আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রেদওয়ান রনির "চোরাবালি" (বাংলা সিনেমাকে চোরাবালি থেকে টেনে তুললো যে ছবি)

কল্পিত চোখে বাস্তবতা দেখি, কম্পিত কলমে স্তব্ধতা লেখি হলে এন্ট্রি আমরা তিন বন্ধু ঢাবি ক্যাম্পাস থেকে হাটতে হাটতেই চলে এসেছিলাম বলাকা সিনেমা হলের দিকে। বলাকাতে বলে কয়ে চলছে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত বাঙলা ছবি চোরাবালি। ১২টা ৪৫-এ শো শুরু হয়েছে, তখন বাজে একটা। টিকিট কেটে হলে ঢুকতে গেলেই এগিয়ে এলো হলের এক কর্মী। টিকিট চেক করে তিনি হলের দরজা খুললেন, বড় পর্দায় দেখলাম সিনেমার ভিলেন ওসমান(শহীদুজ্জামান সেলিম) রক্ষিতা কাম মডেল সুজানাকে (পিয়া) সাথে নিয়ে কাম মিটিয়ে বিছানায় শূয়ে আছেন।

হলের দরজা খুলতেই বিশাল পর্দায় বিছানা যেভাবে হাজির হলো তাতে মনে হলো, সিনেমা হলে নয়, তিন বন্ধু টিকিট কেটে সুর সুর করে ঢুকে পড়ছি অন্যের বেডরুমে। হলে পর্দার সামান্য আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই, আশেপাশে বসে থাকা দর্শকদের সাথে অন্ধকারও বেশ জেকে বসেছে। হল কর্মী একটি টর্চ লাইট জ্বেলে আমাদের পথ দেখিয়ে সিট বুঝিয়ে দিলো (যেন কোন গ্রামের চৌকিদার রাতে পথ হারানো পথিকদের পথ দেখালো)। শেষের দিকে একদম চিপায় তিনটে সিট,সিটগুলোও আমাদের দেখে খুশী হলো না। ঐ জায়গায় তারা সম্ভবত কোন প্রেমিক জুটিকে আশা করছিল।

চিপায় যেতে হবে বেশ কিছু মানুষকে ডিঙ্গিয়ে। আমার দুই বন্ধু চলে গিয়েছে,আমি প্রথম পদক্ষেপ দিতেই এক নারীকন্ঠের চিতকার শুনলাম। ঝট করে তাকালাম পর্দার দিকে, সেলিম কি এমন করে বসলো যে সুজানা ওরকম চিতকার দিলো। তাকিয়ে দেখি সেলিম আর সুজানা চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে,আসলে যা করার আমিই করেছি। অন্ধকারে মাড়িয়ে দিয়েছি এক নারী দর্শকের পা,সেই চিল্লাচ্ছে।

তার পা-এর উপর থেকে আমার পা সরিয়ে নিয়ে নতুন পদক্ষেপ দিতেই শুনি নতুন আরেক নারীকন্ঠ অন্ধকারে কোকাতে কোকাতে বলছে ‘দেখে শুনে পা ফেলতে পারেন না?”আমি আবিস্কার করি, আমার পায়ের নিচে কোন জমিন নেই, অন্ধাকারে অন্য কারো পায়ের উপর দু পা রেখে দাঁড়িয়ে আছি। পা রাখার জন্য দ্রুত জমিন খুজতে শুরু করলাম, আর তা করতে গিয়ে আরো কয়েকজনকে মাড়িয়ে দিলাম। আইটেম বিভ্রান্তি সিটে বসতেই পর্দায় তাকিয়ে দেখি সুজানা একাকী রুমে নিজের পেটে হাত বোলাচ্ছে। বোঝা গেলো, ওসমান সাহেব ডাটা এন্ট্রি যা দেবার দিয়ে দিয়েছেন, এখন ঐসব ডাটা সুজানার পেটে প্রসেসিং হচ্ছে। হাত বোলানো শেষ হতে না হতেই কোমর ঝাপিয়ে শুরু হল আইটেম গান “দে ভিজিয়ে দে”।

