আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিঃস্পৃহ বাতাসের গল্প

"মানুষ মানুষের কাছে শ্রেষ্ঠ সমুন্নত জীব , ধ্বংশ ও উৎখাত করো অতীতের সেই সব সম্পর্ক - যেখানে মানুষ হয়ে আছে হেয় ঘৃণিত এবং দাসে পরিণত " গ্রামের নাম কৈলাশপুর । মাসের নাম পৌষ । একটু পর-পর অবোধ শিশুর মতো বাতাসের কনকনে প্রবাহ একে তাকে , এই ঘর ঐ ঘর , তালগাছের সারি ছুয়ে দিয়ে যায় । পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত একটা বড় সরকারী সড়কের দুই পাশে দুইটি গ্রাম , একটি ইটাখোলা আরেকটি কৈলাশপুর । উত্তর দক্ষিণে একটি নদী এঁকেবেঁকে চলে গেছে দুটি গ্রামকে সুত্রে বেঁধে ।

কৈলাশপুরের পরাধীন বিপন্ন মানুষেরা আজ জড়ো হয়েছেন একটি নির্মম হত্যার দৃশ্য দেখতে । কৈলাশপুরের ইমাম গেছেন নিহতের আত্মার মাগফিরাতের দোয়া চাইতে , এই এলাকার গরীব অশিক্ষিত মুসলমানদের দান দাক্ষিণ্যে গড়ে উঠা বাঁশের বেড়া আর শনের ছাউনিতে গড়ে উঠা মসজিদটিতে তিনি হাটু গেড়ে প্রার্থনা করছেন । দুই রাকাত নামাজ পড়তে পারলে ভালো হতো , পারছেন না , বার-বার নুরু কবরেজের ছেলে মাইনুদ্দিনের চেহারাটি চোখের সামনে চলে আসে । নামাজে কেবল আল্লাহর ধ্যান করতে হয় । মাইনুদ্দিনের চেহারা আসলে নামাজ শুদ্ধ হবে না ।

ইমাম সেজদায় পড়ে কাঁদতে থাকেন , আল্লা’র কাছে তার কিছু চাওয়ার নেই । আল্লাহ ! আমার তামাম নেকী মাইনুদিকে দাও , আল্লাহ ! তোমার দোস্তের দোহাই , আল্লা ... ইমাম আর কিছু বলতে পারেন না । হাউ মাউ করে শুণ্য মসজিদে বসে কাদতে থাকেন , কান্নার জল তার শুভ্র দাড়িতে গড়িয়ে পড়ে , মসজিদের মুর্তার পাটিতে টপ-টপ করে ঝড়ে পড়ে। সুয়োর কা বাচ্চা , সালা মাই চোদা বাঙ্গাল । মুক্তি বন্‌তা হ্যায় , সালা বল পাকিস্তান যিন্দাবাদ ।

মাইনুদ্দিনের প্রায় মৃত শরীরটিকে গ্রামের ধুলোমাখা পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কমান্ডার আশফাক পাঠান । সিপাহীদেরকে ধরতে দিচ্ছে না , কিছুক্ষন পর-পর লাথি মারছে মাইনুদ্দিনের শরীরটিতে । এইবার তাকে ফসল তোলা জমির কাটা খড়ের উপর রেখে ছেড়ে দেয়া হল। যুদ্ধের খাতিরে এসেছে শরীফ , সে জাতে পশ্তু । এইখানে বিদ্রোহ করা চলে না , মনে-মনে সে দোয়া করতে থাকে , এ মেরে মাওলা ! ম্যায় যিস জাহান্নুম ম্যায় জাউ ।

ওয়াহা এক রোজ মেরে ইস ভাই সে মিলা দেনা কেহ উস সে মাফি মাঙ সাকু । ( অ আমার প্রভু , যে নরকেই যাই এই ভাইটির সাথে দেখা যেন হয় , যেন ক্ষমা চেয়ে নিতে পারি । ) শরীফ কাঁদতে পারে না , তার বড় ভাইটির কথা মনে পড়ে , বার বার বলেছিল ; “ মত জানা শরিফ । ইয়ে যুম হ্যাঁয় , ইয়াহা হামারা গুযারা হো সাক্তা হ্যায় । আরে , খুব কামায়েঙ্গে দু ভাই মিল্কে ।

