আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরিবর্তন নিয়ে জামায়াতে দুটি ধারা সক্রিয়

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়া, নতুন নামে দল গঠন করাসহ আরও কিছু কর্মপন্থা নিয়ে জামায়াতের ভেতরে একটি অংশ সক্রিয় হয়েছে। মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত এ অংশের বিরুদ্ধে তৎপর আছে কট্টরপন্থী অংশও।

এ নিয়ে দলটির ভেতরে দুটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। নিজ নিজ পক্ষের মত প্রতিষ্ঠার জন্য চলছে কাগুজে লড়াই। দলসমর্থিত সংবাদমাধ্যমে উভয় পক্ষই নিজেদের যুক্তি-পাল্টাযুক্তি তুলে ধরছে।

দলটির একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, মধ্যপন্থী অংশটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে ঐতিহাসিক লজ্জা থেকে মুক্ত হতে চায়। মধ্যপন্থা বা উদার নীতিকৌশল গ্রহণে আগ্রহী এ অংশটির বেশির ভাগ অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং একাত্তরের পরের প্রজন্ম। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের আবেগ, মানবতাবিরোধী অপরাধে নেতাদের সাজা ও ইসলামপন্থী রাজনীতির বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দলের নাম পরিবর্তন করে আধুনিক ধাঁচের দল গড়ার পক্ষে। কারাগারে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এ চিন্তার পক্ষে সক্রিয় ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলী। কামারুজ্জামান কারাগার থেকেও এর পক্ষে চিঠি লিখেছেন।

কট্টরপন্থী নেতারা এ চিন্তাধারার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ পুরোনো নেতারা এ অংশে আছেন। এ অংশটি একেবারে বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত দলের নাম পরিবর্তন ও বিকল্প কিছু ভাবার ঘোর বিরোধী। অবশ্য তাঁদের জন্য এটি অনেকটা নেতৃত্বে টিকে থাকারও প্রশ্ন। কারণ, মধ্যপন্থীদের চিন্তা বাস্তবায়ন করতে গেলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে হয়।

এ জন্য কট্টরপন্থী অংশ দলে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছে। এর শুরু হয়েছে দলের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তারের পর থেকে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন ও দলীয় গঠনতন্ত্রের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় যথাক্রমে মকবুল আহমদ ও এ টি এম আজহারুল ইসলামকে। এ দুজনকে দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে কট্টরপন্থী নেতাদের কর্তৃত্ব বহাল রাখার চিন্তা কাজ করেছে বলে মধ্যপন্থী নেতারা মনে করছেন। তাঁদের দাবি, সম্প্রতি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদে এ টি এম মাছুম, হামিদুর রহমান আযাদ, আবদুল হালিম ও নুরুল ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রেও একই চিন্তা কাজ করেছে।

অপেক্ষাকৃত তরুণ এই চার নেতা কট্টরপন্থীদের চিন্তাধারার সমর্থক বলে মনে করা হয়।

উদার চিন্তাধারার পক্ষের নেতাদের মতে, সাংগঠনিক বিবেচনায় নির্বাহী পরিষদে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির ও সাংসদ সামছুল ইসলাম, সাবেক সাংসদ সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও মো. শাহজাহান, রাজশাহীর আমির আতাউর রহমান, বরিশালের আমির মোয়াজ্জেম হোসেন, দলের আইনবিষয়ক সম্পাদক জসিম উদ্দিন সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা।

 দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জামায়াতের নীতিকৌশলে পরিবর্তন আনার বিষয়ে নতুন এ চিন্তার কথা প্রথম প্রকাশ পায় ২০০৯ সালের মাঝামাঝিতে। তখন দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ও তরুণ নেতার উপস্থিতিতে রাজধানীর পুরানা পল্টনের আল-রাজী কমপ্লেক্সে এক বৈঠকে এ-সম্পর্কিত একটি বিশ্লেষণপত্র উপস্থাপন করা হয়। তখন পুরানোপন্থী শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।

পরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নেতাদের ধরপাকড়ের মুখে ওই চিন্তা চাপা পড়ে যায়। এখন শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার সাজার রায় হওয়া, হাইকোর্ট দলের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করাসহ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের ওই চিন্তা বা কৌশল নিয়ে একটি অংশ আবার সক্রিয় হয়েছে।

গত ২৭ আগস্ট জামায়াতের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম-এ ‘ইসলামি আন্দোলনে হীনমন্যতাবোধের সুযোগ নেই’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধকে কেন্দ্র করে বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ পেয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আবু নকীব ছদ্মনামে সংগ্রাম-এ নিবন্ধটি লিখেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কারাবন্দী জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা। ওই নেতার ছেলের নাম নকীবুর রহমান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।

