আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কার্টুনিস্টদের ভিড়ে কয়েকজন দুর্ভাগা আইডিয়াবাজ

‘শালা’ শব্দটার সঙ্গে যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি যায়, তা হলো দুলাভাই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ‘দুলাভাই-শালা’ ছাড়াও আরও কিছু অর্থপূর্ণ শব্দের সঙ্গে ‘শালা’ শব্দটি যুক্ত হয়ে একটা নতুন অর্থ তৈরি করে। যেমন: সংগ্রহশালা, কর্মশালা ইত্যাদি। তবে সংগ্রহশালায় যেমন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ‘শালা’দের সংগ্রহ থাকে না, তেমনি কর্মশালাতেও ‘শালা’-সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার নেই। তার পরও এমন নামকরণের সার্থকতা কী, তা কে জানে! তবে জানা আছে, কর্মশালাকে ইংরেজিতে বলে ওয়ার্কশপ।

ওয়ার্ক অর্থ কর্ম। তার মানে কি শপ অর্থ শালা? আমার জানামতে, শপের বাংলা হচ্ছে দোকান। ওয়ার্কশপের বাংলা হওয়া উচিত কর্মদোকান বা দোকানকর্ম। তার কোনোটাই যে হয়নি, এর পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। একমাত্র আমেরিকার পক্ষেই কারণ ছাড়া অন্য একটা দেশে হামলা চালানো বা অন্য দেশের রাষ্ট্রপতির মেইল ঘাঁটা সম্ভব।

এ ছাড়া সবকিছুর পেছনেই কোনো না কোনো কারণ থাকে। গাড়িতে বসে কর্মশালায় যাওয়ার পথে সেই কারণ খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। কর্মশালাটি কার্টুনবিষয়ক। আয়োজক প্রথম আলো আর সহায়তায় দি আমেরিকান সেন্টার। কর্মশালায় রাজনৈতিক কার্টুন এবং আইডিয়াসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত আমেরিকান কার্টুনিস্ট ম্যাট উয়েরকার।

কর্মশালা হওয়ার কথা ছিল প্রথম আলো কার্যালয়েই। কিন্তু হরতালের কারণে ভেন্যু গেল বদলে। আমেরিকানদের হরতালে কোথাও যাওয়ার নিয়ম নেই। তাই আমাদেরই যেতে হলো আমেরিকান সেন্টারে। হরতালের সকালে বারবার জ্যামে পড়ে ভাবলাম, ভাগ্য ভালো, এই হরতালে আমেরিকানরা বের হয়নি।

নইলে হরতাল সম্পর্কে একটা ‘বাজে’ ধারণা পেত তারা। আমরা নিশ্চিত হলাম, হরতাল দিয়ে কর্মশালার ভেন্যু বদলানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি হরতালকারীরা।
বৃষ্টির বাধায় যেমন ম্যাচের ওভার কমে যায়, হরতালের কারণে কমে গেল কর্মশালার দৈর্ঘ্য। আলোচনা হবে শুধু কার্টুন নিয়ে, আইডিয়ার অংশটুকু বাদ। মন খারাপ হয়ে গেল।

আমরা এতগুলো আইডিয়াবাজ তাহলে করব কী? মনকে বোঝালাম, কর্মশালার মূল ব্যাপার হচ্ছে খাবার। আলোচনা কোনো ব্যাপারই না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলেন ম্যাট উয়েরকার। তাঁর তরুণ বয়সে হলিউড যদি কোথাও কেউ নেই নাটক রিমেক করত, তাহলে নিশ্চিন্তে তিনি বাকের ভাই চরিত্রে টিকে যেতেন। সাদা বাকের ভাই! যা-ই হোক, এত দিন শুধু টেবিল ম্যাটই দেখেছি; এবার দেখলাম পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত কার্টুনিস্ট ম্যাট।

পুলিৎজার পুরস্কার কী—এ সম্পর্কে আমার খুব একটা ধারণা ছিল না। স্কুলের পিকনিকের র‌্যাফেল ড্রতে একবার পুরস্কার হিসেবে এক কৌটা কনডেন্সড মিল্ক পাওয়ার ঘটনা বাদ দিলে আমি জীবনেও কোনো পুরস্কার পাইনি। তাই পুরস্কার নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। পুলিৎজার পুরস্কার নিয়ে না ভেবে ম্যাটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পরিচয় সেরে নিলাম। সময় কম, কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই আলোচনা শুরু হয়ে গেল।

