আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ট্রিপ কাহিনীঃ বাকৃবি টু কালীগঞ্জ

এই ব্লগের যাবতীয় কর্মকান্ড জুনায়েদ খানের অনুর্বর মস্তিষ্কের অহেতুক পাগলামি ! বৈ কিছু নয়।

মাত্র ৪ দিন পরেই ঈদ। অথচ ঈদের কথাটি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম এ কয়েকদিনে। সকাল ৯ টা থেকে রাত ২ টা পর্যন্ত বিরতিহীন ভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে, গোসল কোনদিন হয়েছে আবার কোনদিন শুধু হাফ গোসল সেরেই তুষ্ট থাকতে হয়েছে, একরুমে ১৯ জন গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে, কিন্তু তারপরও কি যেন একটা ছিল এ কয়েকদিনে। এই ‘কি যেন একটা’-র জন্য ৬ ঘন্টার জ্যামটাকেও জ্যাম মনে হয়নি; প্রতিদিন ১৭ ঘন্টার খাটুনিটাকেও খাটুনি মনে হয় নি।

Extension Field Trip -এর কথা বলছিলাম। ৬ দিনের প্রথম দিনটা বলতে গেলে বাসেই কেটেছে। বাসের পিছন দিকটা দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে এটা বাস না অন্য কিছু! সিটগুলা ভর্তি ব্যাগ আর লাগেজে আর ব্যাগ আর লাগেজের পৃষ্ঠতল ভর্তি মানুষ! যার যেমন খুশি সেভাবে বসেছে, কেউবা সুলতানী কায়দায় সানগ্লাস চোখে বালিশ চেপে শুয়ে পড়েছে আবার কেউবা ব্যাগটাকেই বালিশ বানিয়ে দু’পা দুদিকে ছড়িয়ে বেসুরে গলায় গান শুরু করে দিয়েছে– ‘মন যাতনা পিরিতি তুই আমারে শিখাইলি এখন কেন দূরে দূরে পালায়া বেড়াস...’ পুবাইলে(গাজীপুর) এসে বাস জ্যামে থেমে গেল। কিন্তু থামল না আমাদের সংগীত চর্চা। সকাল থেকে দুপুর হল, দুপুর পেড়িয়ে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এল কিন্তু বাস যে পুবাইল সেই পুবাইলেই থেকে গেল।

এগুলো না। সবার পেট ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে তারপরও চিঁ চিঁ করে গান চলছে। বিরতিহীন-সমগ্র বাস! থেকে থেকে কোন এক বান্ধবীর ব্যাগ থেকে একটা করে বিস্কুটের প্যাকেট বের হচ্ছে আর সেটাই সবাই কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। খাবার প্রচন্ড ইচ্ছা, কিন্তু খাবার নেই। বাসেও নেই, রাস্তা ঘাটেও নেই! হঠাৎ এক পপকর্নওয়ালার দেখা মিলল।

নিমিষেই সব পপকর্ন উধাও হয়ে গেল। ধুলোবালি যুক্ত রাস্তার পাশের যে পপকর্ন এতদিন অখাদ্য ছিল, সেই পপকর্নই আজ সুস্বাদু হয়ে উঠল! ঠেলায় পড়লে বাঘেও ধান খায়! আর সেখানে তো আমরা মানুষ! কালীগঞ্জ পৌঁছলাম সন্ধ্যে ৭ টায়। বাসে ওঠার ঠিক ১১.৫ ঘন্টা পর। পরদিন থেকে শুরু হল ব্যস্ততা। একটা ক্লাস শেষ হবার আগেই আরেকজন স্পিকার এসে বসে থাকেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা ভূমি ব্যবস্থাপনা অফিসার, উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসার, উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসার, উপজেলা মহিলা ও শিশু বিষয়ক অফিসার, উপজেলা কৃষি অফিসার, উপজেলা মৎস্য অফিসার, উপজেলা মেডিক্যাল অফিসার, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, উপজেলা প্রকৌশলী, ব্র্যাক অফিসারসহ অনান্য অফিসারগণ যে অসাধারণ ক্লাসগুলো নিয়েছেন সেগুলোর কোন তুলনা হয়না। এতদিন শুধু উপজেলা প্রশাসনকেই দেখে এসেছি, উপজেলা প্রশাসন কিভাবে পরিচালিত হয় জানা ছিল না। আসলেই- ‘জানার আছে অনেক কিছু!’ একটা ছোটখাট নৌকা ভ্রমণও হয়ে গেল একদিন। শীতলক্ষ্যা নদীতে প্রায় ১০ কিলোমিটার। গাজীপুরের কালীগঞ্জ টু নারায়ণগঞ্জের উত্তর রূপগঞ্জ।

