আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এনজিও পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে গড়ে উঠছে নানারকম আত্মসাৎ বাণিজ্য।

কাঙাল মানুষ, কাঙাল মন / আগা-গোড়া কাঙালী জীবন/ দুঃখ করি না, দুঃখ দিই না/ জোৎস্নার দিঘীতে স্নান দিয়ে/ সুখে ভাসতে চাই।

ক্ষুদ্রঋণ বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এখন একটি বিশ্বজনীন বিষয়ে রূপ লাভ করেছে। বলা যায়; ক্ষুদ্রঋণ এখন বাঁক ঘুরে মোহনায়। বাংলাদেশে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা মুলত: দুইভাগে বিভক্ত। একপক্ষে ক্ষুদ্রঋণের মুলধারা বাস্তবায়নকারী; গ্রামীণ ব্যাংক মডেল এবং অপরপক্ষে অন্যান্য এনজিও কর্তৃক পরিচালিত; এনজিও মডেল।

দু’পক্ষের পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচী ও সরকারী অনুমোদন অভিন্ন নয়। গ্রামীণ ব্যাংক বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় অপরপক্ষে এনজিও পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ পরিচালিত হয় মাইক্রেক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) এর তত্ত্বাবধানে। আলোচিত দুই ভাগে পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ ছাড়াও অঘোষিতভাবে সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান পরোক্ষভাবে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করে যাচ্ছে। মোদ্দাকথায় বলা যায় দেশে এপর্যšত ক্ষুদ্রঋণের কোন কার্যকর সার্বজনীন জাতীয় নীতিমালা গঠিত হয়নি। শুধু তাই নয়, তার পাশাপাশি শক্ত হাতে নীতিমালা বা¯তবায়ন বা মনিটরিং করার মতো দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপও এপর্যšত নেয়া হয়নি।

যার ফলে দেশে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনায় শুরু হয়েছে মাফিয়া পর্যায়ের দুর্নীতি আর অনিয়ম। অধিকাংশ এনজিও পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যেহেতু ট্রাষ্টি বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হয় সেহেতু সরাসরি মালিকানা থাকে না। বস্তুত বাংলাদেশে কর্মরত এনজিও কর্তৃক পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত মালিকানা বা¯তবিক অর্থে হওয়া উচিত দরিদ্র জনগণ, যা সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃতি ও গণমাধ্যমে প্রচার করাও জরুরী। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী এনজিওগুলোর অধিকাংশক্ষেত্রে ঝববফ গড়হবু (প্রাথমিক বিনিয়োগ অর্থ) উৎস কোন অনুদান কিংবা দাতাদের টাকা থেকে নেয়া, যা দাতাগোষ্টি সাধারণত তৃণমুল মানুষের জীবনমান উন্নয়ণে দিয়ে থাকেন। এছাড়াও বেশীরভাগ ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী এনজিওগুলোর ঘুর্ণায়মান ঋণ তহবিলের (জখঋ) প্রায় ৭০/৮০ শতাংশ টাকা দরিদ্র জনসাধরণের সঞ্চিত অর্থ।

দরিদ্র মহিলাদের সঞ্চিত অর্থের কথা মাথায় রেখে গ্রামীণ ব্যাংক মডেলে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী পরিচালনা পরিষদে দরিদ্র মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব থাকলেও এনজিও পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোন গ্রাহক কিংবা দরিদ্র জনসাধরণের প্রতিনিধিত্ব রাখা হয় না। বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওগুলোর সংবিধান কিংবা অর্থায়ন বিষয়টি বিবেচনা করলেও একথা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা কার হওয়া উচিত। মালিকানার এই দ্বন্ধে দেশে কর্মরত অনেক এনজিওগুলোতে কর্মরত উচ্চ পর্যায়ের কিছু অসাধু চতুর কর্মকর্তাদের সংঘবদ্ধতায় সম্প্রতি গড়ে উঠছে পরাক্রমশালী ঈশ্বর সম্প্রদায়। ঈশ্বর সম্প্রদায় মধ্যম বা মাঠ পর্যায়ের উন্নয়নকর্মীদের বঞ্চিত করে যাবতীয় সুবিধাগুলো নিজেদের করার পাশাপাশি গড়ে তুলছে নতুন নতুন দুর্নীতির পথ। সরকারী খাতের দুর্নীতির পাশাপাশি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে গড়ে উঠা দুর্নীতিচক্রও কম শক্তিশালী কিংবা কম ধনবান নয়, বরং এনজিও সেক্টরে দুর্নীতিবাজরা আরো অধিক চালাক, দুর্নীতি-প্রকৌশলী এবং সচেতন।

