আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিস্মৃতি

সন্ধ্যার আঁধারে আমি যদি হারিয়ে যাই বন্ধু, আমাকে মনে রেখো তোমার ঘরের ধূপ-আগরের সুবাসে- তোমার ঘরের প্রদীপের আলোয়, আমাকে ফেলে দিও না বাসি ফুলের মত। মনের ঘরেই রেখো বন্ধু পথের ধারের ফুলটি ভেবে। আমি যে জলসাঘরে ...www.jolsaghor.com আমার এখন মনে হয়, তার সাথে দেখা হওয়া একেবারে দৈবাধীন ছিল! উত্তরের হাওয়া দক্ষিণ সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে গান করছিল। জলডুবা ঘাসের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগল, বিকেলে বাতাসের ঘ্রাণ জানিয়ে দিচ্ছিল একটি রৌদ্রস্নাত দিন চলে যাচ্ছে। সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে আমার মনে হচ্ছিল বাতাসের সাগরে আমি ডুব দিচ্ছি, কন্টকাকীর্ণ অতীত-একঘেঁয়ে জীবনের খড়খুটো-ধুলাবালি ঝেড়ে ঝেড়ে ফেলছি।

ভাবছিলাম- পঞ্চাশ-ষাট বছরের আয়ুষ্কালে আমরা নিজের জন্য সারিসারি কি রেখে যাই? সভ্য নামধারি সমাজে লোকজনে তাড়াহুড়ো ছুটে চলা সবখানে, এছাড়া আর কিইবা আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠো, রান্না করো, কাজে যাও। প্রকারান্তরের অর্ধমৃত শরীর নিয়ে কাজ থেকে ফিরে আস, কিছুক্ষণ বিরতি, তারপর আবার ঘুম পরদিনের দিনপঞ্জির জন্য। একই নিত্যকর্মের তালিকা প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ, বছরের প্রতিটি দিন ধরে চলে। বছর যায়, বছর আসে, নিত্যকর্ম একই রয়ে যায়- আর রয়ে যায় দিনশেষের অর্ধমৃত শরীর।

সেদিন তৃতীয় দিন চলছিল আমি কাজ ছেড়েছি। কোন পরিবার-পরিজন নেই, কোন বন্ধু নেই, দায়িত্ব-কর্তব্য নেই। আমার জীবন চলছিল অদ্ভূত এক পটভূমিতে। এমন নয় যে আমার পরিবার কখনই ছিল না। কয়েক বছর আগে গাঁটছড়া বেঁধেছিলাম একবার- কয়েক মাসেই ভেঙ্গে গিয়েছিল।

যেদিন থেকে কৈশোরে পা দিয়েছিলাম, মনের ভেতর প্রেম-ভালোবাসার এক স্বপ্নের জগৎ বসত গড়েছিল। কিন্তু, দুঃস্বপ্নের মতই উধাও হয়ে গেছে। আমার দিক থেকে জীবন ছিল আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখার। আমার আগের স্ত্রীর কাছে জীবন মানে ছিল- অর্থ আর প্রদর্শন। আমাদের দুজনের যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা আর কাজ করেনি।

সেদিন আমি ঢেউয়ে ঢেইয়ে বিকেলের লালীমা দেখছিলাম, অতীত জীবনের মনে গাঁথা স্মৃতিগুলোতে আবার হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমার দৃষ্টির কিনারা দিয়ে অদূরের এক মেয়ের ছবি ভাসলো, তার বয়স হয়তো কুড়ি হবে। দেখলাম সে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, জীবন নিয়ে আমার মত বিরক্ত কেউ হয়তো এই নির্জন সমুদ্রতীরে বেড়াতে এসেছে। তার চোখ নিবদ্ধ ছিল দূরের দিগন্তে, সে সামনের দিকে হেঁটেই যাচ্ছিল।

আমার তেতনা আমাকে নাড়া দিল, আমি ছুটলাম সেদিকে। আমি চিৎকার করলাম, কিন্তু মনে হলো সে বধির। আমি জানতাম সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে। একটু এগোলেই গুপ্তখালে পড়ে সে ডুবে যেত। গুপ্তখালে পড়তে তার পাঁচ মিটারের মত বাকি ছিল, আর তার কাছে পৌঁছাতে আমার তখনও একশো মিটারের মত বাকি।

