আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভিখারির মতো দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম মেডিকেলে (তৃতীয় পর্ব)

ডিবি অফিসে বসে ছেলের কান্না আমাকে আপ্লুত করে। এই কারণে আমার কিছু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুলে ধরছি।

আমার বিয়ের বয়স ২৮ বছর পার হতে চলল। শুভকর্মটি করেছিলাম ১৯৮৬ সালের ১৩ জুলাই। অন্য সবার মতো আমাদের দাম্পত্য জীবনেও কলহ হয়।

আগে খুব ঘন ঘন হতো। শুরু করতাম আমিই এবং কোনো কারণ ছাড়াই। কেন জানি ঝগড়া করতে বেশ ভালোই লাগত। পিন কেটে কেটে কুট কুট করে ঝগড়া করতাম। আর সে ভীষণভাবে খেপে যেত।

বলা শুরু করত। কিন্তু কখনো রাগ করে বাপের বাড়ি রওনা হতো না।

সকালে ঝগড়া হতো, বিকালে মিটমাট। এভাবেই চলছিল প্রায় দেড় যুগ বা ১৮ বছর। কিন্তু এরপর ঘটনা ঘটতে থাকল উল্টা অর্থাৎ ঝগড়া হতো কালেভদ্রে, খুবই কম।

শুরু করত সে আর আমি উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কথা বলা বন্ধ করে দিতাম। দু-তিন দিন কিংবা বড়জোর চার-পাঁচ দিন পর আবার ঠিক হয়ে যেত। এই ঠিক হওয়ারও আবার নিয়মতান্ত্রিকতা ছিল।

আমাকে আচ্ছামতো বকাঝকা করার পর যখন তার মেজাজ ঠাণ্ডা হতো তখন আমার সঙ্গে খাতির করার নানা ফন্দি-ফিকির চলত। মজার মজার রান্না করে ছেলেমেয়েদের বলত- এই যা, এগুলো তোর বাবাকে দিয়ে আয়।

আমি খেতাম আর টিভি দেখতাম গম্ভীর হয়ে। সে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যেত আর মুচকি হেসে গুনগুন গান গাইত। বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকাত, আমিও বাঁকা চোখে তাকাতাম। সে বলত কী হাসা হচ্ছে কেন। আমি বলতাম, কই হাসছি না তো।

এভাবেই আমাদের মিটমাট হয়ে যেত। কিন্তু তিন-চার মাস আগে কী নিয়ে যেন মনোমালিন্য হলো। এক সপ্তাহ চলে গেল, আমাদের মধ্যে চিরায়ত ভাববিনিময় বা কথাবার্তা হলো না। এ অবস্থার মধ্যেই আমি আমেরিকা চলে গেলাম প্রায় এক মাসের জন্য।

আমেরিকার অনেক অঙ্গরাজ্য ঘুরলাম।

সে দেশের সরকার এবং প্রবাসী বাঙালিরা অনেক আদর, যত্ন এবং খাতির করল। কিন্তু আমার কোনো কিছুতেই ভালো লাগছিল না। এরই মধ্যে সাভারে রানা প্লাজায় সংঘটিত দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুতে মন আরও ভারী হয়ে গেল। সেখান থেকেই শুনলাম আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিখ্যাত বিল্ডিং ঝাঁকুনি তত্ত্ব। বিষয়টি নিয়ে খোদ আমেরিকায়ও বেশ হাসাহাসি হচ্ছিল।

সে দেশের সরকারি মহলের অনেকেই আমাকে ব্যঙ্গ করে মন্ত্রী মহোদয়ের বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করছিল। অন্যদিকে প্রবাসী বাঙালি কিশোর ছেলেরা বিল্ডিং ঝাঁকুনির ওপর ছোটখাটো শর্টফিল্ম তৈরি করে ইউটিউবে ছেড়ে দিচ্ছিল। আমি আমার ফেসবুকে দুটি স্ট্যাটাস দিলাম মন্ত্রী মহোদয়কে নিয়ে, যা কিনা দেশ-বিদেশের অনেক বাংলা পত্রিকা হুবহু ছাপিয়েছিল। আমি প্রমাদ গুনলাম। মন্ত্রী যদি বাগে পান তবে আমাকে হয়তো একহাত দেখাবেন।

