আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবাঞ্ছিতজন এবং চতুর সময়ের গল্প

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

গুদামে চালের বস্তা দুইটা শর্ট পড়েছে দেখে শান্ত থাকবার প্রাণপণ যেই প্রতিজ্ঞা করেছিলো হাশেম মিয়া সেটা আর রাখতে পারলোনা । চিৎকার করে বলে উঠলো “ আবারো হারামজাদা পুলায় চালের বস্তা সরাইছে । ওরে কি ক্ষতি করছিলাম আমি তোরে রাস্তা থেইকা তুইলা আইনা আমার কাছে জায়গা দিয়া ? হারামীর পুলা তোর বাপ – মায়ে তোরে কিয়ের লাইগা পয়দা করছিলো ? অহন বুঝতেছি পয়দা কইরা তোরে রাস্তায় ফালাইয়া গেছিলো কেন । আয় এইখানে আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন ।

“ ক্রমাগত গজগজ করতে লাগলো হাশেম মিয়া । বাসা থেকে এসেছেই মেজাজ খারাপ করে । তারপর দোকানে এসে দেখে এই কাহিনী । যাকে উদ্দেশ্য করে এতো গালাগাল সেই ভবেনের অত মাথাব্যাথা ছিলোনা । মিনিট দশেক দূরত্বের এক জায়গায় সমবয়সীদের সাথে নিবিষ্ট মনে মার্বেল খেলায় ব্যস্ত ছিলো ।

বয়স খুব বেশী ধরলেও তেরোর বেশী হবেনা । মার্বেল খেলায় জিতে অবশেষে যখন দোকানে আসলো মালিকের থমথমে মুখ দেখে বুঝতে পারলো ঘটনা কি । সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেললো । তাতেও শেষ রক্ষা হলোনা । নতুনোদ্যমে হাশেম মিয়া মুখ খুলতে আরম্ভ করলো , “ আইছে নবাবের পুলায় ।

শুনি আইছোস কোত্থেইকা ? আমারে ফতুর কইরা দিয়া চেহারা দেখাইতে আহোস প্রতিদিন ? শুয়োরের বাচ্চা আইজকা জবাব দিবি দুই বস্তা চাইল কই সরাইছোস । “ অপর প্রান্ত থেকে কথা আসেনা । নিরুত্তর থাকে । হাশেম মিয়া আরো বেশী ক্ষিপ্ত হয় । কোনদিন যা করেনি তাই করতে আরম্ভ করলো ।

ভবেনের ঘাড় ধরে দুমদাম বসাতে শুরু করলো । ঘাড় , গলা , বুক , পীঠে দুমদাম কিল , ঘুষি পড়তে লাগলো মিনিট পাঁচেক যাবত । ভবেন দাঁড়িয়ে ছিলো চুপচাপ । কোন প্রকারের বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলোনা । অতঃপর দেখা গেলো ভবেনের পরনের গেঞ্জি ছেঁড়া , চুল অবিন্যস্ত হয়ে নেমে এসেছে প্রায় চোখ বরাবর ।

ডান হাতের কবজির নিচে ছিলে একটু রক্ত বেরোচ্ছে । তারপর ভবেনকে সোজা বেরিয়ে যেতে বললো । এর আগেও এমন কান্ড কয়েকবার করেছে ভবেন । আজকেরটার এমন প্রতিক্রিয়া হবে বুঝতে পারেনি । আপাতত এই জায়গা থেকে সরে যাওয়াটাই শ্রেয়তর ভেবে নীরবে চলে যেতে থাকলো ।

রাস্তার লোকজন হা করে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই নাটকের মঞ্চস্থ হওয়া দেখছিলো । নাটকের তড়িৎ সমাপ্তিতে হতাশ হয়ে তারা পুনরায় নিজেদের কাজে মনোযোগ দেওয়া আরম্ভ করলো । হাশেম মিয়া এবার পড়লো বিপাকে । দোকানের কিছু আনুষাঙ্গিক কাজও এখন থেকে তাকেই দেখতে হবে । অথচ মেয়ের বিয়ের জন্য প্রায়ই তাকে দোকান ছেড়ে বাসায় যেতে হবে ।