সে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। প্রতিযোগীতার শীরোপা জিততেই হবে- এমন করে দৌড় লাগালাম। তাকে ধরলাম। মেয়েটি বাস্তবে ফিরলো। একজন বৃদ্ধাকে তখন দৌঁড়ে আসতে দেখলাম, তিনি আমার চিৎকার শুনেছিলেন।

মেয়েটির দিকে তাকালাম- হালকা নীল রঙের স্কার্ট পড়েছিল সে, একেবারে সাদাসিধে। কিন্তু তাকে দেখে এক সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি লাগছিল। তার কোকড়ানো বাদামী চুল চাঁদমুখটি ছায়া দিচ্ছিল। তার চোখ ছিল নীল আকাশ থেকে পড়ন্ত কোন বৃষ্টিফোটার মত, যেন রহস্যময় এক কাব্য বলে যাচ্ছে। বৃদ্ধা কাছে আসলেন।

ইতিমধ্যে মেয়েটিকে আমি বালুকাবেলায় নিয়ে এসেছিলাম। কোন কথা হয়নি তার সাথে, যা হয়েছিল তা ছিল কয়েকটিবার মাত্র দৃষ্টির বিনিময়। বৃদ্ধা আমাকে ধন্যবাদ দিলেন, জানালেন- মেয়েটি অপ্রকৃতিস্থ। তারা ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। বাংলোতে উঠেছেন।

দৈবযোগে আমি তাদের কাছাকাছিই থাকার জায়গা নিয়েছিলাম। তখনও জানতাম না- এই দৈবযোগ জীবনভর এক ছাপ রেখে যাবে। বৃদ্ধা মেয়েটিকে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু সে যেতে চাইছিল না। তার নাম শুনলাম- অ্যামি।

এতক্ষণ ধরে অ্যামি কোন কথাই বলছিল না। বৃদ্ধা বারবার জোর করছিলেন তাকে নিয়ে ঘরে ফিরে যেতে। তখন অ্যামি প্রথমবারের মত আমার সামনে কথা বললো- তুমি চলে যাও, আমাকে দয়া করে একা থাকতে দাও। বৃদ্ধা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি তাকে ঈশারায় আশ্বস্থ করলাম- আমি আছি।

অ্যামি আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো- তোমার সাথে কিছুক্ষণ কি থাকতে পারি? না করার মত কোন কারণ ছিল না আমার। তার চোখে তাকিয়ে হ্যাঁ-সূচক কাঁধ নাড়লাম। অ্যামি বলতে গেলে নিশ্চুপই ছিল। সে যতগুলি শব্দ বলেছিল তা সহজেই গুনে নেওয়া যেত। সে আমার নাম জানতে চাইল, আমি বললাম- আমাকে ‘জে’ নামেই ডেকো।

তারপর সে আমাকে বোকার মত কিছু প্রশ্ন করেছিল। আমি এখনও মনে করতে পারি। আকাশ কেন নীল ছিল? এখন লাল হলো কেন? কেন সাগরে ঢেউ উঠে? সে যদি বাচ্চা মেয়ে হত আমি বোধ হয় আশ্চর্য হতাম না। আমার মনে পড়লো তার দাদী বলেছিলেন- সে অপ্রকৃতিস্থ। অমন কিছু হলে কারও শিশু হওয়াটাও স্বাভাবিক।

আমি উত্তর করলাম- তুমি যেমন করে দেখতে চাও তেমন করেই আকাশ রঙ বদলায়। তোমার বুকের ভেতরে হৃতপিণ্ড স্পন্দিত হয় আর ওদিকে সমুদ্রেও ঢেউ উঠে। সে মন দিয়ে শুনল। আবার নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাতের দিনে, আমি সকালে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছিলাম।

বৃষ্টির দিন ছিল, গুমোট আর পাংশুটে লাগছিল চারদিক। আমি অবশ্য অতীতের নিত্যকর্মের স্বভাববশত খুব সকালে উঠে দেউড়িতে গিয়েছিলাম, জোরে বয়ে চলা বাতাস গায়ে এসে ধাক্কা মারছিল। কিন্তু শরীর মানছিল না, মনে হচ্ছিল আরেকটু ঘুমানোই ভাল। দরজা আধ ভেজানো রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লাম, জাগরণে অর্ধজাগরণে অর্থহীন নানা স্বপ্ন দেখলাম। বাইরে কারও ডাকে আমি জেগে উঠলাম।

