অক্টোবরের ২৫ তারিখ শেষ হল। বাংলাদেশের জনগণের উৎকন্ঠার শেষ হয়নি। বাংলাদেশের চলমান সংকটের সমাধান দুই নেত্রীর সংলাপের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করে অনেকে। রাজনৈতিক মহলে বিষয়টি আলোচিত হলেও রয়েছে এর বিভিন্ন মত। রাজনৈতিক সংকটের দুই মেরু- হাসিনা-খালেদা প্রতীয়মান হলেও সংকট সমাধানে দুই নেত্রীর ভূমিকার চেয়ে কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বা রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো।
বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার ভূমিকা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য । মজিনার ভারতীয় হাই কমিশনার পঙ্কজ সরন, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও সরকারের সাথে বৈঠক ও ভারত সফর দেশের মধ্যে গুঞ্জন সৃষ্টি করে। সফরকালে তিনি ভারতের সরকার, সিভিল সোসাইটি ও ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করেন। দেশে এসেও তিনি ব্যস্ত গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিক এবং সরকার ও বিরোধীদের সাথে বৈঠকে। হাসিনা-খালেদার ব্যস্ততার চেয়ে মজিনার ব্যস্ততা কোন অংশেই কম নয় বরং তার চাপেই উভয় নেত্রী সংলাপ নাটকে ব্যস্ত।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কূটনীতিকদের ভূমিকার বিষয়টি অনেকে পজিটিভলি দেখে থাকেন। বাংলাদেশের রাজনীতির স্বার্থসংস্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ (স্টেকহোল্ডারস) রাজনীতির নিয়ামক হিসেবে কাজ করে আসছেন। কূটনীতিকদের নামকরণ করা হয়েছে উন্নয়ন অংশীদার, একসময়ে তাদের বলা হতো দাতাগোষ্ঠী। এই তথাকথিত উন্নয়ন অংশীদাররা আসন্ন নির্বাচন তথা বাংলাদেশের রাজনীতির এক অনুঘটক যা সকলের কাছেই স্পষ্ট। শুধু তাই নয় বিরোধী দল ও সরকারী দল প্রতিনিয়ত গৃহীত পদক্ষেপগুলো তাদের অবহিত করে আসছে।
কূটনীতিকরা দিচ্ছে বিভিন্ন ফর্মূলা, নির্দেশনা, কখনও ব্যক্ত করছে বিভিন্ন আশাবাদ, যে অনুযায়ী চলছেন হাসিনা-খালেদা। এই উন্নয়ন অংশীদাররা তাদের পছন্দমতো সরকার বাংলাদেশে দেখতে চায়। কিন্তু তাদের মধ্যে রয়েছে কিছু বিষয়ে ভিন্ন মত। তাই নেতৃত্বের ভূমিকায় আসীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা সকলকে তাদের পছন্দের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টায় লিপ্ত। হাসিনা, মার্কিনীদের দেয়া ফর্মূলা অনুযায়ী জঙ্গীবাদ তথা রাজনৈতিক ইসলাম দমনে চেষ্টা করে এসেছেন এতদিন, মার্কিন স্বার্থরক্ষায় কোন কিছু দিতেই বাদ রাখেননি তিনি।
কিন্তু হাসিনা সরকারের সীমাহীন দূর্নীতি, লুটপাট, দলীয়করণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনায় হাসিনা সরকারের জনসমর্থন তার বিপক্ষে চলে যায়, যে জন্য মার্কিনীরা হাসিনার বিকল্প ভাবতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে খালেদার জঙ্গিবাদ দমনের ফমূর্লা মার্কিনীদের সমর্থন যোগাতে সমর্থ হয়েছে, কিন্তু বাধ সেধেছে ভারত। কিন্তু ভারতও মার্কিনীদের কৌশলগত অংশীদার। ভারতের সমর্থন বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মজিনা, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশের ভবিষ্যত সরকারের ভূমিকা ও মার্কিনীদের প্রত্যাশার বিষয়টি নিয়ে ভারত সফর করে এসেছেন।
ভারতের সমর্থন পেলে মার্কিনীদের পুতুল সরকার হিসেবে খালেদার ক্ষমতা গ্রহণের কোন পথই বাকি থাকবেনা।
পুতুল সরকারের ধারণাটি এসেছে ঔপনিবেশিক যুগ শেষ হওয়ার পরপরই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেই মূলত ঔপনিবেশিক শাসনের পট পরিবর্তনের যুগ হিসেবে ধরা হয়। এর পূর্বে পৃথিবীতে জোর যার মুল্লুক তার তথা ঔপনিবেশিক শক্তিরাই চষে বেড়াত। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা ও ওশেনিয়ার বিভিন্ন দেশ প্রধানত বৃটিশ, ফ্রান্স, জার্মানী, স্পেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন ছিল।
এশিয়ায় বৃটিশদের আধিপত্য ছিল। ইউরোপে ছিল বৃটিশ, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য। আফ্রিকায় ফ্রান্স, বৃটিশ, আমেরিকায় বৃটিশ ও স্পেনের আধিপত্য এবং ওশেনিয়ায় মূলত বৃটিশদের আধিপত্য ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও হয়েছিল এই ঔপনিবেশিক দেশসমূহের সা¤্রাজ্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। যাকে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদ নামে নামকরণ করা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লীগ অব নেশনস তৈরি হয় ১৯১৯ সালে যা ১৯৪১ সালে জাতিসংঘ নামে অভিহিত হয়। এর পর পৃথিবীতে সরাসরি উপনিবেশ তৈরি করা জটিল হয়ে পড়ে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে উঠে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে নব্য উপনিবেশবাদের জন্ম দেয়। বিভিন্ন দেশে মার্কিনীদের দালাল শাসক নিয়োগ ও তাদের সব রকমের সমর্থন দিয়ে আসছে মার্কিনীরা। যেসব জায়গায় বৃটিশ ও ফ্রান্স বা জার্মানির আধিপত্য ছিল সেসব জায়গাতে তারা কূটনৈতিক চালের মাধ্যমে, কোথাও মিলিটারি ক্যূ এর মাধ্যমে কোথাও সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নিজস্ব সরকার বাস্তবায়ন করেছে।