বাস্তবে হলোও তাই। সেই ঘটনা পরে বলছি।

আমেরিকায় আমি গিয়েছিলাম তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি ফেলোশিপ প্রোগ্রামের আওতায়। আমার কর্মক্ষেত্র ছিল মূলত শিকাগো। এ ছাড়া রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতেও কাজ ছিল।

শিকাগো শহর থেকে প্রায় ৩০-৪০ মাইল দূরের একটি গ্রামের নাম মাউন্ট প্রসপেক্ট। সেই গ্রামের একটি পরিবারের সঙ্গে আমাকে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। চমৎকার একটি আমেরিকান ফ্যামিলি। গৃহকর্ত্রীর নাম এলিজা। আমি পরম শ্রদ্ধায় তাকে বোন ডাকতাম।

এলিজার স্বামী বুলগেরিয়ান। নাম পিটার। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। এলিজা নিজে অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত। দুটি শিশুসন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ি এবং স্বামীকে নিয়ে যৌথ পরিবারের একটি সুখী সংসার।

আমাকে সবাই সাদরে গ্রহণ করল আর চমৎকার সব মায়াভরা অভিব্যক্তিসহকারে আপ্যায়ন করতে থাকল। এত কিছুর পরও আমার মন ভালো যাচ্ছিল না। বার বার শুধু দেশের কথাই মনে হচ্ছিল। বিশেষ করে স্ত্রীর সঙ্গে হাসিমুখে বিদায় না নেওয়ার বেদনায় আমি প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছিলাম। সব কাজের মধ্যেই আমার এই আহত মনোভাব একটা না একটা গড়বড় লেগেই যাচ্ছিল।

দেশে তখন রানা প্লাজার দুর্ঘটনা এবং হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ নিয়ে সরকার যথেষ্ট বিব্রত। এমন সময় আমার আমেরিকা ভ্রমণ নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে কেউ কেউ টিপ্পনী কাটত যে আমি দেশ ছেড়ে পালিয়েছি। আমার আহত মন আরও বেদনাহত হলো। ফলে যে কাজের জন্য সেখানে গিয়েছিলাম তা আর করা হয়ে উঠল না। আমার দায়িত্ব ছিল স্থানীয় কংগ্রেসম্যান জানি্ন ডেভিসের অফিসে একনাগারে তিন সপ্তাহ কাজ করে সে দেশের স্থানীয় সরকার, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর এবং রাজ্য সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে সম্যক ধারণা গ্রহণ।

পরে রাজধানীতে ফিরে এ সম্পর্কে থিসিস জমা দেওয়া। আমি মাত্র দুই দিন কংগ্রেসম্যানের অফিসে গেলাম। এরপর বললাম সব কিছু বুঝে ফেলেছি, নতুন করে কিছু শেখার নেই। বাকি ১৮ দিন আমি কী করব? আমার বক্তব্য শুনে তারা মনে মনে ভারী বিরক্ত হলো। কিন্তু চোখে-মুখে যথাসম্ভব ভদ্রতা ফুটিয়ে বলল, আপনি ইচ্ছা করলে আপনার লজিং মাস্টারের বাড়িতে ছুটি কাটাতে পারেন।

নয় তো কোথাও ঘুরে আসতে পারেন নিজের ইচ্ছামতো।

আমার আমেরিকা ভ্রমণ স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশ জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই আমাকে সংবর্ধনা দিতে চাইল। অনেকে তাদের বাসায় দাওয়াত দিল। আবার অনেকে আমাকে প্রস্তাব দিল আমেরিকা ঘুরে দেখানোর জন্য।

আমি যথাসম্ভব শিডিউল মিলিয়ে বাংলাদেশি ভাইদের সঙ্গে আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে উঠলাম। কিন্তু কোথাও সুখ পাচ্ছিলাম না। মনের মধ্যে একটি অব্যক্ত বেদনা আমার সব কিছু নষ্ট করে দিচ্ছিল। আমি দেশে ফেরার জন্য পাগল হয়ে পড়লাম। আমাকে যারা আমন্ত্রণ করে নিয়েছিল সেই স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বললাম।