আমি ভেবেছিলাম আইটেম গার্লটা বুঝি সুজানাই, মা হবার আনন্দে পেট-ফেট উমুক্ত করে সেলিম আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের সামনে খুল্লাম-খুল্লা নাচ শুরু করেছে। দর্শকদের প্রথম দিকে বেশ মৌজ দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু আইটেম গার্লের বারবার নাচের একই অঙ্গভঙ্গি ‘দে ভিজিয়ে দে’ গানটাকে খুব শীঘ্রই শুকনো খটখটে করে দিলো। এতো ভাল একটা ছবিতে এইরূপ গাএর কোন দরকার ছিলো বলে মনে হয় না। নাচ শেষে সেলিম সুজানার রুমে ঢুকে মদের নেশায় চুর হয়ে ‘দে, আমায় ভিজিয়ে দে’ বলেই ভিজে যাবার আগে বিছানায় চিতপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে তখন আমার ভুল ভাঙ্গে, আইটেম গার্ল আর সুজানা আসলে ভিন্ন দুটি আইটেম।

পিতা নিয়ে ফিতা টানাটানি ঘুম ভাংতেই সেলিমকে সুজানা তার ডাটা প্রসেসিং-এর কথা জানায়, সঙ্গে বলে দেয় সেলিম যেহেতু ইনপুট দিয়েই দিয়েছে,তাই সে আউটপুট চায় (মা হইতে চায় আরকি)। সেলিমও ভিলেনরূপী কণ্ঠে গালি-গালাজ জানিয়ে দেয় ঐসব ডাটা ফাটা সুজানাকে ডিলিট (এবোরশন) করে দিতে হবে। সুজানা যোগাযোগ রাখতো সাংবাদিক নবনী আফরোজ (জয়া)-এর সাথে। নবনীকে ডেকে সেলিমের কুকীর্তি ফাস করে দেয় সে, সেলিমকে ফোন করে তুই-তোকারি করে বলেও দেয় তাকে দিয়ে যথেষ্ট কাম মেটানো হয়েছে এখন সে ওসমানের কাম (কাজ) ফাস করে দিয়েছে। কপালে মরণ থুক্কু স্ক্রীপ্টে মরণ থাকলে যা হয় ।

সুজানাকে খুন করার কাম (অকাজ) পায় সুমন (ছবির নায়ক ইন্দ্রনীল)। পিতা নিয়ে ফিতা টানাটানির এইসব ঘটনা চলাকালীন সময়ে যতবার সেলিমকে তার ডেরায় দেখানো হয়েছে, ততবারই তার সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে একজনকে দেখা গিয়েছে খরগোশ হাতে। খরগোশের ওপর ননস্টপ হাত বোলাতে দেখে মনে হয় সে নিজেই ঐ খরগোশের পিতা। ওদিকে ছবির প্রযোজক সালেহীন স্বপন হাজির হয় ডাক্তারের চরিত্র নিয়ে, সে সুজানার প্রেমিক, সুজানার বাচ্চার বাবার পরিচয়ের দায় সে নিতে ইচ্ছুক। সুজানাকে সে গিফট দিয়ে যায় এক গাদা বাচ্চাদের জুতো।

স্বপন চলে গেলে সুজানা যখন এক গাদা বাচ্চাদের জুতোর ভেতরে আনন্দে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো তখন দরজা দিয়ে সুমন এসে সুজানাকে গুলি করে দিয়ে যায় (খুনী যাতে ঢুকতে পারে সেজন্য ফ্ল্যাটের দরজা পরিচালক খুলে রেখেছিলো)। সুজানাকে মেরে সুমন বুঝতে পারে তার গডফাদারের রক্ষিতা প্রেগন্যান্ট ছিলো। তখন তার মনে পড়ে নিজের মায়ের কাহিনী। পিচ্চি সুমন থেকে কিলার সুমন সুমনের বয়স যখন ১২-১৩ তখন তার মা দ্বীতিয় সন্তানের জন্য প্রেগনেন্ট হয়। কিন্তু গ্রামের চেয়ারম্যান জিল্লু খা প্রশ্ন তোলে যেহেতু সুমনের বাবা আগেই মারা গিয়েছে সেহেতু সুমনের মায়ের নতুন করে মা হওয়া মানে সে নষ্টা মেয়ে মানুষ।

