আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সবাই এমপি হতে চায়

সবাই এমপি হতে চায়। সারা দেশজুড়ে রাস্তায় রাস্তায়, নগর-শহর থেকে গ্রামীণ জনপদে ডিজিটাল ব্যানার, রঙিন পোস্টারে ঝুলছে যার তার ছবি ও নাম। অমুক ভাইকে সংসদে দেখতে চাই। চাওয়া দূরে থাক, এদের কাউকে মানুষ চিনে না পর্যন্ত। সংসদ সদস্য হওয়ার মতো যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা মানুষের মধ্যে দূরে থাক অনেকের নিজ দলেও নেই।

ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার কাউন্সিলর হওয়ার মতো জনপ্রিয়তা নেই। রাজনৈতিক অতীত নেই, গণমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। ছাত্র রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের গৌরব নেই, ক্যারিশমা নেই। তবু নিজে নিজে টাকার জোরে এসব ডিজিটাল ব্যানার ও পোস্টারের অশ্লীল দৃশ্যে চারদিক এমনভাবে সাজিয়েছে যে, চোখ মেলে তাকানো যায় না। মানুষ বিরক্ত হচ্ছে, ক্ষুব্ধ হচ্ছে।

তাতে তাদের কিছুই হয় না। মূল্যবোধহীন রাজনীতির ধারাবাহিকতায় এটি চলছে। দল মনোনয়ন দেবে না নিশ্চিত হয়েও এমনটি করছে। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নাকি কয়েকদিন আগে তার বাসভবনে দর্শনার্থীদের সঙ্গে আক্ষেপ করে বলেছেন, এমপি কি কাচকি মাছের ভাগা? সবাই এমপি হতে চায়। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক আদর্শ, চিন্তা ও চেতনায় লালন করে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় একসময় যারা গণমানুষের আস্থা অর্জন করতেন তারাই দলের মনোনয়ন চাইতেন।

তাদের কোনো ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টারের প্রয়োজন হতো না। মানুষের হৃদয়ে, দলীয় কর্মীদের মুখে মুখে তাদের নাম উচ্চারিত হতো। একেকটি আসনে এক এক দলের দু-তিনজনের বেশি কেউ মনোনয়নও চাইতেন না। অসংখ্য আসনে এক এক দলের একজন করেই মনোনয়ন চাইতেন যার সম্ভাবনা দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নিশ্চিত ছিল। '৯১ সাল পর্যন্ত তো বটেই, '৯৬ সাল পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে গঠিত সংসদ, শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির গতিপ্রবাহ আজকের এই মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বীভৎস চিত্র রাজনীতির ময়দানে দেখা গেছে। '৯১ সালে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছিল দলের ত্যাগী নেতাদের। ভঙ্গুর বিএনপি টাকাওয়ালাদের ধরে ধরে এনে মনোনয়ন দিয়েছিল। '৯৬ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দানে দুই দলের রাখঢাক থাকলেও ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর তারা পথহারা হয়েছেন। সংসদ পার্লামেন্টারিয়ানদের জন্য স্বর্গস্থান হতে পারেনি।

ঠিকাদার, টেন্ডারবাজ থেকে শুরু করে সমাজকে কলুষিত করার খলনায়করা সংসদে আসতে থাকেন। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যোগ দেন ব্যবসায়ীরা। সৎ, ক্লিন ইমেজের আদর্শবান রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা অসহায় হয়ে পড়েন। ছাত্র সংগঠনগুলোতে অছাত্র নেতৃত্বের আগ্রাসন রাজনীতিকে কলুষিত করে তোলে দেশজুড়ে গণসংগঠনগুলোর নেতা-এমপিদের লুটেরা পকেট সিন্ডিকেটের কারণে। তৃণমূল বিস্তৃত দুর্নীতির আস্ফালনে নষ্টদের সিন্ডিকেট গণবিচ্ছিন্ন হলেও অবৈধ অর্থের জোরে আর পেশিশক্তির কারণে স্থানীয় রাজনীতিতে সংগঠন খণ্ড খণ্ড আকারে তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে।

