়াত) রিনিদের বাড়ির পেছনে আছে আর এক মজার পুকুর । ঐ পুকুরে, আম্মা যাকে ডোবা বলে, তাতে কোমর অব্দি জল । রিনি অনেকবারই বলেছে ওদের পুকুরে গিয়ে সাঁতার কাটতে কিন্তু আম্মা কিছুতেই যেতে দেয় না । বলে ওটা পুকুর নয় ডোবা আর ঐ ডোবায় যত রাজ্যের নোংরা ।

আমি ওখানে স্নান করতে যাব শুনে এক কথায় বারণ করে দিয়েছে । রিনি আমাকে বলে, মিশু তো রোজ এসে সাঁতার কাটে পুকুরে, তুই ও আয় না । সবাই মিলে খুব আনন্দ করব । আম্মা আসতে দেবে না শুনে বলে, খালাম্মাকে বলার কি দরকার ? সাঁতার কাটবি সেটা বলবি না ! রিনির কথামতন আমি সেদিন বাড়ি না ফিরে সোজা বড় রাস্তা পেরিয়ে রিনিদের বাড়ি। স্কুলের ব্যাগ রিনির পড়ার টেবিলে আর স্কুলের জামা পাল্টে রিনির জামা পরে সোজা পুকুরে ।

কথা ছিল যে বেশিক্ষণ স্নান করবো না দুটো ডুব দিয়েই উঠে পড়ব আর আম্মা টের পাওয়ার আগেই বাড়ি পৌছে যাব । স্কুল থেকে আমি যখন বাড়ি ফিরি আম্মা ঐ সময়ে প্রায় দিনেই ঘুমোয় । আমি আম্মাকে ডাকি না কিন্তু আম্মা ঠিক টের পেয়ে যায় যে আমি ফিরেছি। পুকুরে তো নেমেছি দুটো ডুব দেব বলে কিন্তু নামামাত্র ঐ দুটো ডুবের কথা আর মাথায় নেই। কতক্ষণ ঐ পুকুরে দাঁপাদাপি করেছি জানি না হঠাত্ খেয়াল হল এই রে অনেক দেরী হয়ে গেল তো! জামা কাপড় পাল্টে ভিজে চুল আর লাল চোখ নিয়ে বাড়ির পথে ফিরতে গিয়ে আর পা সরে না ।

আম্মাকে কি বলব ভাবতে ভাবতে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি গম্ভীর মুখে আম্মা ঘর বার করছে । আমাকে দেখে এগিয়ে এল । গায়ে হাত দিয়ে দেখল, চোখ দুটো ও দেখল আর তারপরে ভিজে চুল । পরদিন আমি স্কুলে গিয়ে আর রিনির পাশে বসি না । আমার খুব রাগ হয় রিনির পরে, আমি রিনির সঙ্গে কোন কথাও বলি না আর ।

এর পর থেকে আর কোনদিন আমি রিনির পাশে বসি নি । রিনি অনেক চেষ্টা করেছে আমার সাথে কথা বলার, ছোট্ট চিঠি লিখে বই এর ভেতরে রেখে দিয়েছে । চিঠিতে লিখেছে, তোকে কি খালাম্মা খুব মেরেছিল? আমি সেই চিঠিরও কোন উত্তর দিই নি । এর ঠিক ক'দিন পরেই রিনি স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল । প্রথমে আমার মনে হয়েছে, খুব ভাল হয়েছে রিনি আর স্কুলে আসে না কিন্তু ক'দিন পার হতেই খুব মন খারাপ হতে লাগল রিনির জন্যে ।

আমি রোজ আম্মার কাছে বায়না করি রিনির খোঁজ নেওয়ার জন্যে তো এক বিকেলে আম্মা আমাকে সাথে করে রিনিদের বাড়ি নিয়ে গেল । শুনলাম রিনিরা সব লন্ডন চলে যাচ্ছে , রিনির বড় আপার কাছে । ওখানেই থাকবে এবার থেকে রিনি আর খালাম্মা । ওখানেই পড়বে রিনি । সেই প্রথম জানলাম যে রিনির বাবা নেই ।

মারা গেছেন রিনি যখন খুব ছোট ছিল তখন । রিনি আর খালাম্মা দুজনেই খুব কাঁদছিল । কাঁদছিল আম্মাও । আর তখনই আম্মা বলল, রিনি যাওয়ার আগে তোমার পুতুলের বিয়েটা দিয়ে দাও । বিয়ের দিন ঠিক হল পরের রবিবার ।

আর সেই পুতুল বিয়ের রান্না আম্মা করে দিল। রিনির মেয়ে পুতুল আমার বাড়ি এল। সঙ্গে এল পুতুলের থাকার বাক্স। পুরনো শাড়ির পাড় কেটে বানানো সব শাড়ি। ছোট্ট বিছানা আর ছোটো ছোটো অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র ।

রিনি তার বড় আপার পুরনো নষ্ট হয়ে যাওয়া হাতঘড়িটাও তার মেয়ে পুতুলকে দিয়ে দিল । হুয়াল্লাযী আইয়্যাদাকা বিনাস্রিহি ওয়া বিল্মু'মিনীন, ওয়া আল্লাফা আইনা ক্বলুবিহিম ওয়া লাকিন্নাহা আল্লাফা বাইনাহুম ইন্নাহু আযীযুন হাকীম । ( সূরা আনফাল, 62-63 আয়াত) হুঁশ করে টি -2 বাসটা বেরিয়ে গেল। এই দুপুরবেলায় আমার ঠিকানার যাত্রী এখানে কম। কেউ তাকে হাত দেখায়নি সেও তাই থামেনি ।

বাসটা বেরিয়ে যেতে নিজের উপরে বেশ রাগ হল । প্রায় আধঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি আর যখন বাস এলো তো আমার খবর নেই! আরও খানিক বাদে শেয়ারের ট্যাক্সি এলো ভর্তি সওয়ারী নিয়ে । বুড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে সওয়ারী নামিয়ে নামিয়ে সে যাবে । ঠাসাঠাসি করে তাতে চড়ে বাড়ির পথে আমি । পেছনে পড়ে থাকে রাস্তার পরে আদ্ধেক ডাল ছড়ানো কদমগাছ ও আমার ছেলেবেলা ।

এলাটিং বেলাটিং সই লো। । কি খবর আইলো? রাজায় একটা মাইয়া চাইলো । কোন মাইয়া চাইলো? --*--

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.