একবার ভাবলেন ভবেনটাকে ডেকে আনেন । পরমুহূর্তেই ভাবলেন দরকার নেই । প্রেস্টিজ তো যাবেই সাথে সেই ব্যাটার মনে হবে হাশেম মিয়ার তাকে ছাড়া চলবেনা । কয়েকদিন বাইরে গিয়ে চরে খাক । পেটে আগুন জ্বলতে শুরু করলে সিধা হয়েই ফিরবে ।

রাতটা কোনভাবে ফুটপাথের নিচে পার করে দিতে চেয়েছিলো ভবেন । ভেবেছিলো আজ রাতটা পার করে দিতে পারলেই আগামীকাল একটা গন্তব্য বানিয়ে ফেলবে । চিন্তাও করে রেখেছিলো তার আসন্ন সাকিন সম্পর্কে । বাধ সাধলো ফুটপাথে পুলিশের আচমকা রেইড । মাঝেমাঝে হারামজাদার দলের এই ক্যারা উঠে ।

নেশাখোর , গাঁজাখোর , ফুটপাথের উদ্বাস্তু মানুষ এদের কাছ থেকে তোলা আদায় করে নিতে শালার যখন তখন ফুটপাথ রেইড দেয় । তেমনই এক কেইসে ফেসে গেলো ভবেন । ঘন্টা দেড়েক হবে ঘুমোচ্ছিলো ফুটপাথের এক কোনায় জায়গা করে নিয়ে । এমন সময়ে এসে পুলিশ উঠালো । সারা শরীরের দিকে চেয়ে থেকে বললো , “ ওই হারামজাদা তুই কোত্থেকে এসে জুটেছিস রে ? তোকে তো আগে দেখিনাই এই তল্লাটে ।

কোথাকার মাল তুই শুনি ? “ ভবেন কোন উত্তর দেয়না । চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে । ভালো করেই জানে বিশেষ কোন কাজ হবেনা । পুলিশ তাকে জ্বালিয়ে মারবেই । এই বেয়াড়াপনা পুলিশের অসহ্য ঠেকে ।

পশ্চাৎদেশে গোটা তিনেক কষে লাথি দেওয়ার পর ভবেনের ঘাড় ধরে আরো ৪ জন সহ তাকে লক আপে তুলে দেয় । মিথ্যা ফেনসিডিল ব্যবসার কেইসে ফাঁসিয়ে দেবে ভবেনকে সেটাও লক আপেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় । ভবেন দিশা খুঁজে পায়না । বাড়ার কি এক সমস্যায় পড়ে গেলো । ভ্যানেই একটু চোখ বুঁজে এসেছিলো ।

গাল বরাবর বিরাশি সিক্কার এক চড় খেয়ে সম্বিত ফিরলো । “ হারামজাদার শখ দেখো , ভ্যানের মধ্যেও ঘুমায় নবাবের পোলা । “ আসন্ন বিপদের মধ্যেও একটু আনন্দের ক্ষণ মেলে ভবেনের । তার প্রিয় হাশেম চাচার কথা মনে হয় । সেও রেগে গেলে এভাবেই গালাগাল করতো ।

পরের মুহূর্তেই আবার মুখ তেতো হয়ে আসে ভবেনের । কোথায় তার হাশেম চাচা আর কোথায় এই বাঞ্চোতগুলা । হাজতের উদ্দেশ্যে লক আপ ভ্যান চলতে থাকে । “ তা আপনি দোকান বেঁচবেন না এইটাই আপনার শেষ কথা ? ভেবে বলতেছেন তো ? “ এমপি সোলায়মান তেলতেলে মুখে হাত বুলাতে বুলাতে হাশেম মিয়াকে প্রশ্ন করে । “ না , কইলাম তো আমার দোকান বেচুম না ।

আপনে পাঁচ লাখের কথা কইছেন । পনেরো লাখ দিলেও বেচুম না । বিশ বছর ধইরা এই দোকান চালাইয়া আইছি । আমার মাইয়াডা এই তো সেদিন আমার চক্ষের সামনে জন্মাইলো । আমি সেই দিন দোকান থেইকা ছুইডা গেছিলাম ।