আমি নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার কথা বললাম। তারা বলল, আপনাকে নিজের খরচে ফিরতে হবে। কারণ আমার টিকিটটি ছিল ওয়ানটাইম এবং নন-রিফান্ডেবল। আমি তখন এত উতলা হয়ে পড়েছিলাম যে নিজের খরচায় কোনো আপত্তি ছিল না। ফলে নতুন টিকিট কেটে নির্ধারিত দিনের প্রায় ১০ দিন আগে আমি বাংলাদেশে ফিরলাম।

এত কষ্ট করে যে হাসির জন্য দেশে ফিরলাম তা আমার কপালে জুটল না। আশা ছিল স্ত্রী এয়ারপোর্টে থাকবে। কিন্তু না। আমার একদম ছোট ছেলেটি, যে কি না চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে সে বহুক্ষণ বসে থেকে আমাকে রিসিভ করল। মন ভীষণ ভারী হয়ে গেল।

নিজের অব্যক্ত বেদনা চেপে রাখার জন্য শিশুপুত্রকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ। আমার ছেলে রিশাদ কী বুঝল জানি না, বার বার আমাকে চুমু দিতে লাগল। বাসায় ফেরার পর বড় ছেলে ও মেয়ে এগিয়ে এলো কিন্তু সে এলো না। আমার অন্তরটা হু হু করে উঠল। এভাবেই চলল কয়েক দিন।

আমাদের মধ্যে কথা হয়। তবে তা নিতান্তই ফরমাল। পারিবারিক প্রয়োজন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে সচরাচর যেসব আলোচনা চলে তা-ই চলতে থাকল। কিন্তু কোথায় যেন এক বিরাট শূন্যতা আমাকে তাড়া করে ফিরছিল। আমার নিত্যকার কাজগুলো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।

আমার তিন ছেলেমেয়েই বাংলা মিডিয়ামে পড়ে এবং লেখাপড়ায় যথেষ্ট মেধাবী। বড়টি ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট, মেয়েটি ভিকারুননিসায় নবম শ্রেণীতে এবং একদম ছোটটি চতুর্থ শ্রেণীতে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে। নিজের মতো করে আমি তাদের মানুষ করার চেষ্টা করছি। খুব ভালো ছাত্র হওয়ার পরিবর্তে ভালো মানুষ হিসেবে বড় হওয়ার শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করি সব সময়। স্ত্রী অবশ্য ভালো ছাত্র হওয়ার তাগিদ দেয় সব সময়।

আর এ নিয়ে আমাদের মধ্যে যখন তর্ক হয় তখন ছেলেমেয়েরা সব বাবার পক্ষে যোগদান করে। ফলে তার মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। আমাদের পরিবারে তিনটি ছেলেমেয়েই বাবার ভীষণ ভক্ত। আমার কথায় তারা সব কিছু করতে পারে। আর এ জন্য আমি তাদের কোনো আদেশ বা উপদেশ দিতে গিয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করি।

আমার বড় ছেলেটির বয়স এখন ১৯। তার চাহিদা বা শখ দুটি। একটি হলো বিড়াল পোষা আর অন্যটি হলো শরীরচর্চা। দিনের নির্দিষ্ট সময় দু-তিন ঘণ্টা সে ব্যয় করে শরীরচর্চায়। একটি জিমে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি।

সেখানে নিয়মিত যায়। গাড়ি বা রিকশা ব্যবহার করে না। হেঁটেই যেতে এবং আসতে ঘণ্টাখানেক লাগে। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক হেঁটেই সেখানে যাবে। তার একটি মানিব্যাগ আছে কিন্তু সেখানে কোনো টাকা থাকে না।

কারণ সে আমাদের কাছ থেকে কোনো হাতখরচা নেয় না। সাধাসাধি করলে বড়জোর ১০ টাকা নেয় ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্য। তাও আবার নিয়মিত নয়। কালেভদ্রে। বাসায় ফিরে বিড়ালের পেছনে কিছু সময় ব্যয় করে।