বাইরে অ্যামি আর তার দাদী দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘরে এসে দাদী কিছুক্ষণ বসলেন। তারপর কিছু কাজ বাকি পড়ে আছে বলে চলে গেলেন। অ্যামি আমার সাথে রয়ে গেল। আমরা দুজন মুখোমুখি বসে বৃষ্টির দিন উপভোগ করছিলাম।

প্রথমে আমি বেশি কথা বলিনি এই ভেবে যে অ্যামি হয়তো চুপ থাকতেই বেশি পছন্দ করে। কিন্তু ভিন্ন দৃশ্য দেখলাম সেদিন। সে হাসিখুশি ছিল। আর পুরোদমে ভরা নদীর মত কথা বলে যাচ্ছিল। সে বৃষ্টির কথা বলছিল, বৃষ্টিমুখর দিনে তার অতীত স্মৃতির কথা বলছিল।

আরও কতকিছু। আমি বিস্মিত ছিলাম- আমি যেন এক বৃষ্টিস্নাত কবির কথা শুনছি। তার কন্ঠ, তার শব্দমালা, তার অভিব্যক্তি- সবকিছু এত কাব্যিক, এত সুচারু ছিল যে আমার মনে হচ্ছিল এক চিরন্তন কবিই শুধু এমন করে বলতে পারতেন। আর আমার মত শেকড়হীন একজন অপ্রত্যাশিতভাবে স্বর্গীয় কিছু পাবার মতই তো এসবকে ভেবে নেবে। এমন মুহূর্তগুলো আমাদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।

অ্যামি কানায় কানায় ভরা নদীর মত উৎফুল্ল ছিল। সে একেবারে অন্যরকম ছিল প্রথম দিনের চেয়ে। সে যেন ক্রিড়ামোদী বুনো বেড়ালের ছানা হয়ে গিয়েছিল। দাদী তাকে প্রফুল্ল দেখে আরও বেশি সুখী ছিলেন। আমার দিক থেকে এটা ছিল- কয়েক বছর হয়ে গিয়েছিল তখন আমি আমার দাম্পত্য জীবনের এমন গাঁটছড়া থেকে মুক্ত ছিলাম।

সত্যি করে বলতে গেলে- আমার কাছে কোনদিন এমন জীবন আসেইনি। কোমল অথচ তীব্র আন্দোলনরত কামনাগুলো জোরাজোরি শুরু করল। আর অ্যামি সেই আগুনে ঘি ঢেলে যাচ্ছিল। আমি তার কাছাকাছি না এসে পারলাম না। আমরা প্রতিদিন একসাথে কাটাতে শুরু করলাম।

দিনগুলো তারপর রাতকে তাদেরসাথে যোগ করে নিল। এক বর্ষণমুখর রাতের কথা আমার এখনও খুব মনে পড়ে, আমাদের দুজনের মাঝে দূরত্বের যত যবনিকা ছিল আমরা সরিয়ে নিয়েছিলাম। অঝর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। আর অ্যামিকে খুব প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল। সে হাসছিল, ঠাট্টা করছিল।

সে আমার সাথে মেকি লড়াই করছিল, ধাক্কা দিচ্ছিল, কখনও জড়িয়ে ধরছিল। হঠাৎ সে দরজা খোলে বাইরে বের হল। আমি তাকিয়ে দেখছিলাম, সে এক ঝরণা হয়েছে। অ্যামি আমাকে আহবান করল। তখনও আমার জানা ছিল না আমি কোথায় যাচ্ছি।

শুধু এই ভাবনাটুকু ছিল- আমি পিছন ফিরে যেতে পারব না। আমার হাত ধরে অ্যামি নাচতে শুরু করল বৃষ্টিতে ভিজে, যেন সে খাঁচাভাঙ্গা কোন পাখি- অসীম আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। সে নাচছিল, চিৎকার করছিল। আমি তার সাথে এক বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক হয়ে ছিলাম অথবা বলা যায়- আমি তার প্রফুল্ল খেলার খেলনা মাত্র ছিলাম। মনে হচ্ছিল সে আমাকে ভর করে তার প্রত্যাশার কোন ভিত্তিতে দাঁড়াতে চাইছে।