চলে আসছে নব্য উপনিবেশবাদের শাসন।
বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠীও ঔপনিবেশিক শক্তির পুতুল সরকারের ভূমিকায় আসীন। শেখ মুজিব ছিলেন ভারত অনুরাগী বৃটিশ পন্থী, সিআইএর মদদপুষ্ট মিলিটারি ক্যূ এর মাধ্যমে মুজিবের পতন হয় ও মার্কিন পন্থী জিয়াউর রহমানের শাসন শুরু হয়। এরপর এরশাদের শাসন তথা বৃটিশপন্থী ভারতের বন্ধু ক্ষমতায় চড়ে বসে। তার পতনের পর গণতান্ত্রিক শাসনে কখনও মার্কিন পন্থী কখনও বৃটিশ পন্থীরা ক্ষমতায় আসে।
বিগত নির্বাচনে বৃটিশ পন্থী হাসিনা, ভারত ও মার্কিনীদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় আসেন। মার্কিনীদের স্বার্থ বড় করে দেখাতে হাসিনা তার পাঁচ বছর শাসনকালে বৃটিশ ভারতের চাপের মধ্যে ছিলেন। অবশ্য ভারতকে খুশি করতে পিলখানা হত্যাকান্ডের মাধ্যমে ভারত বিরোধী অফিসারদের সরিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি হাসিনা। এবার সময় এসেছে জাতীয় নির্বাচনের। দুই নেত্রীই তাদের প্রভুদের খুশি করতে মরিয়া।
রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত, যেকোন সময় নতুন ফর্মূলা আসতে পারে মজিনার কাছ থেকে। সেই ফর্মূলা যদি খালেদার সাথে সাথে হাসিনা মেনে না নেন, তাহলে ছড়িয়ে পড়তে পারে সহিংসতা, যে সহিংসতা মিলিটারির মাধ্যমে প্রশমন করে পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদার জোটকে ক্ষমতা নিয়ে আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও তার কৌশলগত অংশীদাররা। অন্যদিকে ভারত যদি মার্কিনীদের সাথে রাজি না হয়, তাহলে দেশটি নির্লজ্জভাবে হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাবে; যার কারনে হাসিনা বিরোধী জোটকে স্টিম রোলার দিয়ে দমন করার প্রয়াস পাবেন। একতরফা নির্বাচন হয়ে যাবে ও হাসিনা নতুন সরকারের শপথ নিবেন। সেক্ষেত্রে মার্কিনীরা একতরফা নির্বাচনে সমর্থন দেবেনা বলে সহিংসতা বাড়তে থাকবে।
বিরোধী জোট শক্তিশালী ও ঘাতক সরকারের সাথে সংগ্রাম করে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে তা দেখার বিষয়। তবে অস্থিতিশীলতার মধ্যে মার্কিনীরা যাতে ক্যূ করার সুযোগ না পায় সেক্ষেত্রেও হাসিনা সজাগ, সেনা বাহিনীকে সাজানো হয়েছে সেভাবে। দেশ হয় অস্থিতিশীলতার মধ্যে প্রবেশ করবে অথবা এখানে মার্কিন নেতৃত্বে ক্যূ এর মাধ্যমে আবারো মার্কিনীদের পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যা মূলত নব্য উপনিবেশবাদ। অর্থাৎ দেশ দখল না করেও দখলে রাখার কৌশল। মার্কিনীরা পৃথিবীতে এই কৌশলেই আধিপত্য ধরে রাখছে।
মার্কিনীরা যদি বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের কাছে মাথা নত করে, তাহলে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে মার্কিনীদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাবে; যাতে করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন মার্কিন নীতি বাস্তবায়নে কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরবর্তী সরকার যে মার্কিন মদদপুষ্ট খালেদার জোট তা সহজে অনুমান করা যায়। তবে আসন্ন সেই সরকারের ক্ষমতা গ্রহনের পথ খুবই কন্টকাকীর্ণ হবে। যে পথে প্রাণ হারতে পারে দেশের বহু জনগণ।
এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের নির্বাচন জটিলতার সমাধান নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়।
এতে করে নেতৃত্ব পরিবর্তন হয় মাত্র। মার্কিনীদের আধিপত্য তথা দেশের শাসনব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয়না। নব্য উপনিবেশবাদ ও মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী নীতি পরিহার করতে না পারলে আজ দেশের সংকট কাটলেও জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবেনা। হাসিনা-খালেদা ও তাদের নতজানু নীতি ও মার্কিনীদের দেয়া গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই সমস্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু। দেশের জনগণ যদি সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু বুঝতে না পারে, এই সমস্যা পাঁচ বছর পর আবারও একই রূপে আপতিত হবে, মার্কিনীরা আবারো হস্তক্ষেপ করবে সংকট নিরসনে।
জনগণ থাকবে নিরব দর্শকের মতো, নির্বাচন নাটক মঞ্চায়িত হবে। যা কিছু পাওয়ার তা পাবে হাসিনা-খালেদা। জনগন নাটক দেখে মজা নিয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরবে ও পাঁচ বছর কষ্টের মধ্যে কালাতিপাত করে যাবে নাটকের পরবর্তী পর্বের জন্য।
সূত্র: সংগৃহীত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।