আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিপ্লব

দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে এ শিল্প। রাজধানীর ধোলাইখালের মোটর পার্টস ও মেশিনারিজ শিল্প, কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা বহুমুখী শিল্পাঞ্চল ছাড়াও অনেক স্থানেই চোখের আড়ালে গড়ে উঠছে একেকটি যুগান্তকারী শিল্প কারখানা। মেধা আর মননের সম্মিলিত দক্ষতায় গড়ে উঠছে জনবল। ঢাকার বাইরে বগুড়া, যশোর, পাবনায় গড়ে উঠছে ক্ষুদ্র মেশিনারিজ শিল্পের বিশাল পল্লী।

গাজীপুর ও সাভারের বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে পোল্ট্রি ও পোল্ট্রি ফিড কেন্দ্রিক নানা শিল্প কারখানা। বুড়িগঙ্গার তীর জুড়ে রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট ছাড়াও তৈরি পোশাকের আলাদা শিল্প গুরুত্ব পাচ্ছে সর্বত্র। পঞ্চগড়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও আধাদক্ষ শ্রমবলেই বিস্তার ঘটছে চা শিল্পের। কুষ্টিয়ার অজপাড়াগাঁয়ে গড়ে উঠেছে চাল শিল্পের আরেক দুনিয়া। চার সহস্রাধিক চাতাল ও চাল কল কুষ্টিয়ার খাজানগরকে আমূল বদলে দিয়েছে।

সারা দেশে স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে তোলা ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের শিল্প কারখানা রয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি (বাইশিমাস) সূত্রে জানা যায়, দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের হালকা প্রকৌশল শিল্পে প্রতি বছরে টার্নওভার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় আড়াইশ কোটি টাকারও বেশি। এসব শিল্প কারখানার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৩৫ লাখ কর্মীসহ দেড় কোটি মানুষের জীবনজীবিকা ও ভাগ্য।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে সরকারি সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয় নিয়মিত।

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাঝে মধ্যেই দেশীয় কারিগররা অভাবনীয় নানা মেশিনারিজ তৈরির দক্ষতা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। অতিসম্প্রতি কলেজ পড়ুয়া এক তরুণ ব্যতিক্রমী উড়োজাহাজ তৈরি করে এখন আকাশে উড্ডয়নের অপেক্ষায় রয়েছেন। ফরিদপুরে আরেক তরুণ সড়ক ও নদীতে সমানভাবে চলতে সক্ষম এমন একটি উভচর গাড়ি বানিয়েছেন। কিন্তু সে গাড়ি শিল্পটির বিকাশ ঘটানোর মতো কোনো উপায় পাচ্ছেন না তিনি। সরকারের কোনো সংস্থা এমনকি ধনাঢ্য কোনো ব্যক্তিও তার পাশে দাঁড়াননি।

আরেক তরুণ মোবাইল ফোন আর সিসি ক্যামেরার সমন্বয়ে বানিয়েছেন অত্যাধুনিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। বাড়ির আশপাশে ওই যন্ত্র বসিয়ে পৃথিবীর যেখানেই থাকুন, আপনার কাছে প্রতি মুহূর্তের ভিডিও ফুটেজ চলে যাবে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মেধাবী তরুণরা সরকারের কোনোরকম সহায়তা পাচ্ছে না।

কৃষি যন্ত্রপাতি, মোটরসাইকেল যানবাহনের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি ও বিপণনের ক্ষেত্রে বগুড়ার পাশাপাশি যশোরের নামটিও ব্যাপকভাবে পরিচিত। মোটরসাইকেলের সব ধরনের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির ক্ষেত্রে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যশোরের সিয়াম মোটরসের মালিক মানিক।

আর এন রোডে তার কারখানায় তৈরি করা মোটর যন্ত্রাংশগুলো চীনের পণ্যের চেয়েও কম মূল্যে তিনি সারা দেশে সরবরাহ করতে সক্ষম। কিন্তু মানিক পুঁজির অভাবে এ শিল্পের সুফল দেশের সর্বত্র পেঁৗছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তিনি পুঁজি জোগাতে পারেননি। মানিক জানান, সব ক্ষেত্রে এমন বৈরী পরিস্থিতির কারণে অনেক উদ্যোক্তা সফল হচ্ছেন না। অনেকে আবার পুঁজি সংকটে কারখানা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা ও মাঝারি শিল্পের কারিগররা এভাবেই নিত্য নতুন জিনিসপত্র আবিষ্কার করে চলছেন। সীমিত পুঁজির খুদে শিল্প মালিক আর অভাবনীয় মেধার দক্ষ কারিগররা মিলে হালকা ও মাঝারি শিল্পকে পরিণত করেছেন দেশের সম্ভাবনার আলোকবর্তিকায়। শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া এই শিল্পকে সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে সরকারি সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রীর কোনো নির্দেশই আলোর মুখ দেখেনি। বরং নানামুখী সমস্যা আর পুঁজি সংকটে এরই মধ্যে অনেক সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু হয়েছে।