হঠাৎ অ্যামি নাচ থামিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড়াল। আমি দেখছিলাম- সে আমার দু’চোখে স্থির তাকিয়ে আছে। আমার বাহুর আলতো বেস্টনীতে তাকে কাঁপতে দেখলাম, তার ঠোঁট বারবার স্পন্দিত হচ্ছিল। বৃষ্টিধারা ছিল ঝরনার মত, আর আমাদের মাঝে সকল দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ল। যেন সে জোর করেই আমাকে জড়িয়ে ধরল।

তার নখের আঁচড় আমার শিরায় ব্যথার হর্ষানুভূতি দিয়ে যাচ্ছিল। আর তারপর- তার দু’ঠোঁট গ্রাস করল আমাকে, যেন শতাব্দীর তৃষ্ণাতাড়িত ছিল সে। অ্যামি চঞ্চল হয়ে উঠল, সে নিজেই নেতৃত্ব দিচ্ছিল এই কেলিতে। তার চঞ্চল হাত দুটোকে আমি এলোপাতাড়ি পিঠে অনুভব করলাম। তার নখগুলি আঁচড় দিচ্ছিল যেন প্লাবনে ভেসে যেতে যেতে শেকড় ধরে রাখতে চাইছে।

মরুপথের মরুযাত্রীর মত তার ঠোঁটদুটি আমার ঠোঁটদুটোকে আক্রমন করে যাচ্ছিল। যদিও আমি জড়িয়ে ছিলাম, তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ বছরের কামনার ধূপ বঞ্চিত আমার আমি গর্জন করে উঠল ভেতরে ভেতরে। আমার একটি হাত তার কোমরে পৌঁছে গেল, আর অন্য হাত তার মাথা আলতো করে ধরে প্রাপ্তিগুলোকে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। তার চঞ্চলতা, তার জোরাজোড়ি শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন।

সে তখন আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। মুহূর্তগুলো, আমাদের অনুভূতিগুলো- কোন সীমানা ছিল না তাদের। আমরা বাকি পৃথিবীটাকে ভুলে শুধু দুজন দুজনার হয়ে ছিলাম। মিনিটের বক্রগতিগুলো আমাদের মাঝে বুনো চপলতা হয়ে বয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ের মত শরীরের উষ্ণতা বৃষ্টি ধারায় শীতল হচ্ছিল- আমরা শুধু তখনই অনুভব করতে পেরেছিলাম যখন শরীরে হিমানুভূতি প্রকট হচ্ছিল।

আমি দু’হাতে তাকে তোলে ঘরে ফিরলাম। নরম বিছানায় কম্বলে জড়িয়ে সে’রাতে আমরা সেই প্রথম একসাথে শুয়েছিলাম। অ্যামির বুনো বেড়ালটি তখন প্রেম ও কামনার দেবী হয়ে উঠল, যেন রাজকীয় আসরের কোন আনারকলি। আমার ভেতরে যে শতাব্দী পুরনো সুখের কামনা ছিল, অ্যামি তার সব দিল। আমার আগের স্ত্রী যার ছিটেফোটা দিতে পারেনি, আর দিতে পারত না কোন দিন।

আমি নিজেকে পর্যবেক্ষণ করলাম, আমি কামনাতুর ছিলাম- সকল কামনা আমার মাঝে সুপ্ত ছিল, অথচ কয়েক ঘন্টা আগেও আমার কাছে অজানা ছিল সব। এমন সুখানুভূতি হচ্ছিল যে- এই সুখের রেশ অটুট থাকতে না থাকতে মৃত্যুকে নেমন্তন জানাতে পারি, কোন প্রলাপ থাকবে না- অথচ পূর্ণতা আর আত্মিক একাত্মতার চেতনা ভাস্বর হয়ে থাকবে। আমাদের দিনরাতগুলি সুখে কেটে যাচ্ছিল। পঁচিশ দিন হয়ে গিয়েছিল আমরা একসাথে ছিলাম। বেশিরভাগ সময় অ্যামি আমার কাছাকাছি থাকত।

