আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উতসবের নিরাপত্তার জন্য চাই প্রেম এবং সম্প্রীতি



১ হায় ! অবশেষে সৈন্য দিয়ে ঘিড়িতে হইল মন্দির! সৈন্য দিয়ে কি মন্দির রক্ষা চলে ? কিংবা ধর্ম ? তাই রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকে বড়ই আক্ষেপের সুরে কথাটি বলেছিলেন ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মানিক্য। নাটকটিতে রাজা গোবিন্দ মানিক্যের সঙ্গে একটা মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারই রানী গুনবতী। এ লড়াইয়ে রাজা গোবিন্দ মানিক্যের পক্ষে বলতে তেমন আর কেউই রইল না, অপরদিকে রানী গুনবতীর পক্ষে ছিল, রাজ পুরোহিত, আমত্য, মন্ত্রী পরিষদ সহ কায়েমী শক্তির সকলেই। সে দিক বিবেচনায় রানীর পাল­াই ছিল ভারী। রাজার পক্ষে ছিল প্রেম আর যুক্তির শক্তি, অপরদিকে রানী গুনবতীর পক্ষে ছিল সনাতন কায়েমী শক্তি।

রাজার পক্ষে ছিল সত্য ধর্ম, রানীর পক্ষে ছিল লোক ধর্ম। মন্দিরে জীববলি নিষিদ্ধে রাজার নির্দেশে এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব জোরালো হয়ে উঠে। সেই দ্বন্দ্বের সুতো ধরেই এগোয় নাটকের কাহিনী, শেষে রাজা গোবিন্দ্য মানিক্য তার সৈন্য দিয়ে মন্দির ঘিরে ফেলেই জীববলি নিষেধের নির্দেশ কার্যকর করে। কাহিনী সংক্ষেপ হল, নি:সন্তান রানী গুনবতী মন্দিরে গিয়ে মা কালির কাছে মানত করে। মা যদি তাকে সন্তান দেন তবে সে ’বর্ষে বর্ষে দেবে এক শত মহিষ তিন শত ছাগ’।

একদিন বলির পশু সংগ্রহ করতে এক রাজ অনুচর অর্পনা নামের একজন ভিখারিনী বালিকার ছাগ শিশু জোর করে নিয়ে আসতে থাকে। বালিকা অর্পনাও তার পিছু পিছু কাঁদতে কাঁদতে আসতে থাকে। দৃশ্যটি রাজার নজর এড়ায় না। কারণ জানতে চাইলে অর্পনা জানায়, ভিক্ষা অন্ন ছাগ শিশুর সঙ্গে সে ভাগ করে খায়। কাজেই মহাকালি নয় সে নিজেই ওই ছাগ শিশুটির মাতা।

এমন দান মা কখনোই নেবেন না প্রসন্ন দক্ষিণ হাতে। অর্পনার কথা ভাবিয়ে তোলে রাজাকে। ততক্ষণাত গোবিন্দ মানিক্য দ্ব›দ্ব জাগানিয়া ঘোষণাটি দিয়ে বসে। ’আজ হতে ত্রিপুরায় জীব হইল নিষেধ’। জীব বলি রোধ করতে এক পর্যায়ে সৈন্য দিয়ে মন্দির ঘিরে রাখতে হয় রাজা গোবিন্দ মানিক্যকে।

ঠিক সেই সময়েই রাজা গোবিন্দ মানিক্যেও কণ্ঠে ধ্বনীত হয়েছিল সেই আক্ষেপের সুর। ’হায়, অবশেষে সৈন্য দিয়ে ঘিড়িতে হইল মন্দির’। কেন রাজার এই আক্ষেপ। কারণ রাজা জানতেন সৈন্য দিয়ে মন্দির রক্ষা চলে না। এমন কি ধর্ম রক্ষাও নয়।

তিনি বুঝেছিলেন, ধর্ম রক্ষা করতে হয় প্রেম দিয়ে, ভক্তি দিয়ে। মানুষের আচরণ আর সংস্কৃতি দিয়ে। এ কথাটি শুধু ধর্ম কিংবা উপাসনালয়ের ক্ষেত্রেই নয়, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে সমান খাটে। রাজা গোবিন্দ মানিক্য বুঝি এটাই বুঝেছিলেন, সৈন্য দিয়ে ধর্ম রক্ষা করলে সেখানে ধর্মের মর্মটি থাকে না, থাকে তার খোলসটাই। মানুষের প্রেম ভক্তির বিপরীতে সৈন্য দিয়েই যদি মন্দির রক্ষা করতে হলে সেখানে আর ঈশ্বর থাকে না।