এনজিও সেক্টরের দুর্নীতিবাজরা কাগজপত্র ঠিকঠাক করেই দুর্নীতি চালিয়ে যান। সরকারী পর্যায়ের দুর্নীতির সন্ধানে মিড়িয়া, দুদক, টিআইবিসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ব্য¯ত থাকলেও অজ্ঞাত কারণে এনজিও পর্যায়ে দুর্নীতি সন্ধানী কোন কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠান নেই বললেও চলে। এনজিও পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতির এই ধরণের কিছু আবিস্কৃত পথ এখানে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করা হলো। ১) এফডিআর বাণিজ্য: মাঠ পর্যায়ে ঋণ বিতরণে এমআরএ কর্তৃক নির্ধারিত এফডিআর করার ক্ষেত্রে এনজিও ঈশ্বর সম্প্রদায় ও বেসরকারী ব্যাংকগুলোর সাথে গড়ে উঠছে অলিখিত মাসিক মাসোহারা প্রাপ্তির একটি নিরাপদ ব্যবস্থা। আমরা জানি সঞ্চয় সংগ্রহে বেসরকারী ব্যাংকগুলো নেমেছে এক অসুস্থ প্রতিযোগীতায়।

এই প্রতিযোগিতার সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে একধরণের অসাধু এনজিও কর্মকর্তা। সঞ্চয় সংগ্রহে অতি আগ্রহী বেসরকারী ব্যাংকগুলো কাগজে পত্রে বর্ণিত কমিশনের বাইরেও তাদের বিশেষ ফান্ড থেকে এক বিশেষ রকমের কালো কমিশন দিয়ে দাপ্তরিক এফডিআরকারী প্রতিষ্ঠানদের আকৃস্ট করে থাকে। এনজিও পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমআরএ এর নিয়ম অনুযায়ী মাঠস্থিতির বিপরীতে একটি নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক পরিমাণের অর্থ ব্যাংকে এফডিআর করে রাখতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী বাধ্যবাধকতার এফডিআর করার প্রক্রিয়া নিয়ে ঈশ্বর সম্প্রদায়ের এনজিও কর্মকর্তারা শুরু কেেছ নতুন বাণিজ্য। তারা এফডিআর এর বিনিময়ে টাকার বিনিময়ে বেসরকারী ব্যাংকে চাকুরী প্রদান, মাসিক অবৈধ কমিশন এর উৎস হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন।

এনজিওগুলোর দুর্নীতিগ্রস্থ পরাক্রমশালী কর্মকর্তারা এই এফডিআর প্রক্রিয়ার বিনিময়ে শুরু করেছে অবৈধ উপার্জনের পথ; চাকুরী বাণিজ্য। ঘুষের বিনিময়ে পরিচিত আত্মীয়-স্বজনের চাকুরী মজবুত করতে, আত্মীয়ের প্রাইভেট ব্যাংকে চাকুরী হাতিয়ে নেয়া অথবা টাকার বিনিময়ে চাকুরী দেয়া নানাবিধ দুর্নীতিতে ব্যবহার হচ্ছে-এই এফডিআর প্রক্রিয়া। এফডিআর এর এই খেলা নিরাপদ রাখতে তারা স্ব-স্ব আত্মীয়দের বসিয়ে দিচ্ছেন এনজিওগুলোর সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে। এ যেন একটি অপরাধ নিরাপদ রাখতে পাশাপাশি গড়ে উঠছে আরো অনেক অপরাধ কর্মকান্ড। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন, এমআরএ এই সকল এফডিআরগুলো শুধুমাত্র সরকারী ব্যাংকে করা বাধ্যবাধকতা করে দিলে এই দুর্নীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভবনা রয়েছে।

২) ক্রয়-বিক্রয়ে বাণিজ্য: এনজিও পরিচালিত এফডিআর প্রক্রিয়ায় যে অবৈধ বাণিজ্য গড়ে উঠে তা নির্বিঘেœ এবং নিরাপদ করতে এনজিওগুলোর মধ্যে গড়ে উঠে একটি সুষম সিন্ডিকেট। ধীরে ধীরে সাহসী হয়ে উঠা এই অবৈধ কাজের সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠানে আরো অতিরিক্ত আয়ের উৎস সন্ধান করতে থাকে। তারা সংস্থার ক্রয়-বিক্রয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ শুরু করে। সবচেয়ে জগন্য যে কাজটি তারা শুরু করে তা হলো: সংস্থার নিবেদিত সৎ পুরানো স্টাফদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে হঠিয়ে দিয়ে তৎস্থলে তাদের আত্মীয় স্বজন নিয়োগে উদ্যোগী হয়, যা প্রচলিত অর্থে আমরা আত্মীয়করণ বলে থাকি। প্রকৃতপক্ষে এই দুর্নীতি চক্র এতই সাহসী হয়ে উঠেছে যে, মালিকানা বিহীন জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সকল পদে নিজের ভাই-বোন, বন্ধুর ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন বসিয়ে দেয়, যাতে করে সকল অনিয়ম, কু-কর্মকান্ড নির্বিঘেœ সম্পাদন করা যায়।