এমপি মনোনয়ন চাইলে পাক না পাক নির্বাচিত এমপির কাছে গুরুত্ব বাড়বে, স্থানীয় প্রশাসন পাত্তা দেবে, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজির প্রসার ঘটবে। দলের নেতৃত্বেও অবস্থান সুদৃঢ় হবে। কত স্বপ্ন! মানুষের কল্যাণ নয়, নিজের ভাগ্য বদল। অর্থবিত্ত কামানোর বাহন হয়েছে রাজনীতি। গরিবের দল আওয়ামী লীগে কী ব্যাপক হারেই না ২৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিলের উৎসব দেখেছে বাংলাদেশ।

বিএনপি নির্বাচনে এসে মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করলে আওয়ামী লীগের চাইতে তিন গুণ বিক্রি করবে। গণতন্ত্রের ২২ বছর দূরে থাক, বিশেষ করে বিগত ১২ বছরে সারা দেশজুড়ে কোনো কোনো মন্ত্রী ছাড়াও এমপি-নেতার সিন্ডিকেটে একটি নষ্ট চক্র জন্ম নিয়েছে রাজনীতিতে। এদের আস্ফালনে, কর্মকাণ্ডে মূল্যবোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন না হয় ঘরে উঠে গেছেন। প্রকৃত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী যারা আদর্শবোধ নিয়ে রাজনীতি করতেন, করছেন গণমানুষের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা থাকলেও শোডাউনের অসুস্থ রাজনীতির অর্থ খরচের দাপটের কাছে তারা কোণঠাসা। এই রাজনীতির পরিবর্তনে মনোনয়ন দানে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক ভূমিকা নিতেই পারে।

সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি পাঠ করা বা তা অনুসরণ করার যোগ্যতা থাক বা না থাক, সংবিধান পড়া ও বোঝার ক্ষমতা থাক বা না থাক এমপি তাদের হওয়া চাই। গণতন্ত্রের অধিকারের এই সুযোগে তারাই এগিয়ে আছে। তাদের ছায়ায় ছায়ায় নষ্টদের ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টারে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশ। কেউ ভালোবাসুক আর নাই বাসুক, কেউ পছন্দ করুক আর নাই করুক, লাজলজ্জার অভিধান তাদের কাছে নেই। তাই তাদের রঙিন ছবি আর ব্যানারে শোভা পাচ্ছে অমুক ভাইকে সংসদে দেখতে চাই।

সুনামগঞ্জ-১ আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন ১৮ জন। এদের মধ্যে যোগ্য যেমন আছেন, অযোগ্যও আছেন। অনেক প্রবাসী আছেন যারা নির্বাচন এলে এলাকায় ডিজিটাল ব্যানার ও পোস্টার টাঙিয়ে দেন। সংসদে নাকি তাদের দেখতে চায় লোকজন! এবার তাদের সংখ্যাও বেড়েছে। সংসদে আইন প্রণয়নে একসময় এমপিরা ভূমিকা রাখতেন।

জাতীয় ইস্যুতে বিতর্ক করতেন। নিজ দলের সংসদীয় দলের সভায় কথা বলতেন। এসব যোগ্যতা আজকের বাংলাদেশের এমপিদের মধ্যে দরকার পড়ছে না। স্থানীয় সরকারকে উপেক্ষা করে নির্বাচনী এলাকাজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রকৌশলী দফতরের ঠিকাদারি, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন সব তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। হাট, মাঠ, ঘাট, জলমহাল, পাথরমহাল, বালুমহাল সর্বত্র তাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।

আজকের সংসদ সদস্য কাল হয়ে যাচ্ছেন অগাধ বিত্ত-বৈভবের মালিক। নিয়োগবাণিজ্য থেকে তদবিরবাণিজ্য সর্বত্র তাদের কমিশনের ভাগ। তারা তাদের সিন্ডিকেটের অনুগত কর্মীদের মাঝেও এই লোভের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাই আজ সবাই এমপি হতে চায়। ক্ষমতা চায়।

অগাধ অর্থ-বিত্তের মালিক হতে চায়। জনগণের কল্যাণে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে সেবক হয়ে ঘুরতে চায় না। বারো ভূঁইয়াদের চেয়েও তারা নির্বাচনী এলাকাজুড়ে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা এমপি হতে চায়।

 

 



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.