আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৪০ বছর ধরে চলছে খাল দখল

রাজধানীর বেদখল হওয়া খালগুলো আর উদ্ধার করা গেল না।

প্রায় ৪০ বছর ধরে খাল দখল, উচ্ছেদ আর পাল্টা দখলের খেলা চলছে। ইঁদুর-বিড়াল, চোর-পুলিশের মতো চক্রাকারে দখল-বেদখলের ফাঁকেই ১৭টি বড় খালের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বাকি ২৬টি খালও দখলদারদের কবলে আটকে আছে। অতি সম্প্রতি পাঁচটি খাল ব্যক্তি মালিকানায় রেজিস্ট্রি করে নেওয়া হয়েছে, সেসব বেচাকেনাও চলছে প্লট আকারে।

খালগুলো উদ্ধারের নামে চার দশকে রাজউক, ডিসিসি ও ঢাকা ওয়াসা ছোট-বড় নানা আকারের অসংখ্য উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহায়তায় মোবাইল কোর্টের উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে অন্তত ২১১ বার। রাজউক ও সিটি করপোরেশনে নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের তত্ত্বাবধানেও পৃথকভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে একের পর এক বস্তিঘর, বিল্ডিং স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে উদ্ধার করা জায়গাজমি দুই সপ্তাহের বেশি সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। কারণ উচ্ছেদের পর হাঁটার পথ নির্মাণ না করায় আবার দখল হয়ে যায় খালগুলো।

সংশ্লিষ্ট দফতরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে বারবারই জবরদখল হয়ে গেছে খালের জায়গা। খাল দখল করার কৌশলগুলোও প্রায় অভিন্ন। শুরুতে সে াতবাহী খালের পানিতে খুঁটি পুঁতে মাচান বানিয়ে শত শত বস্তিঘর বানানো হয়। এর পর ময়লা-আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট ফেলে ভরাট করা হয় খাল, ছোট ছোট বাঁধ দেওয়ারও নজির রয়েছে। একপর্যায়ে প্রভাবশালী মহল এগিয়ে যায়, গড়ে তোলে পাকা স্থাপনা ও বড় বড় অট্টালিকা।

ঢাকা ওয়াসা, ডিসিসি, রাজউক ও ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশকে ঢাকা শহরে সচল খাল ছিল ২৫০ কিলোমিটারেরও বেশি। বর্তমানে প্রবাহমান খাল আছে বড়জোর ৭০ কিলোমিটার। তাও ভরাট-দখলে ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আগে একটি খালের সঙ্গে আরেকটি খালের সংযোগ ছিল, যুক্ত ছিল অনেক নালা-ড্রেনের। খালগুলোর মূল সংযুক্তি ছিল নগরীর উত্তর ও পশ্চিমের তুরাগ, দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা ও পূর্বে বালু নদীর সঙ্গে।

প্রায় সারা বছরই খালগুলো সচল নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করা হতো, ব্যবসায়ীরা মালামাল বোঝাই নৌকা নিয়ে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলের বিভিন্ন পয়েন্টে যাতায়াত করতে পারতেন। এখন সেসবই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিমাত্র। ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে দখলদাররা। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না দখলদারদের বিরুদ্ধে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খালগুলো দখলমুক্ত রাখতে হলে একদিকে দখলদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, অন্যদিকে খালের দুই ধারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করতে হবে।

গত কয়েক দিন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে রাজধানীর খালগুলোর বেহালচিত্র লক্ষ্য করা গেছে। সুলতানগঞ্জ থেকে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ রায়েরবাজার খাল, গোপীবাগ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত গোপীবাগ খাল, সায়েদাবাদ থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত জিরানী খাল, শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত থাকা পরীবাগ খাল সরকারি উদ্যোগেই ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। রামপুরায় বিদ্যমান সাঁতারকুল খাল ভরাট করে হাউজিং প্রকল্প হয়েছে। ধোলাইখাল ভরাট করে বানানো হয়েছে প্রশস্ত রাস্তা। ধলপুর, নন্দীপাড়া, খিলগাঁও খালজুড়ে বঙ্ কালভার্ট নির্মাণের নামে আশপাশের লোকজন জবরদখল করে ইমারতাদি গড়ে তুলেছে।

এভাবেই একের পর এক খাল হারিয়ে গেছে।

মোহাম্মদপুর থেকে কাটাসুর পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রামচন্দ্রপুর খাল। প্রায় দেড়শ ফুট প্রশস্ত খালটি ভরাট করে প্রভাবশালীদের অফিস, বহুতল ভবন গজিয়ে উঠেছে, সরকারি লিজও দেওয়া হয়েছে খালের জায়গা। মোহাম্মদপুর থেকে বসিলা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার দীর্ঘ হাইক্কার খালটি রক্ষার নানা চেষ্টা ব্যর্থ হতে বসেছে। নতুন করে খালের দুই ধারে দখলের উৎসব শুরু হয়েছে।