গ্রাম্য সালিশে সুমনের মাকে দোররা মেরে মেরে মেরেই ফেলা হয়। প্রতিশোধের নেশায় সুমন সুযোগ বুঝে জিল্লু খা-কে খুন করে পালিয়ে ঢাকা চলে আসে। ফিরে আসি সুমনের বড় কালে। নারী চরিত্রগুলো যখন একের পর এক প্রেগন্যান্ট হচ্ছিলো তখন পুরুষ চরিত্রগুলো একের পর এক খুন হতে লাগলো। সোহেল রানা এমপি নির্বাচনে সেলিমের প্রতিদ্বন্দী,সেলিম সুমনকে দিয়ে তাকে খুন করায় ।

সোহেল রানার ভাতিজা ইরেশ যাকেরকেও erase করে দেয়া হয়। তার খুনের দৃশ্যটা ছিলো ভয়াবহ, ইরেশ যাকেরের গলা দু-ফাক হয়ে যেতে দেখে হল ভর্তি লোকজনের চিতকার শুনে মনে হলো হলের ভেতরেই কারো কল্লা পড়ে গিয়েছে। সবচেয়ে উপভোগ্য ছিলো পিচ্চি সুমনের দ্বিতিয় খুনের ঘটনা। পিচ্চি সুমন ঢাকার এক উঠতি সন্ত্রাসীর জন্য চা বানিয়ে আনলে সেই সন্ত্রাসী চায়ের নামে ঘোড়ার মূত বানাবার জন্য সুমনকে মারধোর আর গালাগালি করে। রাগে ফুসতে ফুসতে পিচ্চি সুমন তুলে নেয় তলোয়ারের মতো দেখতে এক বিশাল ধারালো অস্ত্র।

আর ঐ ব্যাটা তামাশা করে বলতে শুরু করে “তুই আমাকে মারবি?আয়,মার”। , হলের প্রত্যেক দর্শকের হাতেও যেন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে একটা করে তরবারী। তারাও ফুসতে-ফুসতে ফুসতে থাকা সুমনকে বলছে “মার মার”। শেষমেষ হলের সবাইকে সাথে নিয়ে সুমন ঐ ব্যাটাকে কুপিয়ে মারে। পিচ্চি সুমনকে আশ্রয় দেয় গডফাদার ওসমান (সেলিম)।

তারপর প্রশ্রয় দিয়ে বড় করে সুমনকে একজন পেশাদার খুনী বানিয়ে তোলা হয়। এরপর সাশ্রয় রেটে তাকে দিয়ে কীভাবে খুন করানো হয় তা আগেই বলেছি। সাংবাদিক নবনী আফরোজ ওসমানের কুকীর্তি নিয়ে রিপোর্ট করে। ওসমান আবার সুমনের ঘন্টা বাজিয়ে বলে নবনীর কলিংবেল বাজিয়ে দিতে। কিন্তু সুমন ততক্ষানে অনেকক্ষন ধরে চালিয়ে রাখা ল্যাপটপ যার ব্যাটারী শেষ।

প্রেগন্যান্ট সুজানাকে মেরে নিজের মায়ের স্মৃতিতে দগ্ধ সুমন ওসমানকে একটু-আধটু অস্বীকৃতি জানিয়েও আবার খুন করতে রাজি হয়ে যায়। এবং তারপর ইন্টারমিশন। চিপ্স এবং বিরিয়ানি খুন খারাপি দেখতে দেখতে ব্যাপক ক্ষিধে লেগে গিয়েছে। ক্ষিধেকে খুন করতে কিছু কিনে আনতে সিট ছেড়ে উঠলাম। ঢোকার সময় অন্ধকারে কাদের মাড়িয়ে এসেছি জানতে উজ্জ্বল আলোতে সারির সর্ব ডানে উকি দিলাম।

একজন আমাকে বের হতে দেখেই ওড়না দিয়ে তার মুখ ঢেকে ফেললো। সে হয়তো ভেবেছে যাবার সময় তার পা মাড়িয়েছি আর এবার তার মুখ মাড়িয়ে যাবো। তার পাশের মেয়েটিও যখন আমাকে বের হবার জায়গা দিতে নিজের দুই পা পুরোপুরি সিটের উপরে তুলে নিলো,বুঝলাম আমি তাকেও মাড়িয়েছিলাম। একটা পুটুলির ভেতর ১৫ টাকার চিপ্স নিয়ে আবার সিনেমা দেখতে বসলাম। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক অসাধারণ, কিন্তু এই সময় হলসুদ্ধ লোক আমার মতোই চিপ্স খেতে থাকায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাপিয়ে সবার মুখে কচকচ-মচমচ করে চিপ্স খাবার শব্দ শোনা যেতে লাগলো।