দাদী খুশী ছিলেন, কিন্তু তাকে আমি মাঝেমাঝে গভীর ভাবনায় অন্যমনস্ক দেখতাম। আমি ভাবতাম, অ্যামির অপ্রকৃতিস্থতা আবার ফিরে আসতে পারে এই ভাবনায় তিনি হয়তো উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমার কখনও মনেই হয়নি তাকে জিজ্ঞেস করে দেখি। আমরা চিত্ত দৃঢ় ছিল তার নিজের সিদ্ধান্তে- যা কিছুই হোক আমি অ্যামির সাথেই থাকব। মাসের শেষ ছিল, এক সুন্দর সকালে আমি অ্যামির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

তার আগের দিন আমি ব্যস্ত ছিলাম সারাদিন, শুধু সকালবেলা তার সাথে দেখা হয়েছিল। অ্যামি বলেছিল- আমি ফিরে আসার পর রাতে আমাদের দেখা হবে। কিন্তু সে আসেনি। আমি তার বাংলোতে গিয়েছিলাম, দাদী বেরিয়ে এসে বললেন- অ্যামি ঘুমাচ্ছে। যদিও আমার কাছে কেমন কেমন লাগছিল, আমি স্বাভাবিক হিসেবে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে আমি দেরী করে ফিরেছি।

সকালবেলা এগারোটা বাজতে চলছিল, আমি অ্যামির জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছিলাম। আমি তাকে কিছু চমক দিতে চাচ্ছিলাম। তার জন্য কিছু উপহার কিনে এনেছিলাম আগেরদিন। কিন্তু তার ফেরার কোন লক্ষণ দেখছিলাম না। বারটা বাজল।

আমি আবার তাদের বাংলোতে গেলাম। কিন্তু, কাউকে দেখলাম না। আমি অ্যামিকে ডাকছিলাম। কেউ সাড়া দিচ্ছিল না। আমি পাগলের মত দরজায় ঠুকা দিচ্ছিলাম, আমি চিৎকার করছিলাম।

তখন দেখলাম, বাংলোর কর্তা আমার দিকে আসছেন। তিনি আমার হাতে একটি চিঠি তোলে দিলেন। দাদীর লেখা। আমার ইন্দ্রীয় আমাকে নাড়া দিচ্ছিল- খারাপ একটা কিছু ঘটেছে। আর সত্যিই, তা ঘটেছিল! দাদী সব বিবরণ লিখেছেন চিঠিতে।

অ্যামি জটিল বিস্মৃতি রোগে ভুগছিল। তারা এখানে এসেছিলেন চিকিৎসকের পরামর্শে, আবহাওয়া পরিবর্তনে। অ্যামি আমার সাথে সুখী ছিল, তাই দাদী আমাদের আলাদা করেননি। আমার সাথে অ্যামি খুবই স্বাভাবিক ছিল, এতটাই যে এর আগে সে কখনও এমন ছিল না। দাদী আশা করে বসেছিলেন- কোন দৈবিক ঘটনা ঘটবে, অ্যামি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে।

চিকিৎসকরাও এমন কিছুর সংকেত দিয়েছিলেন- মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশি সুলক্ষণ দেখা দিতে পারে, যা হয়তো বারবার দেখা দেবে, অথবা স্থায়ী হিসেবে দেখা দিতে পারে। অ্যামি জন্ম থেকে এমন ছিল না। সে ছিল ভয়াবহ সড়ক দূর্ঘটনার শিকার। শুধু সে বেঁচে গিয়েছিল পরিবারের সবাইকে হারিয়ে, একাই স্বজন হারানোর প্রলাপ গাইতে। কিন্তু, অতীতের সব স্মৃতি তার হারিয়ে গিয়েছিল।

কেউ নিশ্চিত করতে পারল না যে তার স্মৃতি ফিরবে। এমন সম্ভাবনা ছিল- অ্যামি হয়তো নতুন করে স্মৃতি গড়বে, আর তা স্থায়ী হলে নতুন স্মৃতিতেই সে জীবন কাটাবে। সেদিন রাতের পরে তা আবার নিরাশায় বসত গড়ল। সেদিন রাতে অ্যামির খুব মাথাব্যথা হচ্ছিল। মাথাব্যথা নিয়ে সে শুয়ে পড়েছিল।