বাকিটা সময় লেখাপড়া এবং টিভি দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তার প্রিয় বিড়ালটি কয়েক দিন আগে হারিয়ে গেছে। এ নিয়ে সে দারুণ মনঃক্ষুণ্ন। প্রিয় বিড়ালটির শোকে প্রায়ই মুখ ভার করে থাকে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিড়ালের বাচ্চা তালাশ করে কিন্তু মনের মতো পায় না।

আমি যখন আমেরিকায় তখন নাকি বিড়ালটা বাসা থেকে চলে যায়। আর এই দুঃখে সে আমাকে রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে যায়নি।

বড় ছেলের সঙ্গে তার মায়ের প্রায়ই খটমট লাগে তিনটি বিষয় নিয়ে। বিড়াল, ব্যায়াম আর টিভি। সে মনে করে এত বড় ছেলে! এসব করা ঠিক নয়।

ওর উচিত সারা দিন পড়াশোনা করা এবং ছোট ভাইবোনদের তদারক করা। রোজই খটমট হয় এবং আমার মধ্যস্থতায় তা আবার মিটে যায়। কিন্তু আমার আমেরিকা যাওয়ার আগে থেকেই ফিরে আসা পর্যন্ত মা-ছেলের এই নিত্যকার মতানৈক্য আমি মেটাতে পারিনি। ফলে উভয়ের মধ্যে বেশ ক্ষোভ জমা হয়েছিল। এর ওপর আমার নিজের কষ্ট এবং বিড়ালটি হারিয়ে যাওয়ার কারণে পুরো পরিবেশ কেমন জানি অস্বস্তিকর হয়ে পড়েছিল।

 

২৮ বছরের বিবাহিত জীবনে যা হয়নি তা হচ্ছিল আমেরিকা থেকে ফেরত আসার পর। অফিস থেকে ফেরার পর রাজ্যের সব অভিযোগ এবং যাওয়ার সময় পুনরাবৃত্তি। কমন কথা, এমপিগিরি করে কী হবে? ছেলেমেয়ের দিকে নজর দিচ্ছ না। কেউ লেখাপড়া করছে না। সারা দিন টিভি দেখে।

বড়টা বিড়ালের শোকে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে সারা দিন ব্যায়াম করছে ইত্যাদি। আমি শুধু শুনি এবং দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইরে চলে যাই। বাইরে বলতে অফিসে। কিন্তু কোনো কাজেই মন বসাতে পারছি না। বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রতি সপ্তাহে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছিলাম 'মোগল হারেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম' শিরোনামে।

প্রচণ্ড সাড়া পাচ্ছিলাম সব দিক থেকে। কিন্তু তাও লিখতে পারছিলাম না। বিভাগীয় সম্পাদক সুমন পালিতকে বললাম রোজার মাসে আর লিখতে পারব না। পরবর্তী পর্ব ঈদের পর। সেভাবেই তারা পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে দিল।

আমি বিষণ্ন মনে প্রায়ই একা একা রাস্তায় হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম রাত-বিরাতে। এরই মধ্যে একদিন ঘটে গেল জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং নৃশংসতম দুর্ঘটনাটি।

যথারীতি সেদিন অফিসে যাচ্ছিলাম সকাল ১০টার দিকে। গিন্নি বলল তোমার ছেলেকে বলে যাও ও যেন আজ থেকে ব্যায়াম করতে না যায়। আর অফিসে গিয়েই গাড়িটি পাঠিয়ে দিও।

ঠিক আছে বলে ছেলের রুমে ঢুকলাম। দেখি সে চুপচাপ শুয়ে আপন মনে কী যেন ভাবছিল। আমাকে দেখেই উঠে বসল। বললাম, আজকে তুমি কী করবে। সে জানাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত পড়ব এবং এরপর জিমে যাব।