কচকচ মচমচ শব্দের ভেতরেই নবনীকে দিনে দুপুরে সবার আগোচরে তার ফ্ল্যাট থেকে অজ্ঞান করে কোলে তুলে সুমন উঠিয়ে নিয়ে যায়। (সুজানার খুনের সময় পরিচালক দরজা খুলে রেখেছিলেন আর এবার নবনীর বিল্ডিং-এর সবার ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন!!) হাত-পা বাধা অবস্থায় চলন্ত গাড়ির পেছনের সিটে জ্ঞান ফিরে নবনী বুড়ির (আদর করে বললাম)। সে শুনতে পারে ড্রাইভিং সিট থেকে সুমন ওসমানকে ফোনে বলছে সে নবনীর লাশ বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়েছে। ব্যাস্ত রাস্তায় নবনীর কোথায় চিতকার চেচামিচি শুরু করে দেবার কথা, সে উলটা গাড়ির পেছনের সিটে আরাম করে গা-এলিয়ে বসে সুমনকে প্রশ্ন করে “আমাকে কি না মেরে দূরে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের মনোবাসনা পূরন করতে”??? জঙ্গলের ভেতর এক পূরনো বাড়িতে নিয়ে এসে নবনীকে বেধে রাখা হয়। কিছুক্ষন পর সুমন হাজির হয় তিন প্যাকেট বিরিয়ানি নিয়ে।

নায়কের হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট দেখে হল ভর্তি দর্শকের সেকি আনন্দ ধ্বনি। তারা ধরেই নিয়েছে নায়ক নায়িকা দুই প্যাকেট খেয়ে বাকি এক প্যাকেট হলভর্তি দর্শককে বিলিয়ে দিবে। কিন্তু তিন নম্বর প্যাকেটের একটা দানাও হলের কেউ পায় না। তাহলে কই যাবে তিন নম্বর প্যাকেট?এখানেই পরিচালকের ছোট্ট একটা চমক আছে। হলে গিয়েই দেখবেন।

টুইস্ট নবনীর বাধন খুলে দিতেই সুমন নবনী প্রেমের বাধনে আটকা পড়ে। সুমন সব খুলে বলে নবনীকে,নবনী উপদেশ দেয় রাজসাক্ষী হয়ে ওসমানের সব ফাস করে দিতে। রাতের প্রেম শেষ করে সকালে গেম খেলতে সুমন যায় ওসমানের ডেরায়। সেখানে হয় ধুন্ধুমার ফাইট। নায়কের ফ্লাইং কিকের সাথে পা মিলিয়ে লাথি চালালো নায়িকাও।

নায়িকার লাথির মোলায়েম পরশ ছড়িয়ে গেলো হলের দর্শকদের মাঝেও। তারপর নায়ক-নায়িকার পলায়ন। নায়িকাকে শহরের উচু দালানে রেখে এসে নায়ক আবার ব্যাক করে ওসমানকে খুন করতে। রাতের বেলা হঠাত ঘুম ভাংতেই ওসমান দেখে সুমন তার দিকে পিস্তল তাক করে বসে আছে। দূর্যোধন ভাই-এর ব্লগে আগেই পড়েছিলাম এখানে নাকি টুইস্ট আছে।

দেখছি আর ভাবছি কি টুইস্ট হতে পারে, ওসমানের আবেগী কথায় সব ভুলে গিয়ে সুমন হাত মেলাবে ওসমানের সাথে নাকি ওসমান ছলা-কলায় সুমনকেও মেরে ফেলবে?? কোনটি হলো না, যেটা হলো সেটার আশা অন্তত কেউই করবে না। যান,হলে গিয়ে জেনে আসুন। চোরাবালী দেখে বাঙলা সিনেমাকে টেনে তুলুন চোরাবালি থেকে। লেখালিখি ভালো লাগলে আমাদের পেইজে লাইক দিতে পারেন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।