মাইয়ার পোয়াতি মায়ে ঘরে আছিলো একলা । আমি নিজে তারে নিয়া ছুইটা গেছিলাম করিমনের মায়ের কাছে । “ ক্রমাগত গলার পারদ উঁচুতে উঠতে থাকলে এবারে এমপি সোলায়মান এবারে গলা খাঁকারি দেয় । লোকজনের সামনে এইসব বেয়াদবি মাফ করা যায়না । এমপি মানুষের সেরকম একটা ওজন রেখে চলা লাগে ।

কন্ঠস্বর ভারী করে পুনরায় হাশেম মিয়াকে প্রশ্ন করে , “ তাইলে এটাই তোমার শেষ কথা , ঠিক না হাশেম মিয়া ? “ “ এইডাই আমার শেষ কথা । দোকান বেচুম না । “ ঘাড় গোঁজ করে হাশেম মিয়া উত্তর দেয় । “ ঠিক আছে যাও । পাঁচ লাখেও রাজি হইলানা ।

আমি বারো লাখ পর্যন্ত দিতে রাজি ছিলাম । যাই হোক এতো বছর ধইরা দোকানটা সামলাইলা । সামনের সময়ে আরো ভালো করে চালানোর চেষ্টা কইরো । দিনকাল খারাপ বোঝইতো । আল্লাহ ভরসা ।

“ হাশেম মিয়া কথাগুলা গিলে নেয় । মনে মনে তিন – চারটা কুৎসিত গালি দিয়েও গায়ের জ্বালা জুড়ায়না তার । কিন্তু বাসায় ফিরে আসলে একরাশ চিন্তা নতুন করে মাথায় প্রবেশ করে । দোকানটা রক্ষা করতে পারবেতো ? দোকানে বসে হিসাবপত্তর ঠিকঠাক মিলিয়ে দেখছিলো ঠিক এমন সময়েই তীক্ষ্ণ চিৎকার হাশেম মিয়ার কানে ভেসে আসলো । বদরুল ছুটতে ছুটতে এসে খবর জানালো তার মেয়েকে সারা বাড়িতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা ।

হাশেম মিয়া নিমেষেই বুঝলো কার কাজ তবু এখন মাথা গরম করা চলবেনা । বদরুলকে দোকানে রেখে চটজলদি বাড়ি ছুটলো । আগে সেখানকার পরিবেশ শান্ত করতে হবে । অভিজ্ঞতায় বোঝে এমন সময়ে মাথা ঠান্ডা রাখবার বিকল্প নাই । হাশেম মিয়া হিসাবপত্তর মেলানো আর শেষ করে উঠতে পারলোনা ।

পরে বাড়ীর অবস্থা কোনমতে ঠান্ডা করে দোকানে এসে যেই দৃশ্য দেখলো তা মোটামুটি এরকমঃ আগুনে ততক্ষণে তার দোকানের একাংশ পুড়ে ছাই । বাকি অংশ পুড়তে শুরু করেছে । এমপির পোষা গুণ্ডা রগ কাটা খালেকের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে দাঁতের সবকয়টা পাটি বার করে হাসছে বদরুল । ঘরের মধ্যেই এমন শত্রু পুষে রেখেছিলো ভেবে নিজের উপরেই ক্রোধান্বিত হতে পারতো হাশেম মিয়া । কিন্তু সে দোকানের যেখানে চালের বস্তা থাকে সেদিকে পাগলের মতো ছুটে গেলো ।

জায়গাটা তখনও পুড়তে আরম্ভ করেনি । কিন্তু বস্তাগুলোর ভেতরে ভবেন আটকা পড়ে গেছে । গতরাতে হাজত থেকে ছাড়া পেয়ে সকালে রওনা দিয়েছিলো এই পাড়ায় । এসেই বসে গিয়েছিলো দোকানটায় । এদিকে আগুন ক্রমশ ধেয়ে আসছে ভবেনের দিকে ।

হাশেম মিয়া ছুটছে চালের বস্তাগুলোর দিকে । বস্তাগুলো কোনমতে সরিয়ে ভবেনকে বের করে আনার সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়লো চালের বস্তার দিকে । যৌথ কন্ঠের আর্তচিৎকার শুনলো সবাই । নিজ জায়গা থেকে কেউই নড়লোনা ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.