‘উত্তর-রূপগঞ্জ সেচ প্রকল্প’ ভিজিট করতে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ এবং চীন সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এ প্রকল্পটি হয়ে ১৯৯০ সাল থেকে কালীগঞ্জ এবং রূপগঞ্জের ৩টি ইউনিয়নের কৃষকদের বিনামূল্যে সেচ সুবিধা দিয়ে আসছে। স্মরণীয় হয়ে থাকবে প্রাণ গ্রুপের ‘আরএফএল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ ভিজিট টাও। প্রাণের তথ্য মতে ‘প্রাণ’ এশিয়ার সবচেয়ে বড় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। কি নেই প্রাণের? আপেল জুস, কোকোনাট জুস, লেমন জুস, অরেঞ্জ জুস, ম্যাঙ্গো জুস, লিচি জুস, ড্রিঙ্কস, বেভারেজ, কনফেকশনারি, কিউলিনারি, স্ন্যাকস, বিস্কুট, ক্যান্ডি, বেকারী, ডেইরী প্রডাক্ট! এসবের অধিকাংশই আমাদের হাতে পৌঁছায় না।

পৃথিবীর প্রায় ৯০ টি দেশে বিভিন্ন নামে রপ্তানী করা হয় এসব পণ্য। বাংলাদেশে যেটা ‘ফ্রুটো’ নেপালে সেটা ‘রিও’, কানাডায় ‘মিনার’ এবং নিউজিল্যান্ডে সেটা ‘ডিসকভারি’ নামে পরিচিত। আমাদের কে রিও গিফট করা হল। আলাদা কিছুই নেই। ঐ যাহা বিশ তাহাই কুড়ি! প্রসেসিং প্লান্ট গুলো এক এক করে ঘুরে দেখলাম।

অনেক ভুল ভেঙ্গে গেল। জুসে মিষ্টি কুমড়া না, অরিজিনাল পাল্প-ই ইউজ করে তারা। আরএফএল ও প্রাণের মত এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্লাস্টিক প্রডাক্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। অ্যামেরিকার টপ টু কোম্পানি Walt-Disney এবং Cajoric এর সাথে তারা চুক্তি বদ্ধ। আরএফএল এর ম্যাক্সিমাম প্রডাক্ট-ই বাইরে চলে যায়।

তারপরও দেশের ৬৭% প্লাস্টিক পণ্য সাপ্লাই দেয় তারা। ১৯৮১ সালে রংপুরে টিউবওয়েল দিয়ে শুরু করা এ প্রতিষ্টানটি সম্প্রতি শুরু করেছে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য উৎপাদন। নিউ লাইন্স ইলেকট্রনিক্স আরএফএলএল-ই। কিছুদিনের মধ্যে বাজারে আসবে আরএফএল এর মোটর সাইকেল এবং সাইকেল – ‘দুরন্ত’। ধন্যবাদ জানাই মেজর জেনারেল(অবঃ) আমজাদ খান চৌধুরীকে, ‘প্রাণ-আরএফএল’ এর মত এমন একটি বাংলাদেশী কোম্পানী দেশ কে উপহার দেবার জন্য।

এক্সটেনশন ফিল্ড ট্রিপের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী ফেরার আগের রাতে হয়ে গেল এক ‘মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা’। মাত্র দু’রাতের প্রচেষ্টায় এমন একটা অনুষ্ঠান করা সম্ভব সেটা অনুষ্ঠানটা না দেখলে বোঝা সম্ভব না। ইউএনও সাহেব এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি তার স্পিসে না বলে পারলেন না- “ভালো রেজাল্ট করলে হয়তো একদিন তোমার নাম পেপারে আসবে, কিন্তু আর্টিস্ট হলে প্রায় প্রতিদিন তোমার নাম পেপারে আসবে। সাকিব আল হাসান কিংবা শচীন টেন্ডুলকার কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন এটা কেউ মনে রাখে না!” আমিও মাঝে মাঝে আমার বন্ধুদের প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। ধন্যবাদ তোদের।

তোরা ছিলি বলেই হয়তো ভার্সিটির সম্মানটা রক্ষা হয়েছে। ধন্যবাদ জানাই কালীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে। তাদের আন্তরিকতায় আমরা বিমুগ্ধ। বিশেষকরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহ সাত বাকৃবিয়ানের আতিথিয়তা ভোলার মত নয়। ভার্সিটির ছোটভাইদের এবং নিজের স্যারকে পেয়ে ইউএনও সাহেব যেন স্বর্গ হাতে পেয়েছিলেন।

কি ছেড়ে কি করবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছিলেন না। ফেরার আগের দিন শুধু আমাদেরকে দেখানোর জন্য স্পেশাল মোবাইল কোর্ট বসিয়েছিলেন তিনি। ইউএনও কামরুল আহসান তালুকদার, আপনাকে মনে থাকবে অনেকদিন। কৃতজ্ঞতা জানাই কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে এবং এ বিভাগের শ্রদ্ধেয় দুই স্যার – প্রফেসর ডঃ মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন মিয়া এবং জনাব হুমায়ুন কবীর কে। স্যার, আপনারা অন্যসব স্যারদের থেকে আলাদা এবং আপনাদের ডিপার্টমেন্টও অন্যসব ডিপার্টমেন্ট থেকে আলাদা।

১০.১০.২০১৩। রাত ১১ টা। স্বাপ্নিক কয়েকটি দিনের সমাপ্তিক্ষণ। যে দিনগুলো অন্যসব দিনের মত নয়, একটু অন্যরকম। মনে রাখার মত।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।