আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উৎসবমুখর ‘নৈরাজ্য’

রাজপথে মিছিল আর স্লোগানে মুখর আওয়ামী লীগ। সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে নারী-শিশু-বৃদ্ধ ও রোগীদের অসহনীয় কষ্টের কথা তাদের বিবেচনাতেই নেই। সরকারি দলের এমন উৎসব দেখে ক্ষুব্ধ, বিস্মিত নগরবাসী বলছেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নামে এটা একধরনের ‘নৈরাজ্য’।
পল্টনে তীব্র যানজটে দুই ঘণ্টা আটকে থাকা একজন নারী কর্মজীবী ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘একদিকে বিরোধী দলের হরতাল-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, অন্যদিকে সরকারি দলের পথ আটকে মিছিল ও মহড়া। মাঝখানে আমরা অসহায়।

আমাদের কষ্টের কথা কাকে বলব? আমরা কার কাছে যাব?’
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই মনোনয়নপত্র বিক্রি ও জমা নেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। চলছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের শক্তি প্রদর্শন। হাতি, ঘোড়া ও ট্রাক নিয়ে মিছিল আর মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে রাজপথে মিছিল করছে ক্ষমতাসীন দল। সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার একের পর এক মিছিল যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। বিকেলে আবার ফেরার সময়ও একই অবস্থা।

এর ফলে তীব্র যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানীর জনজীবন। মিছিলের পথ সুগম করতে গিয়ে যাত্রীবোঝাই গাড়িগুলোকে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। হরতালের কারণে গতকাল শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অনেক অফিস খোলা ছিল। ফলে চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। আজ রোববারও মনোনয়নপত্র বিক্রি ও গ্রহণ করা হবে।

সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি যে আরও কয়েক গুণ বাড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আওয়ামী লীগ কার্যালয় যখন উৎসবমুখর, নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় তখন নেতা-কর্মীশূন্য। বাইরে পুলিশের পাহারা। গ্রেপ্তারের ভয়ে আত্মগোপনে আছেন নেতা-কর্মীরা।

‘মানুষ তো কষ্ট পাচ্ছে, আপনারা কেন পথ আটকে এভাবে মহড়া দিচ্ছেন?’ জবাবে ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মাঈনুল হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনোনয়ন কিনতে যখন গিয়েছিলাম তখন হরতাল ছিল।

ফলে মানুষের ভোগান্তি বুঝতে পারিনি। আজ (শনিবার) মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে বুঝলাম, আমাদের এভাবে যাওয়া ঠিক হয়নি। ’

রাজনৈতিক দলের এমন আচরণের কারণে মানুষ আর কত কষ্ট ভোগ করবে? নির্বাচন কমিশনেরও কি কিছুই করার নেই?

নির্বাচন কমিশন বলছে, তফসিল ঘোষণার আগের সময়টি ‘নির্বাচনকালীন সময়’ নয়। তাই কমিশনের কিছু করার নেই। নির্বাচন কমিশনার মো. জাবেদ আলীর মন্তব্য, রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে তাদের দলের মনোনয়নপত্র বিলি করবে, তা তাদের বিষয়।

তফসিল ঘোষণার পর কোনো রাজনৈতিক দল যদি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে, তখন তা কমিশন দেখবে।

যোগাযোগ করা হলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আগের নির্বাচনপদ্ধতি আর এখনকার নির্বাচনপদ্ধতি এক নয়। আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিনই ছিল ‘নির্বাচনপূর্ব সময়’। কিন্তু এখন যাঁরা ক্ষমতায়, তাঁরা পূর্ববর্তী ৯০ দিনকে ‘নির্বাচনকালীন সময়’ হিসেবে মানছেন না। কমিশনও বলছে, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন সময়।

সরকার আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে রাজপথে শক্তি দেখাচ্ছে।

নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র কেনা বা জমা দেওয়ার সময় হাতি-ঘোড়া নিয়ে মিছিল করা বা মোটরসাইকেল মহড়া দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া বা কেনার সময় সর্বোচ্চ পাঁচজন যেতে পারেন।

আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনী আইনে মনোনয়নপত্র বিতরণে কোনো বাধা নেই; বরং তৃণমূল থেকে প্রার্থী মনোনয়নের মাধ্যমে প্রতিটি আসনে একজন প্রার্থী চূড়ান্ত করার বাধ্যবাধকতা আছে।

আওয়ামী লীগ মনোনয়নপত্র বিতরণের মাধ্যমে দলের সব পর্যায়ের নেতাদের নির্বাচনে আসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০(বি)(৪)-এ বলা হয়েছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কেন্দ্র থেকে মনোনয়নপত্র দিচ্ছে। এতে তৃণমূলের মতামত কীভাবে নেওয়া হবে, সে সম্পর্কে দলটি কিছু বলছে না।

তবে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে কেন্দ্রে পাঠানো প্রার্থী প্যানেল থেকে দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড একজনকে মনোনয়ন দেবে।

দিনভর মিছিল, ভোগান্তি: বেলা দেড়টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এ সময় প্রেসক্লাবের সামনে এসে জড়ো হতে থাকেন টঙ্গী থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আজমত উল্লাহর কর্মী-সমর্থকেরা। এর কিছু সময় পর হাইকোর্টের সামনে কদম ফোয়ারা মোড় হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল রাজধানীর রূপনগর-পল্লবী থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ইলিয়াস মোল্লাহর কর্মীদের বিশাল মিছিল। ইলিয়াস মোল্লাহর দাবি, তাঁর সঙ্গে ৩০-৩৫ হাজার কর্মী-সমর্থক এসেছিলেন। আর বিপরীত দিক থেকে মনোনয়ন কিনে ফিরছিলেন যুবলীগের নেতা মইনুল হোসেনের কর্মী-সমর্থকেরা।