দেশের ৯৬ শতাংশ শিল্পই ক্ষুদ্র ও মাঝারি। জিডিপির শতকরা ১২ ভাগ আসে শিল্প থেকে, এর গুরুত্বপূর্ণ অংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান। কৃষি খাতের বাইরের খাতগুলোর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থানই হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। দেশের ৩৫ লাখেরও বেশি শ্রমিক এ খাতে জড়িত। বিপুলসংখ্যক তরুণ, যুবার কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ডিপ্লোমা প্রযুক্তি শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিলের মহাসচিব মো. আবুল হাসান জানান, সরকারের 'দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে' ক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং রপ্তানি শিল্পের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপসহ নিবিড় কর্মসংস্থানভিত্তিক শিল্পায়নের কথা বলা হয়েছে। সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়ন নীতিকৌশল প্রণয়ন করেছে। বেসরকারি খাতকে সহায়তা দেওয়া এবং শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে বিরাজমান বৈষম্য দূর করা, সবার জন্য সমান্তরাল ক্ষেত্র নিশ্চিত করে বিনিয়োগবান্ধব ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টিরও চেষ্টা চলছে। কিন্তু প্রযুক্তি সংযোজন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ছিটকে পড়েন। ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল গবেষণায় দেখতে পায়, স্বাধীনতার পর কোনো শিল্পেই পণ্য ভিত্তিক ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে ৮৬ হাজার ৪১২টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে ৭২ হাজার ৩০০টি রুগ্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, বাকি চার হাজার ১১২টি ধুঁকে ধুঁকে বন্ধ হওয়ার মুখ। আবুল হাসান আরও জানান, বাংলাদেশে দুই কোটি যুবক পূর্ণ বেকার এবং দেড় কোটি যুব অর্ধ বেকার জীবন কাটাচ্ছে। ব্লেড, পেনসিল, কলম, তালা, ছাতা, মোবাইল, চশমা, চকলেট, বিস্কুট, ইলেকট্রিক ফ্যানের মতো নিম্ন প্রযুক্তিগত দ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। শিল্প স্থাপনে সরকারি সহায়তা পাওয়া গেলে এ পরিস্থিতি পাল্টে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

পঞ্চগড় জেলায় তিন হাজার ৫০০ একর জমিতে বছরে প্রায় ১২ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হচ্ছে।

প্রতিবছর এর পরিমাণ বাড়ছে। এ জেলায় চা উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী জড়িত। চা চাষের মাধ্যমে ওই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা আমূল বদলে গেছে। দেশে গত এক দশকে আসবাবশিল্পে বিপ্লব ঘটে গেছে। বিশাল বহুতল শোরুমে এক ছাদের নিচেই পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের আসবাব।

কাঠ, লেমিনেটেড বোর্ড, মেলামাইন বোর্ড, এমডিএফ দিয়ে দেশেই তৈরি হচ্ছে এসব আসবাব। গত এক দশকে কাঠের দাম বেড়েছে অনেক। কাজেই, কাঠের বিকল্প উপকরণেও খুব দ্রুত মানিয়ে নিয়েছেন কারিগররা। তবে দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে চরম দুর্দিন চলছে। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এই শিল্প।

বিসিক নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ ছাড়া ব্যাংক ও বিসিকের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় ব্যাংক বিনিয়োগেও উৎসাহী নয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ অঞ্চলে প্রায় ১৫ হাজার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হালকা প্রকৌশল, সমিল, বেকারি, কাঠজাত, ইট, বাঁশ-বেত ও মৃৎ শিল্প। এই শিল্পগুলোর ৯০ শতাংশই রুগ্ন বা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় কোনো রকমে টিকে আছে।

জানা গেছে, পুঁজি সংকটের কারণেই এ শিল্পগুলো বন্ধ হওয়ার পথে।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.