প্রথমেই নিজের আঁকা কিছু কার্টুন দেখালেন ম্যাট। আমরা মুগ্ধ। ওবামাকে নিয়ে নানাভাবে কার্টুন এঁকেছেন তিনি। বাংলাদেশে ক্ষমতাবান কারও এমন কার্টুন আঁকলে কার্টুনিস্টকে থাকতে হতো জেলখানায়, কর্মশালায় নয়!
কার্টুন দেখানো শেষে ম্যাট বললেন, ‘এবার আমরা সবাই একসঙ্গে ওবামা আঁকব। ’ আমরা আইডিয়াবাজরা একটু নড়েচড়ে বসলাম।

আমরা তো শূন্য ছাড়া তেমন কিছু আঁকতে পারি না। ওবামা আঁকব কীভাবে? ম্যাট আশ্বাস দিলেন, ওবামা আঁকা নাকি কোনো ব্যাপারই না। আসলেই তা-ই, ম্যাটের দেখানো কৌশলে আমি তো আমি, পাভেল পর্যন্ত ওবামা এঁকে ফেলল। পাভেল আগ্রহ নিয়ে ম্যাটকে বলল, ‘এটা আমার আঁকা প্রথম প্রেসিডেন্ট, প্রথম মানুষও। ’ পাশ থেকে বললাম, ‘তুমি নিশ্চিত, এটা মানুষ?’ ম্যাট অবশ্য প্রশংসাই করলেন।

সবার ‘ওবামা’ই পেল তাঁর প্রশংসা। এমনকি ফটোগ্রাফার কবির ভাইও ক্যামেরা পাশে রেখে একটা সুস্থ-স্বাভাবিক ওবামা এঁকে ফেললেন। আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন দন্তচিকিৎসক সিদ্ধার্থ মজুমদার। প্রশংসা পেল তাঁর ‘ওবামা’ও। আমি খেয়াল করে দেখলাম, তাঁর ওবামার দাঁতগুলো খুব যত্ন নিয়ে আঁকা হয়েছে! বুঝলাম, দন্তচিকিৎসক কার্টুনিস্ট হলেও দাঁতের দিকে খেয়াল রাখেন।


এরপর ম্যাট বললেন, ‘আমরা বুশ আঁকব’। আমি চমকে উঠলাম। এ পর্যন্ত ৪৪ জন প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা কি একে একে সবার ছবি আঁকব? তাকিয়ে দেখলাম, অন্য কেউ এ বিষয় নিয়ে না ভেবে মহানন্দে বুশ আঁকছে। আমিও আঁকলাম।

প্রথমে দেখে মনে হলো, এটা অ্যাংরি বার্ডসের মোটা পাখি। পুরোটা আঁকার পর যখন উল্টা করে ধরলাম, সবাই বলল, ‘বাহ্, পেঁয়াজটা ভালো আঁকছ। ’ আমি কাগজ-পেনসিল রেখে দিলাম। সবাইকে কার্টুনিস্ট হতে হবে—এমন কোনো কথা নেই।
এতক্ষণ আমরা সাদা-কালো ওবামা-বুশ এঁকেছি।

এবার ম্যাট বললেন রঙিন ওবামা আঁকতে। সবাই রং-তুলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। জুনায়েদ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুলি কই?’ আমি আমার পাশে বসা কার্টুনিস্ট তুলি ভাইকে দেখিয়ে বললাম, ‘এই তো’। জুনায়েদ ভাই বিরক্ত, ‘আরে এইটা না, চিকন তুলিটা কই?’ আমি তুলি ভাইয়ের স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, তাঁকে চিকন তুলি বলার কোনো কারণ নেই!
সবাই মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙিন ওবামা আঁকল। কদিন আগে জুনায়েদ ভাইয়ের জন্ডিস ছিল, তাঁর ওবামাটা হলো একটু হলুদ টাইপ।

কিশোর ভাই সবুজ বনে ঘুরে বেড়ান; তিনি আঁকলেন সবুজ ওবামা। আর আমরা আইডিয়াবাজরা তখন ম্যাটের সঙ্গে ছবি তোলায় ব্যস্ত। একে একে সবাই এসে ছবি তোলা শুরু করল। হঠাৎ ম্যাট বললেন, ‘লিসেন এভরিওয়ান, উই হ্যাভ টু ফিনিশ ওবামা’। আমি চমকে উঠলাম! ওবামাকে ফিনিশ করব? বলে কী? পরে বুঝলাম, উনি ওবামা আঁকা ‘ফিনিশ’ করতে বলেছেন।


ওবামা ফিনিশ করার পরপরই ফিনিশ হলো কর্মশালা। সবাই মিলে ম্যাটের সঙ্গে ছবি তুললাম আমরা। আর ভাবলাম, ম্যাটও আমেরিকান, ওবামা, বুশও আমেরিকান। অথচ কেউ ভাবে যুদ্ধের আইডিয়া, আর কেউ ভাবে কার্টুন আইডিয়া! কী অদ্ভুত!।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।