একই সময় সেগুনবাগিচা এলাকায় জড়ো হচ্ছিলেন সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মনোনয়নপ্রত্যাশী হাবিবে মিল্লাতের কয়েক শ নেতা-কর্মী।

মিল্লাতের সমর্থক মিথুন হোসেন জানান, তাঁরা ১৫টি বাসে চড়ে সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছেন। এর বাইরে অনেকে নিজস্ব গাড়ি করে, কেউ কেউ ট্রেনে চেপেও এসেছেন।

মৎস্য ভবনের সামনে বাসে বসে ছিলেন হামিদুর রহমান। তিনি শেওড়াপাড়া থেকে গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছিলেন।

জানালেন, মৎস্য ভবন সিগন্যালে তিনি আটকে ছিলেন ঘণ্টা খানেক। এর আগে বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজারে আটকে থাকতে হয়েছে। শেওড়াপাড়া থেকে এ পর্যন্ত আসতে বাসে তাঁর সময় লেগেছে দুই ঘণ্টার বেশি।

ঢাকা-১৬ আসনে মনোনয়ন কিনেছেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন। বেলা দেড়টার সময় মিরপুর এলাকা থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উদ্দেশে অর্ধশতাধিক পিকআপ ভ্যান, কয়েক শ মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হন।

একই সময়ে ঢাকা-১৫ আসন থেকে মনোনয়ন কিনতে যান স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী মেজবাউর রহমান। অপরদিকে ঢাকা-১৫ আসনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া শেষে মিরপুর এলাকায় ফিরতে থাকেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মাঈনুল হোসেন খান। খাগড়াছড়ি থেকে নেতা-কর্মীদের নিয়ে মনোনয়নপত্র কিনতে আসেন সমীর দত্ত চাকমা। ফলে পুরো ফার্মগেট, রোকেয়া সরণি, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০ এলাকায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সব ধরনের যানবাহন। মিছিলে মাইক-ঢোল-তবলা আর স্লোগানের আওয়াজে ঢাকা শহরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

আগারগাঁও এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা রাকিব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি-বিরোধী সব দলই জনগণকে কষ্ট দিতেই ভালোবাসে। দেশের কথা তারা চিন্তা করে না। বিরোধী দল হরতাল দিয়ে দুর্ভোগ তৈরি করে। আর সরকারি দল মিছিল করে রাস্তা বন্ধ করে। বিরোধী দলের মতো সরকারি দলও যদি মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?

জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের একজন সদস্য বলেন, ‘সকাল থেকেই যানজট শুরু হয়েছে।

মনোনয়নপত্র কিনতে নেতারা আসছেন, সঙ্গে একগাদা সাঙ্গপাঙ্গ। এদের জন্য যানজট নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতা, তাই কিছু বলাও যায় না। ’

স্থানীয় লোকজন জানান, পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকা থেকে চারটি ঘোড়ার গাড়ি, কয়েকটি পিকআপ ভ্যানভর্তি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা-৭ আসনের জন্য মনোনয়নপত্র কিনতে গেছেন লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজি কামাল উদ্দিন। ওই বহরের জন্য এক ঘণ্টারও বেশি সময় সড়ক আটকা ছিল।

দুপুরে মনোনয়নপত্র নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় আবার একই অবস্থা।

বেলা তিনটায় নগর ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, গোটা সড়ক যানবাহনে স্থবির। বাসে ও রিকশায় বসা যাত্রীরা চড়া রোদে হাঁসফাঁস করছেন। এরই মধ্যে পাশাপাশি দুটি পিকআপ ভ্যানের ওপর বসানো সাউন্ড সিস্টেম থেকে হিন্দি গানের তালে উচ্চ শব্দে গান বাজছে, সঙ্গে একদল যুবকের নৃত্য।

রিকশাচালক মো. আলম বলেন, ‘এরা নাকি আমলীগের নেতা।

কোনো দিন নামও শুনি নাই। হাতি-ঘোড়া নিয়া নমিনেশন কিনতে আইছে। ’

হাইকোর্ট মাজার থেকে কলেজ রোড ধরে বঙ্গবাজার, নগর ভবন থেকে গোলাপ শাহ মাজার হয়ে নবাবপুর রোড, ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড, স্টেডিয়াম-সংলগ্ন এলাকা প্রায় সারা দিন অসহনীয় যানজটে স্থবির হয়ে থাকে। নগরের অন্য এলাকার তুলনায় পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ ছিল অনেক বেশি। বাসে মতিঝিল বা গুলিস্তান থেকে পল্টন পার হতেই এক ঘণ্টার বেশি লেগেছে।

বিএনপির কার্যালয় ফাঁকা: বেলা তিনটার দিকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়ের প্রবেশ ফটকে ভেতর থেকে তালা দেওয়া। কার্যালয়ের সামনে কোনো নেতা-কর্মী নেই। সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন পুলিশের সদস্যরা। গেটের কাছেই বসে আছেন গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকজন সদস্য। কার্যালয়ের নিচে একটি প্রিজন ভ্যান, একটি এপিসি, একটি ওয়াটার ক্যানন ও গোয়েন্দা পুলিশের একটি মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছে।

কার্যালয়ের ভেতরে কয়েকজন কর্মচারীকে দেখা যায়। আর আছেন যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। জানতে চাইলে রিজভী বলেন, পুলিশ নেতা-কর্মীদের কাউকে কার্যালয়ে ঢুকতে দিচ্ছে না। গ্রেপ্তারের হুমকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী উৎসব করছেন।

এটি কৃত্রিম উৎসব।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.