আর আবু নকীব শব্দের অর্থ নকীবের বাবা।

আবু নকীব ও আবদুর রাজ্জাক: গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ‘আরব বসন্ত এবং দেশে ইসলামি আন্দোলন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক। তিনি একই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রধান আইনজীবীও। তিনি বাংলাদেশকে উপলক্ষ করে ওই নিবন্ধে মিসর, তিউনিসিয়া, মরক্কো ও তুরস্কে ইসলামপন্থী দলগুলো কীভাবে কৌশল বদল করে সাফল্য পেয়েছে, সে পর্যালোচনা করেন।

নিবন্ধে বলা হয়, তুরস্কে এরদোগান ও আবদুল্লাহ গুল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নামে নতুন দল গঠন করে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড (ইখওয়ানুল মুসলিমিন) বেশ কয়েকবার নাম পরিবর্তন করেছে। নীতিকৌশল পরিবর্তনের কারণে মিসরের গত নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়। তারা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি নামে আলাদা একটি প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি করেছে। ভারতের জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নাম পরিবর্তন করে ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া নামে নতুন দল করেছে পুরোনো জামায়াতের ব্যর্থতার কারণে।

এর ১৯ মাস পর গত ২৭ আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম-এ আবু নকীবের নামে প্রকাশিত নিবন্ধে আবদুর রাজ্জাকের লেখার জবাব দেওয়া হয়।

তাতে বলা হয়, ভারতের জামায়াতে ইসলামী নাম পরিবর্তন করেনি। তারা মূলত ‘সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছিল। অতীতে ভুল শুধরে তারা নাম পরিবর্তন করেছে, এমন কথা যদি কেউ লিখে থাকেন, তিনি তথ্যবিচ্যুতির আশ্রয় নিয়েছেন।

নতুন দল গঠনের চিন্তার বিষয়ে আবু নকীবের নিবন্ধে বলা হয়, ইসলামি আন্দোলনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটি পথ বন্ধ হলে ১০টি পথ খোলার মতো যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকতে হবে। বাস্তবে পথ বন্ধ হওয়ার আগে নিজেদের পক্ষ থেকে পথ বন্ধ করে কোনো কৌশল অবলম্বনের চিন্তাভাবনা হীনম্মন্যতার পরিচয় বহন করে।

এ নিবন্ধে আবদুর রাজ্জাকের লেখা ও আল-রাজী কমপ্লেক্সের বৈঠকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়, সম্প্রতি বাংলাদেশে ইসলামি আন্দোলনের বিরুদ্ধে মহলবিশেষের পক্ষ থেকে সুকৌশলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কতিপয় ব্যক্তির অপরিণামদর্শী ও অপরিপক্ক পদক্ষেপজনিত একটি বৈঠকেও পত্রিকার একটি নিবন্ধকে তথ্য-উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করছে তারা।

আবু নকীবের এ নিবন্ধ পরে প্রচারপত্র আকারে জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মাঝে বিলি করা হয়।

এসব বিষয়ে গত শনিবার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি পুরো বিষয়টি শোনার পর বলেন, ‘এ নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

কামারুজ্জামান-শামসুন্নাহার নিজামী: ২০১০ সালের ডিসেম্বরে কারাগার থেকে কামারুজ্জামান জামায়াতের দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে ‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি’ শিরোনামে একটি চিঠি লেখেন। তাতে জামায়াতের বাইরে নতুন নামে দল গঠনের প্রস্তাব ও রূপরেখা দেন। একই সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এসেছে—এমন নেতাদের দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। তখন এ নিয়ে দলের ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়।

এরপর মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী ও জামায়াতের মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি শামসুন্নাহার নিজামী ২০১১ সালের ১১ ও ২৫ মার্চ সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় ‘বিবেচনা আনতে হবে সবকিছু’ শিরোনামে দুই কিস্তিতে নিবন্ধ লেখেন।

তাতে মূলত কামারুজ্জামানের চিঠির জবাব দেওয়া হয়।

শামসুন্নাহার নিজামী লেখেন, জামায়াত মনে করে, যেকোনো পরিস্থিতিতে বা পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কোনো কর্মকৌশল নয় বরং শাশ্বত সেই কর্মকৌশল অবলম্বন করতে হবে, যে কর্মকৌশল অবলম্বন করেছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। পরিস্থিতি যতই নাজুক হোক, চ্যালেঞ্জ যত কঠিনই হোক; শর্টকাট কোনো পথ নেই।

জামায়াতের পরিবর্তনের চিন্তা সম্পর্কে ২০১০ সালের ১ আগস্ট কামারুজ্জামান (গ্রেপ্তার হওয়ার আগে) এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, দলকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা কোনো চিন্তা করলে তা দোষের কিছু নয়।

পরিবর্তনের চিন্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে জামায়াতের রাজনীতির অন্যতম চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব ও সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলে নতুন নামে দল গঠন করার বিষয়টি দলের চিন্তাশীল গোষ্ঠী গভীরভাবে বিবেচনা করছে।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.