আমি কিছু না ভেবেই বললাম আজ থেকে তোমার জিমে যাওয়া বন্ধ। বলার সঙ্গে সঙ্গে ও ভীষণ রকম গম্ভীর হয়ে সজল চোখে আমার দিকে তাকাল, এরপর জিজ্ঞাসা করল একটু নিচেও হাঁটতে যেতে পারব না। আমি ফিরে তাকালাম এবং বললাম তুমি তো সব কিছু বোঝ! এ মুহূর্তে অশান্তি সৃষ্টি করো না। চুপচাপ পড়তে থাক। বলেই আমি বের হয়ে গেলাম।

অফিসে পৌঁছেই গাড়ি বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, একটার পর একটা ফোন আসছিল মোবাইলে। এমন সময় অফিসের ফ্রন্ট ডেস্কের পিএবিএক্স থেকে অপারেটর জানাল বাসা থেকে জরুরি ফোন এসেছে। অন্যপ্রান্তে আমার মেয়ে নন্দিতা চিৎকার করে কাঁদছিল, বাবা তুমি কোথায়। ভাইয়া মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।

টেলিফোনে পরিবারের অন্য সবার কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। ড্রাইভারকে ফোন করে বললাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে এসো। আমি পাগলের মতো শুরু করলাম দৌড় এবং কোনোমতে প্রেসক্লাব পর্যন্ত পৌঁছে একটি রিকশা পেলাম। বাসার গাড়ি আসার আগেই আমি জরুরি বিভাগের সামনে পৌঁছালাম।

মাথা কাজ করছিল না। পরিচিত যত ডাক্তারের নাম্বার ছিল সবাইকে ফোন দিলাম। দুর্ভাগ্য, কাউকে পেলাম না। জরুরি বিভাগের কিছু কর্মচারী আমার মুখ চিনত। আমি তাদের ঘটনা বলে একটি টিকিট কেটে ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমি তখনো জানি না আমার ১৯ বছরের প্রিয় পুত্র জীবিত না মৃত!

মনে হচ্ছিল আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র এবং অসহায় এক মানুষ, যে কি না ভিক্ষুকের মতো ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখের পানি এবং শরীরের ঘাম একাকার হয়ে আমার মুখমণ্ডল ভেসে যাচ্ছিল। হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। কিশোর বয়সে আমি পিতা হয়েছিলাম সেই ১৯৯৩ সালে। রিয়াদের সঙ্গে আমার দৈহিক এবং মনোজাগতিক সম্পর্ক ভাষায় বোঝানো যাবে না।

লম্বায় প্রায় ছয় ফিট। ব্যায়াম করতে করতে শরীর এমন পেশিবহুল এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত করে ফেলেছিল, যে কোনো পিতাই তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুদর্শন ছেলেটি আমি বাসায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিত এবং সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরত। প্রায়ই আমার ঠোঁটে চুমু দিত এবং আমি শুয়ে থাকলে বুকের ওপর মাথা রাখত। প্রায়ই হাত-পা টিপে দিত।

বিশেষত সকালে নাশতার সময় আমি চেয়ারে বসে খেতাম আর ও ফ্লোরে বসে আমার পা টিপতে থাকত। অন্য দুটি সন্তানও একই কাজ করত। বর্তমান জমানায় এমন অনুগত সন্তান আমি কোথাও দেখিনি। এ নিয়ে আমার তৃপ্তি, আনন্দ এবং মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতার সীমা-পরিসীমা ছিল না। সেই ছেলে সিলিংফ্যানের ময়লা পরিষ্কার করতে গিয়ে চেয়ার উল্টে খাটের কোনায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যাচ্ছে, ভাবতেই পারছিলাম না।

আমার নিজেরই তখন মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। একবার ভাবলাম যদি ওর কিছু হয় তবে আমিও মরে যাব!