ভরাট করে বস্তিঘর থেকে শুরু করে পাকা ভবন পর্যন্ত তৈরি করা হচ্ছে, খালটির বাকি অংশে ফেলা হচ্ছে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য। এয়ারপোর্ট থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বিস্তৃত উত্তরা খাল ভরাট করে এরই মধ্যে দখল করে নেওয়া হয়েছে। ওয়াসার রেকর্ডে সচল বলে চিহ্নিত ২৬টি খালের তালিকায় নাম রয়েছে হাজারীবাগ খালের। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এ খাল ব্যক্তি মালিকানায় আরও কয়েক বছর আগেই রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। গত বছর জেলা প্রশাসন খালটি উদ্ধারের ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু করলেও বাস্তবে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।

এসব ছাড়াও বড় বড় যে পাঁচটি খালের বেশির ভাগই ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডপত্র সম্পন্ন হয়েছে সেগুলো হচ্ছে মাণ্ডা খাল, হাজারীবাগ খাল, কসাইবাড়ী খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল ও বাইশটেকি খাল। এসব খাল উদ্ধার করে আবার পানি প্রবাহের উপযোগী করে তুলতে হলে নতুন করে তা কিনে নিতে হবে। আবার রেজিস্ট্রি করে নেওয়া ছাড়া ওয়াসা সেসব খালে কোনো উন্নয়ন কাজে হাত লাগাতে চায় না মামলা ও আইনি বেড়াজালের ভয়ে।

খাল উদ্ধার-উন্নয়নে নানা প্রকল্প : ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুই দিনের টানা বর্ষণে নগরীর প্রধান সবকটি সড়ক তলিয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরীর খাল ভরাট ও দখলমুক্ত করে প্রবহমান রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

স্বাধীনতার পরও ঢাকার খাল রক্ষার কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ১৯৮৭ সালে জাপান সরকারের সহায়তায় ড্রেনেজ সিস্টেম ইমপ্রুভমেন্ট অব মেট্রোপলিটন স্টাডি পরিচালনা করা হয়। প্রতিবেদনে নগরীর খালগুলো উদ্ধার ও রক্ষার সুপারিশ করা হয়। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়ে নগরবাসী। নড়েচড়ে বসে সরকার।

পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য নগরীর খালগুলো প্রবহমান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে এফএপি-৮ এবং ৮বি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। ২০০৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার, পুনরুদ্ধার ও পুনরায় চালুর সুপারিশ করে কমিটি। ২০টি খাল উদ্ধারের পরিকল্পনা, সীমানা নির্ধারণ করার পরিকল্পনা ও পুনঃখনন করার কথা থাকলেও সেসবের কিছুই হয়নি। বরং আরও দখলের কবলে সঙ্কুচিত হয়েছে খালগুলো।

২০০৮ সালে আবার খাল উদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশ্বব্যাংকের পাঁচ বছরমেয়াদি কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ চলবে। এ প্রকল্পের কাজ চলছে ঢিমেতালে। তবে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খালের যে অংশ বর্তমান রয়েছে শুধু সেটুকুতে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রয়োজন হচ্ছে আগে ওই খালগুলো দখলমুক্ত করা।

কিন্তু তা করা হচ্ছে না।

ওয়াসার বক্তব্য : ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিগত দিনে নগরীর খাল উদ্ধারে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সত্যিকার অর্থে কোনো খালই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমানে সুদূর পরিকল্পনা নিয়ে খাল উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। খালগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েই প্রথমে খনন করা হবে এবং দুই ধারে ওয়াকওয়ে (হাঁটার পথ) তৈরি করা হবে। গাছ লাগিয়ে গ্রিনবেল্ট গড়ে তোলা হবে।

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও জানান, এরই মধ্যে দুটি মডেল প্রকল্প হিসেবে খাল উদ্ধারপূর্বক গ্রিনবেল্ট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করা হয়েছে। জলবায়ু ইনস্টিটিউটের সভাপতি প্রকৌশলী ইনামুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানীর খালগুলো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও তাদের সহায়তায় সমাজের প্রভাবশালীরা দখল করে নিচ্ছে। আর প্রশাসন এসব দখলদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে খাল দখল বন্ধ হচ্ছে না, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হচ্ছে না দখলদারদের। এ অবস্থায় খাল-নদী দখল বন্ধ করা যাবে না।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা নগরীর বর্তমান খালগুলো দখলমুক্ত করতে অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। উদ্ধার কার্যক্রমে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দখলদাররা বেশির ভাগই রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, প্রভাবশালী ব্যক্তি। অভিযানে গেলেও সেসব উচ্ছেদ করা যায় না।

 

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।