এক অর্থে সেই মন্দিরে ঈশ্বরের আরাধনাই বৃথা। ২. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুনাম এদেশে বহুদিনের। এখনো সেই ধারাটি সমাজের মূলধারা। শত উস্কানিতেও তাকে পরাস্থ করা সম্ভব হয়নি। উদ্ভট সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে আমরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি।

একটি গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক সমতা ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠই ছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল কথা। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ৪ দশক পরে সেখান থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে বাংলাদেশ। সেই সম্প্রীতির উজ্জ্বলতাকে অনেকখানি ম্লান করতে সক্ষম হয়েছে যারা সম্প্রীতি চায় না। এই চার দশকের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল সামরিক শাসন। সাম্প্রদায়িকতাকে আবর্জনার ভাগার থেকে টেনে তুলে এনেছে সামরিক শাসন।

স্বাধীনতা পরবর্তী শাসকদের সীমাহীন লুটপাট, অপশাসন আর অযোগ্যতা সাম্প্রদায়িকতার গোড়ায় জল ঢেলে দিয়েছে। মানুষের সস্তা সাম্প্রদায়িক আবেগকে উস্কিয়ে দেয়ার কাজ করেছে তারা। আবাহমান বাঙলার সেই চিরায়ত বৈশিষ্টের গায়ে লাগানো হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার কালিমা। মানুষকে টেনে আনা হয়েছে অন্ধকারের দিকে। কী রাজনীতি কী সংস্কৃতি সবখানেই তার বিষক্ত নি:শ্বাসের শব্দ শোনা যায়।

এখন পুজোর নিরাপত্তা বিধানে র‌্যাব পুলিশের দরকার হয়। সংখ্যলঘু ধর্মালম্বিদের উৎসব পার্বনের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বে সঙ্গে দেখতে হয় খোদ রাষ্টকেই। কিন্তু এমনতো আগে কখনো ছিল না। এমনকি সেই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কালপর্বেও ছিল না। তখন সকল ধর্মের উতসব পার্বনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হত মানুষের সহিষ্ণু সংস্কৃতির পরিমন্ডলে।

তখন ধর্ম রক্ষা হত পুলিশ দিয়ে নয়, ভক্তি দিয়ে, প্রেম দিয়ে। সেই সঙ্গে অপর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দিয়ে। ধর্ম যার যার, উতসব সবার- এই কথাটি তখন ষোল আনাই কার্যকর ছিল। ৩. আর কয়দিন পরেই ঈদ এবং পুজো। বাংলাদেশের প্রধান দুই ধর্মীয় সম্প্রদয়ের প্রধান দুই উতসব।

শত সংকট সমস্যা কাধে নিয়েও উতসব আনন্দে মেতে উঠেছে দেশ। মানুষ ছুটছে প্রিয়জনের কাছে, স্বজনের মুখ না দেখে কি উতসবের সুখ মেলে। ট্রেনে বাসে ভীড়। প্রতিবছর ঈদের ছুটিতে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষই ছুটত নাড়ীর টানে, এবছর ঈদ ও পুজো পাশাপাশি থাকায় উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ছুটছে প্রিয়জনের কাছে। দুই উৎসবে একাকার বাংলাদেশ।

এক ঘেয়েমী কাজের ক্লান্তি দুরে থাক, যান্ত্রিক নগর জঞ্জাল পেছনে পড়ে থাক। এবার জীবনে জীবন মেলাবে মানুষ। উতসবে আনন্দে আবার নিজেদের মেলে ধরবে বাঙালী। ৩ বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে অসম্প্রদায়িকতা বার বার পরাস্থ হয়েছে। এখানে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করেছে যুগের পর যুগ ধরে।

এবারের ঈদ ও পুজো আরো একবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির মেলবন্ধনের সুযোগ করে দিল। পুরো জাতি আবারো প্রমান করবে, তারা শান্তি চায়, সাম্প্রদয়িক ভেদবুদ্ধির কাছে পরাজিত হতে চায় না। এক সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে বাঙালী উতসব আনন্দে মিলবে মেলাবে। লড়াই শুরু হয়ে যাক শেকড়ে ফেরার। আয়নার সামনে দাঁড়াক বাঙালী।

চিনুক নিজেকে, চিনুক আপন সমৃদ্ধ সংস্কৃতির মহিমাকে। পরাজিতদের মাথা হেট হয়ে যাক, অসাম্প্রদায়িক বাঙালীর মাথা উচু হতে হতে হিমালয় ছাড়িয়ে আরো উচুতে উঠুক। ###

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।