আমি যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছিলাম এবং কাঁদছিলাম তখন প্রায় ৬০-৭০ জন মানুষ ঘিরে ধরে আমাকে দেখছিল। এমপি রনি কাঁদছে- কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছিল না। আবার কৌতূহল চেপেও রাখতে পারছিল না। কয়েকজন ডাক্তার ছুটে এলেন।

আমি নির্দ্বিধায় আমার দুঃখের কথা বললাম। সমব্যথী লোকজনসহ সবাই অপেক্ষা করছিলাম গাড়ির জন্য। অবশেষে গাড়ি এলো। আমার স্ত্রী, বাসার কেয়ারটেকার ও দারোয়ান মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফটরত রিয়াদকে নিয়ে এসেছে। ধরাধরি করে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলাম।

প্রচণ্ড গরম। নিউরো বিভাগসহ আশপাশের সব ডাক্তারই ছুটে এলেন। ছেলের শরীরে শুরু হয়েছে খিঁচুনি। একটি পুরনো গামছার সাহায্যে ফ্যান পরিষ্কার করতে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রথম চেয়ার থেকে ছিটকে খাটের ওপর পড়ে যায় এবং মাথায় আঘাত পায় খাটের কোনার সঙ্গে।

এরপর পুনরায় পড়ে যায় খাট থেকে ফ্লোরে। শুরু হয় খিঁচুনি, সঙ্গে অস্পষ্ট চিৎকার। ফ্লোরে পড়ে গড়াতে গড়াতে দরজার কাছে এসে আটকে যায়। আমার স্ত্রী যখন বিষয়টি টের পায় তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিল দরজা খুলতে না পারা। কারণ দরজাঘেঁষে রিয়াদ ফ্লোরে ছিল।

বিল্ডিংয়ের সব লোক ছুটে আসে এবং বহু চেষ্টায় তাকে রুম থেকে বের করে গাড়িতে তোলা হয়। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে অনেকটা অপ্রকৃতিস্থ। সবাইকে বললাম তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ বাসায় অন্য দুটি শিশু তখন অঝরে কাঁদছিল। অন্যদিকে হাসপাতালে ছেলের ছটফটানি এবং এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা পদ্ধতি দেখলে সে নির্ঘাত সংজ্ঞা হারাত।

বাসার লোকজন জোর করে তাকে নিয়ে গেল। আমি ডাক্তারদের সঙ্গে রইলাম।

প্রথম সমস্যা দেখা দিল ছেলেকে অজ্ঞান করা। কিন্তু কিছুতেই ডাক্তাররা তা পারছিলেন না। সর্বশক্তি দিয়ে রিয়াদ হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছিল এবং সারা শরীর বার বার বেঁকে যাচ্ছিল।

সঙ্গে আর্তচিৎকার। প্রায় ২০-২৫ জন তার হাত-পা চেপে ধরেও ইনজেকশন দিতে পারছিল না। এর মধ্যে নাকের ভেতর অক্সিজেনের নল পরানো হলো এবং অক্সিজেন গ্রহণের মাত্রা দেখে ডাক্তাররা আশ্বাস দিলেন যে রোগী হয়তো বেঁচে যাবেন। প্রচণ্ড গরমে আমরা সবাই দরদর করে ঘামছিলাম। রিয়াদও ঘামছিল।

ফলে তার ঘর্মাক্ত শরীর কিছুতেই চেপে রাখা যাচ্ছিল না। ডাক্তাররা বার বার চেষ্টা করেও ইনজেকশনের সুই ফোঁড়াতে পারলেন না। অধিকন্তু ওইসব জায়গা থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছিল। আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম। একজনকে বললাম হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার সাহেবকে খবর দেওয়ার জন্য।

তিনি এলেন এবং যথেষ্ট আন্তরিকতা নিয়ে বললেন এ রোগী এ মুহূর্তে আইসিইউতে না নিলে বাঁচবে না। আমি তার হাত ধরে মিনতি করে কাঁদতে থাকলাম। তিনি সব প্রটোকল ভুলে আইসিইউর দিকে দৌড় দিলেন এবং পাঁচ মিনিটের মাথায় ফিরে এলেন একটি সিটের ব্যবস্থা করে।

ডাক্তাররা এরই মধ্যে অনেক কষ্টে রিয়াদের শরীরে চেতনানাশক ইনজেকশন দিতে পেরেছেন। সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ প্রয়োগ করার পরও তার খিঁচুনি থামছে না।