” ( যাসনে শরিফ , এইখানে আমাদের চলে যাবে , আরে দু ভাই মিলে খুব রোজগার হবে । ) আম্মা বার-বার জড়িয়ে ধরছিলেন । অনেক টাকা , তাছাড়া শরীফ ভাবতেও পারেনি সত্যি-সত্যি এই হবে । ক্যাম্পে আনা মেয়েগুলোর দিকে তাকাতে পারেনা সে , বার-বার ছোটো বোন শাফিয়ার চেহারাটি ভেসে উঠে । আজই একটি চিঠি লিখবে সে ।

এইখান থেকে চলে যেতে হবে দ্রুত । শরীফ নদীর দিকে এগিয়ে যায় , চারপাশে ভীড় করা ভীত মানুষ স্টেনগানের গুলির মতো ছিটকে যায় ভয়ে । মাইনুদ্দিনকে আরেকটি লাথি কষে কমান্ডার শরীফ এর দিকে তাকিয়ে খেকিয়ে উঠে ... কাহা যা রেহে হো ? ( কোথায় যাচ্ছ ? ) ও যারা ফারেগ হোনা হ্যায় । ( একটু বাথরুমে... ) বুরবাক কাহিকা , যাও আউর জালদি লাওট কে আও । কাবিভি আউরাতো কি তারহা ... ইয়ে সাব কিয়া হ্যায় , হিযড়া হো কিয়া ?! ( বুরবক কোথাকার , যাও আর তাড়াতাড়ি ফিরে এসো যখন তখন মেয়েদের মতো... এইসব কি , হিজড়া নাকি তুমি ?!) হো হো করে হেসে উঠে দলের বাকি আট জন ।

শরীফ নদীর দিকে চলে যায় । পাশে একটি কুড়ে ঘরের জানালা থেকে দুটি শিশু বার-বার উকি দিচ্ছে , চঅতি সাবধানে কেদে উঠে শরীফ । একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে , নাহ্‌ কেউ দেখেনি । এতো দূরে দেখা যায় না । কয়েক আজলা জল নিয়ে নিজের কলঙ্কিত মুখে ছিটায় ।

জানালা দিয়ে এখন দুইটি শিশু আর একটি নারী অবাক হয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে । দেখুক , এই তিনটি মানুষ সাক্ষী থাক । শরিফ এইবার ডুকরে কেদে উঠে । তারপর উঠে দাঁড়ায় কান্না সংবরণ করে , ঢালের উপর উঠে আসলে একটি বয়স্ক পুরুষ বেশ চওড়া কাঁসার থালায় কয়টি বাতাসা ও এক গ্লাস জল নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। ভাঙ্গা উর্দুতে বলে ; সাহাব পানি পিজিয়েগা ।

শরিফ গ্লাস্টি তুলে নেয় ,বিস্মিল্লাহ ... ঢক-ঢক করে ভারি কাঁসার গ্লাসটি খালি করে দেয় । সবগুলো বাতাসা হাতে নিয়ে মানুসটির দিকে তাকায় , তাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে । অপরাধীর মতো তাকিয়ে থাকে মানুষটির দিকে , বহত মেহেরবানী ! বলেই যতোটা সম্ভব উদ্ধত ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকে হত্যাযজ্ঞানুষ্ঠান এর দিকে । মাইনুদ্দিনের মুখে এক বালতি জল ঢালা হলো । সে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে , দুর্বল স্বরে কমান্ডারের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার উর্দুতে বলে উঠে , আমাকে তো মেরেই ফেলবেন , একটু সময় দিন যেন একটা বিশেষ দাওয়াই কাউকে শিখিয়ে দিতে পারি ।

আমার বাবা সেটা আমাকে শিখিয়েছিলেন । কাউকে না কাউকে সেটা শিখাতে হয় । কমান্ডার জানতে চায় , কি ঔষধ ? একটা মলম , সেটা ঘাড়ে ঘশে দিলে গর্দান এতো শক্ত হয় যে কোনো ধারালো অস্ত্রেই গর্দান কাটা যায় না । এইবার সকলেই বিস্মিত হয় । আট জনের কেউ কেউ বিশ্বাস করে কেউ বলে দেখতে হবে ।

উপস্থিত লোকের কেউই বুঝতে পারে না তাই কোনো কথা হয় না । ভীড়ের মধ্যে থেকে পাজামা পাঞ্জাবি পড়া একটি লোক - সকলে যাকে কর্তা মসায় বলেই চিনেন , গ্রামের শ্রদ্ধেয় পুরোহিত - এর দিকে তাকায় এক সিপাহী , এ উর্দু জানো ? জ্বী । কি বলছে এই হারামিটা । ঠিকই বলছে হুযুর , ওর বাবা একজন খুব ভালো হেকিম ছিলেন । তা কি লাগে সেটা বানাতে ? আমি জানি না হুযুর , সে বলতে পারবে ।