যখন জেগে উঠল- নতুন সব স্মৃতি ততক্ষণে স্মৃতির পাতা থেকে তার মুছে গিয়েছে। দাদী চেষ্টা করলেন, অ্যামি নিকট বর্তমানের কোন স্মৃতি মনে করতে পারলো না। সে দাদীকেই চিনতে পারছিল না। শুধুমাত্র দীর্ঘ কয়েক বছরের অভ্যাশবশত দাদীর উপস্থিতিকে সে সহ্য করছিল। চিকিৎসক বলেছিলেন, বিস্মৃতির অনেক রোগী অবচেতনভাবে তাদের অতীত অর্জিত দক্ষতা অথবা অতীত অভ্যাসকে বজায় রাখতে পারে।

অ্যামি আমার সাথে কাব্যিক ভাষায় কথা বলেছিল, তা ছিল তার অর্জিত শিক্ষা কারণ সে সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিল তার সুস্থ জীবনে। সে’রাতে অ্যামির মাথাব্যথা এতই তীব্র হয়েছিল, তাদেরকে চিকিৎসার জন্য খুব ভোরে দ্রুত ছুটতে হয়েছিল। দাদী জানতেন, কি আছে তার সামনে। কয়েক মাসের নাগাদার চিকিৎসা অ্যামিকে সুস্থ করবে, কিন্তু সে থাকবে নতুন করে স্মৃতি গড়ার দ্বারপ্রান্তে। দাদী দ্বিধান্বিত ছিলেন, আমাকে চির-অসমাপ্ত এই জীবন পরিক্রমায় জড়িয়েছেন ভেবে অপরাধবোধ করছিলেন।

তারপর, আমার মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেয়ে তিনি নিশ্চুপ প্রস্থানের সিদ্ধান্তকেই উপযুক্ত মনে করলেন। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না, সে’রাতের বৃষ্টিমুখর লগ্নে আমার নিঃশ্বাসে অ্যামির নিঃশ্বাসের আঁচ নিয়ে আমি যে পথে যাত্রা করেছিলেম, সেখান থেকে ফিরে আসা যায় না। অ্যামি আমার কাছে ছিল আমার দিশা, আমার গন্তব্য। জীবন অনেক ছোট- জীবনকে অর্থপূর্ণ আর চিরসবুজ উদ্দেশ্যে সাজানোকেই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছিল, যা আমি অ্যামিকে কাছে পেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, এখানে ওখানে কুকুরের মত অনেক বছরের ছুটে চলা জীবনের পরে।

বাংলোর কর্তাকে অনেক অনুনয়-বিনয়ের পরে আমি দাদীর সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি এই ভেবে মেনে নিয়েছিলেন, তিনি আর কত দিন- কেউ একজন অ্যামির পাশে দাঁড়াবে। আমার কাছে এটা কোন সাহায্য ছিল না, বরঞ্চ আমার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল যে আমি আমার জীবনের দিশাকে সাথে নিয়ে থাকব। অনেকদিন আমি ছুটে গিয়েছিলাম অ্যামিকে আরোগ্যশালায় দেখতে। তারপর সেখানেই স্থায়ী বসত গড়লাম।

আর অ্যামি নিশ্চুপ পৃথিবীতে একেবারেই নিথর হয়ে ছিল, যেন গতির সাথে কোন মৃত জড়িয়ে আছে। এত দুঃসময়ের মাঝে একটি চমকে উঠার মত সুসংবাদ ছিল, অ্যামি তার গর্ভে আমাদের অপত্যকে পোষণ করছে। চিকিৎসকরা জটিলতার ভয়ে গর্ভপাতের কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু আমার প্রবল আকুতি-মিনতি ছিল- অ্যামির মাতৃত্বকে নষ্ট করে দেবেন না। অবশেষে, তারা মেনে নিয়েছিলেন। দু’বছর হয়ে গেল আমি আমার ছোট্ট সোনার সাথে আছি- অ্যামির ছেলে।

তার নাম রেখেছি জেমি। অ্যামির অবস্থা এখনও স্থায়ীরূপে সুস্থ হয়নি। আমি শুধু এই প্রত্যাশা নিয়ে বেঁচে আছি, একদিন অ্যামি আমার কাছে ফিরবে আমাদের অতীত দিনের স্বর্ণালী স্মৃতি মনে করে। আর সেদিন সে দেখবে মায়ের জন্য প্রতীক্ষমান তার ছেলেকে সাথে নিয়ে আমি পথে দাঁড়িয়ে আছি। ------------------- মূল গল্পঃ Amnesia in Memories ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।