আমরা সর্বশক্তি দিয়ে তার হাত-পা চেপে ধরে আছি। ওই অবস্থায়ই তাকে আইসিইউতে নেওয়া হলো এবং ঘণ্টাখানেক পর খিঁচুনি কিছুটা কমল। ছেলে আমার আইসিইউতে টানা ৪৮ ঘণ্টা অচেতন হয়ে পড়ে রইল। আর আমরা অসহায় অবস্থায় আইসিইউর বাইরে চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম।

আমার পরিবারের যখন এমন করুণ অবস্থা তখন একদিকে সংসদ চলছিল আর অন্যদিকে চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠান হচ্ছিল।

সিলেট থেকে অনেকে ফোন করে সেখানে যেতে বলল। বিশেষ করে রাজশাহী থেকে পলক এমপি ও শাহরিয়ার এমপি বার বার ফোন করছিল সেখানে গিয়ে প্রচারণায় অংশগ্রহণের জন্য। তাদের মতে ওখানে অনেকেই নাকি আবদার করছে গোলাম মাওলা রনিকে নির্বাচনী প্রচারে নামানোর জন্য। প্রথমে ওদের আমার দুঃখের কথা বললাম না। কিন্তু তারা যখন পুনঃপুনঃ অনুরোধ জানাতে থাকল তখন বললাম যে আমার বড় ছেলে এখন ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে অচেতন হয়ে পড়ে আছে।

এরই মধ্যে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ভাই অন্য একটি রোগী দেখতে এসেছিলেন। আমার কথা শুনে এগিয়ে এলেন এবং ছেলেকে দেখে গেলেন।

৪৮ ঘণ্টা পর আমার ছেলের জ্ঞান ফিরল বটে কিন্তু পরিস্থিতি আরও মারাত্দক আকার ধারণ করল। তার মস্তিষ্কের নিউরো সিস্টেম খানিকটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। সে এলোমেলো কথা বলছিল এবং বিছানা থেকে লাফ মেরে চলে যেতে চাইছিল।

কেউ বাধা দিতে এলে সজোরে ধাক্কা মারছিল। কেবল আমি ছাড়া আর কারও কথা সে শুনছিল না। ডাক্তাররা তাকে আরও দু-তিন দিন ঘুমের ওষুধ দিয়ে অচেতন করে রাখলেন। আমাদের হাহাকার বাড়তে থাকল। অবশেষে আল্লাহর মেহেরবানিতে সে একটু ঠিক হলে তাকে ক্যাবিনে স্থানান্তর করা হলো।

মেডিকেল বোর্ড বসল এবং তাদের পরামর্শমতো আরও প্রায় ১০ দিন হাসপাতালে থাকতে হলো। রিয়াদ আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠছিল। তার কথাবার্তা একদম শিশুর মতো হয়ে গেল। সারা দিন আমার খোঁজ করত। সামনে এলেই জড়িয়ে ধরত আর বলত বাবা আমাকে বাঘের মতো একটি বিড়াল কিনে দাও।

আমি নীরবে চোখের পানি ফেলতাম।

ডাক্তারের পরামর্শমতো আমরা বাসায় ফিরলাম। রিয়াদের পুরোপুরি ভালো হতে আরও দু-তিন মাস লাগতে পারে। এ সময়টি তার সঙ্গে আমাদের কেমন ব্যবহার করতে হবে তা আমাদের বুঝিয়ে বলা হলো। বাসায় ফেরার পর ওকে নিয়ে কাঁটাবন মার্কেটে গিয়ে একটি পছন্দসই বিড়ালের বাচ্চা কিনে দিলাম।

বিড়াল পাওয়ার পর তার অবস্থা দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকল। আমাদের স্বামী-স্ত্রীর গুমোট ভাব কাটল। আমরা স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছিলাম। কিন্তু মনে মনে ছেলের করুণ পরিণতির জন্য একে অন্যকে দায়ী করছিলাম। ঠিক এ সময় শুরু হলো গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন।

কাল পড়ুন 'ডিবি অফিসের লাঠিভীতি, মেঝেতে ঘুমহীন রাত' 

(বাংলাদেশ প্রতিদিন- এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। )

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।