আচমকা এক দমকা বাতাস এসে সকল মানুষকে ছুয়ে দিয়ে যায় , কারো হত্যা দেখতে থমে না। দ্রুত শুকনো খড় , পাতা উড়িয়ে দিয়ে যায় কিছুদূর । ভিড়ের মধ্যে একটি শিশু হাতে এক টুকরো মাটির ঢেলা তুলে নেয় কমান্ডার এর গায়ে ছুড়বে বলে । আরেকটি ১০/১২ বছরের ছেলে সেটা কেড়ে ফেলে দেয় । বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বিস্তর জমিটি থেকে মানুষের পায়ের দাগে আঁকা একটা পথ দিয়ে এঁকে বেঁকে যে রাস্তাটি গ্রামের দিকে গেছে সেদিকে এগিয়ে যায় ।

সহজ পথ ! উন্মুক্ত পৃথিবী ! তবু রাস্তাটি আঁকাবাঁকা , মানুষ এমনই বটে । গ্রামের সামনে জঙ্গল থেকে লতা পাতা সংগ্রহ করা হয় । শরীফ বিবর্ণ চেহারায় তাকিয়ে থাকে । সিদ্ধান্ত হয় মাইনুদ্দিনের ঘাড়ে সেই মলম লাগানো হোক । শিশুরা নেই , কেবল কর্তা আর গুটিকয় পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে ।

সকলেই মুসলমান , নাহয় দেখতে সেরকম , সকলেই কলেমা জানে । গ্রাম থেকে একটি লম্বা ধারালো দা সংগ্রহ করে আনে কয়েকজন সিপাহী । কমান্ডার সজোরে একটি কোপ বসিয়ে দেয় মাইনুদ্দিনের ঘাড়ে । আশ্চর্য ! মাইনুদ্দিনের মাথাটি শরীর থেকে মুহুর্তে আলাদা হয়ে ধুলোবালিতে মাখামাখি হয়ে যায় । একটা সজোরে লাথি বসিয়ে দেয় কমান্ডার আলগা হয়ে যাওয়া মাথাটিতে ।

হাত দশেক দূরে ছিটকে পড়ে যায় মাথাটি । বাচ গেয়া শালা ! ( বেঁচে গেলো শালা ! ) শরীফ একবার আকাশের দিকে তাকায় , তাকিয়ে থাকে । কমান্ডার সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে বলে , সব বলো পাকিস্তান যিন্দাবাদ । সমবেত জনতা চিৎকার করে উঠে , পাকিস্তান যিন্দাবাদ । শরীফ কেবল ঠোট নাড়ায় ।

মাইনুদ্দিন কে কবর দেয়া হয় না , তাকে পরিত্যক্ত আবর্জনার মতো ফেলে দেয়া হয় । একে-একে সকলেই মিলিটারি ভ্যান এ চড়ে বসে । গ্রামের কাঁচা রাস্তা থেকে আস্তে-আস্তে গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে যায় , চলে যায় সড়কের দিকে । নাম : শ্রী রঘুনাথ আচার্য্য , পিতা : সোমনাথ আচার্য্য , গ্রাম : কৈলাশপুর । তৃষিত মরুচারীর মতো দৌড়ে আসেন ।

মাইনুদ্দিনের মাথাটি তুলে এনে শরীর কাছে রাখেন , তার কর্তিত দেহটির সবখানে হাত বুলান । হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকেন । বাকি পুরুষেরা অনড় থেকে নারীকেও কান্নায় হার মানায় । মাইনুদ্দিনের চেহারা থেকে ধুল ঝাড়তে-ঝাড়তে হটাৎ স্থব্ধ হয়ে যান পুরোহিত । মাথাটি কোলে নিয়ে আকাশের দিকে তাকান , চিৎকার করে উঠেন... ভগবা আ আ আ আ আ আ আ ন ...... ভগবান কিছু বলেন না ।

আর একটি বাতাসের নিঃস্পৃহ নিশ্চিন্ত প্রবাহ কেবল সকলকে ছুয়ে দিয়ে যায় গন্তব্যের দিকে । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.