স্বজনীকরণ, আত্মীয়করণ কিংবা ভাই-বোনকরণে যেমন তারা নিরাপদ বোধ করেন তেমনি যোগ্য মেধাবীদের সুযোগ বঞ্চিত করে নিেেজদের আত্মীয়-স্বজনদের অবৈধ পন্থায় কর্ম-সংস্থান নিশ্চিত করে। ৩) ডিজিটালাইজেশন বাণিজ্য: এফডিআর নিয়ে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটে ধীরে ধীরে ডালপালা বাড়াতে থাকে সংস্থার অন্যান্য খাতে। ইদানিং ক্ষুদ্রঋণের ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় অধিক ব্যয় দেখিয়ে কিংবা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে অর্থ সরানো হচ্ছে। ৪) স্টাফ করাপশান বাণিজ্য: ক্ষুদ্রঋণের শুরুর দিকে দেখা যেতো দরিদ্র মহিলারা মাঝে মাঝে ঋণ নিয়ে পালাতো কিন্ত্র বর্তমানে দেখা যায় ঋণ গ্রহিতা সদস্যা নয় বরং মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা কিস্ত তুলে লক্ষ লক্ষ টাকা নিযে পালাচ্ছে। এখানেও চলে তুঘলকি কান্ড।

কিস্তি হাতিয়ে নেয়া পলাতক কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে সংস্থার নীতিনীর্ধারক পর্যায়ের কিছু কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রাতের অন্ধকারে পলাতক কর্মীদের সাথে যোগযোগ করে টাকা ভাগাভাগি করে নেয় এবং বিনিময়ে রুজ্জুকৃত মামলা দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের পাশাপাশি এরকম আরো অভিনব হাজার রকমের দুর্নীতিতে ভরে যাচ্ছে জনস্বার্থে গঠিত হওয়া ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো। এনজিও, মাল্টিপারপাস কিংবা বিশেষায়িত ব্যাংক সকল মাইক্রেফিন্যান্স কার্যক্রম একটি নীতিমালায় এনে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আলাদা পরিচালনা পরিষদ গঠন করে, যোগ্য জনবল নিয়োগে যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে প্রত্যেকের স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে এই অনিয়ম থেকে কিছুটা উত্তরণ সম্ভব। যারা এসকল প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাদের চাকুরী বিধিমালা এমনকি সরকারীভাবে প্রণয়নও জরুরী। তাহলে সৎ কর্মীরা চাকুরীর ভয় না করে সৎ সাহসে যথাযথ দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত হবে।

ক্ষুদ্রঋণের মুল শক্তি দরিদ্র নারী কিংবা অনগ্রসর জনগোষ্ঠি এবং ঋণ প্রদান ও ঋণ আদায়ে সফলতার পেছনে জিন্মাদার হিসেবে কাজ করে সমিতি। আমরা জানি প্রতিটি ঋণের নিরাপত্তার জন্য মর্টগেজ বা জিন্মাদার থাকে। তৃণমুল মানুষের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে মর্টগেজ বা জিন্মাদার হিসেবে কাজ করে মুলত: সমিতি। সমিতির ২৫/৩০ জনের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে ঋণ প্রদান করা হয় বলেই ঋণ আদায়ে নির্ভরযোগ্যতা ও সফলতা সম্ভব হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা পরিষদে এই সমিতির নেতৃত্বে থাকা তৃণমুল রমণীদের প্রতিনিধিত্ব রাখা অত্যন্ত ইতিবাচক।

ক্ষুদ্রঋণ কোন গতানুগতিক কার্যক্রম নয়, এজন্য এই কার্যক্রম সূষ্ঠভাবে বাস্তবায়নের জন্য গবেষণা কার্যক্রম প্রয়োজন। এজন্য প্রতিটি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সকল স্তরের কর্মীদের নিযে ছোট ছোট গবেষণা সেলও রাখা যায়, এতে করে ক্ষ্রদ্রঋণের নতুনতুন বাস্তবায়নের দিক উম্মোচিত হবে। সারা বিশ্বে পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য বাংলাদেশে একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা যায়, যা সারা বিশ্বেও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম এবং সামাজিক ব্যবসার মানমন্দির হিসেবে কাজ করতে পারে। যেখানে ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসা বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং উচ্চতর ডিগ্রিও চালু করা যেতে পারে। ---------সৈয়দ মামুনূর রশীদ


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.