আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“আমার চিতার আগুন হয়ো সুকুমার”

অর্থ নয়, কীর্তি নয়...আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে “আমার চিতার আগুন হয়ো সুকুমার” কবীর সুমনের একটি গানে এই কথাটি শুনে অবাক হয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম, সুমনকে সুকুমারের সন্তান বলা হয়। পাগলা দাশু সহ সুকুমার রায়ের গদ্যসাহিত্যের সঙ্গে ছোটবেলায় আমার পরিচয় ঘটেছিল এবং তখন থেকেই তিনি আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছেন। সুমনের গানটিতে সুকুমারের ছন্দ, অনুপ্রাস, ব্যঞ্জনা এইসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছিল। সুমন আমার গানের জগতের একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছেন।

গানটি শোনার পর সুকুমার রায় সম্পর্কে, বিশেষ করে তাঁর পদ্য নিয়ে আবার নতুন করে আগ্রহ জন্মায়। ছোটবেলার সুকুমারকে বড়বেলায় নতুন করে আবিষ্কার করতে গিয়ে দেখি তিনি বাংলা সাহিত্যে এমন এক জগতের সন্ধান করেছেন যার দ্বিতীয় কোন নজির হয় না। সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে। পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়, যাঁর নানামুখী প্রতিভা গান, চিত্রকর্ম আর মুদ্রণ শিল্পে উদ্ভাসিত। মাতা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এর কন্যা।

সুকুমার রায় ছিলেন ছয় ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় বোন সুখলতার পরেই সুকুমার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস থেকে এই দুই ভাইবোনের নাম রাখা হয়েছিল তাতা ও হাসি। শিক্ষাজীবন শেষ করেই সুকুমার ‘ননসেন্স ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ক্লাবের নামকরণের মধ্যেই সুকুমার সাহিত্যের মূল ধারার ভবিষ্যত প্রবাহরেখা ফুটে উঠেছিল।

এফএনএফ নিয়ে গঠিত এই ক্লাবের জন্য লেখা দু’টি নাটক- ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ এবং ক্লাবের পত্রিকা ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’র পাতায় সুকুমারের হাস্যরসের প্রথম আভাস পাওয়া গেলেও হাস্যরসের যে বিশেষ অভিব্যক্তিতে সুকুমার অদ্বিতীয়, তার ইঙ্গিত আসতে তখনো দেরি। রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানে ডাবল অনার্স নিয়ে বিএসসি পাস করার পাঁচ বছর পর ১৯১১ সালে সুকুমার মুদ্রণশিল্পে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। পরের বছর রবীন্দ্রনাথে ঠাকুরও ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের একটি পাণ্ডুলিপিসহ লন্ডন যান। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের সমবয়সী ও বন্ধুস্থানীয়; আর সুকুমার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের তরুণ ভক্তদের অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভার সঙ্গে ইংল্যান্ডের সুধীসমাজ তখনো পরিচিত হয়নি।

সুকুমার এসময় ‘দ্যা স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি স্বরচিত প্রবন্ধ ‘কোয়েস্ট সোসাইটি’র একটি অধিবেশনে পাঠে করে এই পরিচয়ের পথ কিছুটা সহজ করে দিয়েছিলেন। ১৯১৩ সালের মে মাসে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পাদনায় ‘সন্দেশ’ মাসিক পত্রিকার আবির্ভাব হয়। এর কয়েক মাস পরেই সুকুমার দেশে ফিরে ‘সন্দেশ’ এর পাতা লেখা ও ছবিতে ভরে তোলেন। এই সময়েই সুকুমারের সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য সুনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে যাত্রা শুরু করে। পিতার মৃত্যুর পর ‘সন্দেশ’ এর ভার সুকুমারের ওপর পড়লে শুশুসাহিত্যে তিনি আরো ঝুঁকে পড়েন।

এই শুভযাত্রা বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন সংযোজন ঘটায় যাকে আমরা ‘ননসেন্স’ বলে চিনি। সুকুমার ‘ননসেন্স’ এর এই বিশেষ রসটিকে ‘খেয়াল রস’ নাম দিয়েছিলেন। লক্ষ করার মত বিষয় হল এই যে এই রস ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রে উল্লেখিত নবরসের বাইরের একটি নবতর উচ্চারণ। বিদেশি সাহিত্য থেকে নিছক ‘ননসেন্স’ এর আমদানিই সুকুমারের কীর্তির সবটুকু নয়। সুকুমারের আগে লুইস ক্যারল ও এডওয়ার্ড লিয়ার তাঁদের ননসেন্স দুনিয়ার বাসিন্দা হিসেবে কিছু আজগুবি জানোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন।

ক্যারলের বিখ্যাত কবিতা ‘জ্যাবারওয়াকি’র ‘ব্রিলিগ’ বা ‘বোরোগোভ’এ সুকুমার মেজাজের কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। তবে সুকুমার আপন ভঙ্গিটি চিনে নিয়েছেন একান্তই নিজের মত করে। ‘জ্যাবারওয়াকি’র প্রাণীগুলি এমনই এক কল্পনার জগতে বাস করে যে তাদের কার্যকলাপের বর্ণনা দিতে আনকোরা শব্দ ব্যবহার করতে হয়। লিয়ারও কিছু আজগুবি প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ডং, জাম্বলি, পবল, কাঙ্গল-ওয়াঙ্গল এদের কাউকেই লিয়ার আমাদের চেনা-জানা জগতের খুব কাছে আসতে দেন নি।

এদের জগত প্রায় রূপকথারই জগত। ওদিকে হুঁকোমুখো’র বাস কিন্তু বাংলাদেশে। ঠিক তেমনি ট্যাঁশগরুকে অনায়াসে দেখা যায় হারুদের অফিসে, কিম্ভূত কেঁদে মরে মাঠপারে ঘাটপারে, কুমড়োপটাসও নিশ্চয়ই শহরের আশে-পাশেই ঘোরাফেরা করে, নইলে তার সম্বন্ধে আমাদের এতটা সতর্ক হবার প্রয়োজন হত না। একমাত্র রামগড়ুরই সংগত কারণেই নিরিবিলি পরিবেশ বেছে নিয়েছে; কিন্তু সেও রূপকথার রাজ্যে নয়। অবশ্য এদের জগতটা ঠিক বাস্তব জগতও নয়।

এটি আসলে সুকুমারের একান্ত নিজস্ব একটি জগত, এবং সত্যজিৎ রায়ের ভাষায়- এই জগতের সৃষ্টিই হল সাহিত্যিক সুকুমারের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। সুকুমারের রসবোধের একটি নমুনা পাওয়া যায় একটি নিমন্ত্রণপত্রে। উপেন্দ্রকিশোর এর মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠা হয় মানডে ক্লাব, যাকে সুকুমার মজা করে মণ্ডা সম্মেলন বলতেন। সত্যেন্দ্রনাথ দও, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অতুলপ্রসাদ সেন সহ তখনকার অনেক সুপ্রসিদ্ধ মুখ ক্লাবটির সদস্য ছিলেন। ক্লাবের আলোচনাচক্রে প্লেটো-নিটশে থেকে শুরু করে বঙ্কিম-বিবেকানন্দ কিছুই বাদ পড়ত না।

এছাড়া হত গান বাজনা ভোজ পিকনিক আড্ডা আমোদ। ক্লাবের বিজ্ঞপ্তি ছাপা হত সুকুমারের প্রেসে, তার ভাষাও ছিল সুকুমারের। ক্লাব সম্পাদকের অনুপস্থিতিতে একবার সভ্যদের কাছে ছাপা পোস্টকার্ড গেল- সম্পাদক বেয়াকুব কোথা যে দিয়েছে ডুব এদিকেতে হায় হায় ক্লাবটি যে যায় যায় তাই বলি সোমবারে মদগৃহে গড়পারে দিলে সবে পদধূলি ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি। রকমারি পুঁথি যত নিজ নিজ রুচিমত আনিবেন সাথে সবে কিছু কিছু পাঠ হবে। -করজোড়ে বার বার নিবেদিছে সুকুমার।

সুকুমার রায়ের কোন রচনাই তাঁর জীবদ্দশায় পূর্ণাঙ্গ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি। ‘আবোল তাবোল’ ১৯২৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় সুকুমারের মৃত্যুর নয় দিন পর। ছাপা বই দেখে না গেলেও তার তিনরঙা মলাট, অঙ্গসজ্জা, পাদকরূপে দু’চার লাইনের কিছু ছড়া, টেলপিসের ছবি ইত্যাদি সবই তিনি করে গিয়েছিলেন শয্যাশায়ী অবস্থায়। এবং ভাবতে অবাক লাগে সুকুমারের শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর বেশিরভাগই তাঁর শয্যাশায়ী অবস্থায় সৃষ্ট। তাঁর শেষ রচনা ছিল ‘আবোল তাবোল’ এর শেষ কবিতা ‘আবোল তাবোল’, যার বিচিত্র মিশ্র রস বাংলা সাহিত্যে চিরকালের বিস্ময় হয়ে আছে।

এটি রচনার সময় যে তাঁর উপর মৃত্যুর ছায়া পড়েছিল তার ইঙ্গিত এর কয়কটি ছত্রে আছে। আজকে দাদা যাবার আগে বলব যা মোর চিত্তে লাগে- নাইবা তাহার অর্থ হোক নাইবা বুঝুক বেবাক লোক। আপনাকে আজ আপন হতে ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে ... আলোয় ঢাকা অন্ধকার, ঘণ্টা বাজে গন্ধে তার। গোপন প্রাণে স্বপন দূত, মঞ্চে নাচেন পঞ্চভূত! ... আদিম কালের চাঁদিম হিম তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম। ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘুমের ঘোর, গানের পালা সাঙ্গ মোর।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণটিতে দাঁড়িয়ে নিজের নিশ্চিত ভবিতব্যকে এমন রসিকতার ছলে সাহিত্যের উপাদান করে তুলতে পারেন যে সাহিত্যরসিক, তাঁর উদ্দেশ্যেই বলা যায়- “আমার চিতার আগুন হয়ো সুকুমার” [তথ্যসূত্রঃ সত্যজিৎ রায় ও পার্থ বসু সম্পাদিত ‘সুকুমার সাহিত্যসমগ্র’ এর ভূমিকা] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।