আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে

শ্রদ্ধেয় জাফর স্যার ও ইয়াসমীন ম্যাডাম,
আজ আপনাদের ফেরার অনুরোধ করতে আসিনি। কোন মুখেই সেটা করার যোগ্য আমি নই। আমি আজ দুঃখিত নই, কেবলই লজ্জিত। জানি, অনেক কষ্ট নিয়ে যাচ্ছেন- কাছের বা ভরসা করার মত মানুষেরা মুখ ফিরিয়ে নেবার পরে বিশাল এক শুন্যতা থাকে বৈকি। শুধু আশা রাখি যে, এটুকু জেনে যাবেন অনেক মানুষ, অক্ষম মানুষ মাথা নিচু করে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে আপনাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

আমাদের হাতে ফাইল নেই, আমাদের হাতে রাইফেল নেই, আমাদের হাতে আর্জেস গ্রেনেড কিংবা ককটেল নেই। আমাদের কাছে নেই পেপার স্প্রে কিংবা টিয়ার গ্যাস। শ্রদ্ধা মেশানো কিছু অকেজো ভালবাসা ছাড়া দেবার মত কিছুই নেই আমার কাছে। কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় পড়েছিলাম “হৃদয়ের মত ভয়ানক এক অস্ত্রের” কথা, সেটুকুই আজ সাথী আপনাদের।
আপনার সঙ্গে সবসময় হয়তো একমত হতে পারিনি স্যার।

ডঃ ইউনুস প্রসঙ্গে আপনার মুগ্ধতা কিংবা প্রথম আলোতে টিপাইমুখ বাঁধের প্রসঙ্গে অযথা আবেগী লেখা পড়ে অধৈর্য-অর্বাচীন আমি আপনার অজান্তে আপনার মুন্ডুপাত করিনি তা নয়। কিন্তু তা বলে এমন একটা বিদায় আপনার প্রাপ্য কখনই ছিল না স্যার। অথচ, কি দুঃসহ ব্যাপার- অশ্রুপাত ছাড়া কিছুই করবার নেই আমার। কাকতালীয় ভাবে আজকেই আপনার “নিঃসঙ্গ বচন” পড়ছিলাম। প্রথম পাঠে এই বইয়ের অনেক স্থানে আপনার সঙ্গে আমার তীব্র দ্বিমত ছিল, স্যার।

কিন্তু আজ “আমার ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে দাও” পড়ছি, আর কেবলই আবেগতাড়িত হয়ে বলতে চাইছি “আমার শিক্ষকদের ফিরিয়ে দাও”।
স্যার, পিলখানার ঘটনার পরে টক-মারানী সুশীলেরা যখন ষড়যন্ত্র আর পালটা ষড়যন্ত্রের আজগুবি তত্ত্ব ফাঁদতে ব্যাস্ত তখন আপনিই কেবল ওই ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী ‘শিশুদের’ ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত মানবিক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যেটা কোনও সম্পাদক ছাপতে রাজি হয়নি। অথচ আফসোস, আপনি যখন আপনাদের সন্তানদের দিনের পর দিন ঢাকায় একলা রেখে শাবিতে শ্রম দিয়ে গেছেন তখন আমরাও কেউ পাশে দাড়াঁইনি। জানি জথেষ্ট নয়, তবু সভয়ে বলি- আমাদের সুবিধাবাদীতার জন্য আমরা লজ্জিত স্যার।
চলেশ রিছিল, আলফ্রেড সরেন কিংবা বিশ্বজিৎ কে নিয়ে লেখার জন্য যেমন আপনাদের মত গুটিকয় মানুষ ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি, আগামী কাল আপনাদের জন্য লেখবার জন্যও বোধহয় বাজারমূল্যে ভারী কোনও পত্রিকা কলামিস্টকে পাওয়া যাবে না।

কাটতি বাড়াতে স্বঘোষিত “সর্বাধিক প্রচারিত” দৈনিকটির এক কোনায় এক কলাম আধা ইঞ্চির আধখাপচা একটা খবর পাওয়া যেতে পারে বড়জোর। তবু জেনে যাবেন স্যার, কাঁচা হাতে আমরা লেখবার চেষ্টা করেছিলাম। এই হতভম্ব বিদায়ে অক্ষম শ্রদ্ধা ছাড়া কিছুই যে আর দেবার নেই আমার।
ভালো থাকবেন স্যার, নিরাপদে থাকবেন। যদিও আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা কি করতে পারব জানিনা।

আশা করি চমৎকার একটা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস আমরা পেতে যাচ্ছি। আমরা সাগ্রহে বসে রইলাম স্যার। সেখানে নিশ্চয় “জোছনা ও জননীর গল্প” এর মত খালি জোছনা থাকবে না, মুক্তিযুদ্ধের ভেতরের আবেগটুকু থাকবে, জননীর গল্পটুকু থাকবে, আমরা আশাবাদী স্যার। আপনিই তো খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থেকেও আশা করার অভ্যাসটি করিয়ে দিয়েছেন এই প্রজন্মের অসঙ্খ্য জনকে।
এখন নিশ্চয় আগের চেয়ে অনেক অবসরে থাকবেন স্যার।

আমাদের মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে থাকাকালীন ‘একুশের আলোকচিত্র’ নিয়ে আয়োজিত একটি প্রদর্শনীতে আপনাকে আমরা পাশে পেয়েছিলাম। ব্যাস্ততার মাঝেও সিলেট থেকে সেই ছোট্ট আয়োজনে আপনি এসেছিলেন। তখন সময়টা বড় খারাপ ছিল স্যার। নিজামির গাড়িতে তখন পতাকা উড়ত পতপত করে। আর তাঁর ছায়ায় আফম ইউসুফ হায়দারেরা ক্যাম্পাসে শহীদ শিক্ষক “এ আর খান খাদিমের” শেষ স্মৃতিটুকু ঢেকে দেবার জন্য প্রানান্ত চেষ্টায় ব্যাস্ত।

উদভ্রান্ত সেই সময়ে আপনাকে পাশে পাওয়া আমাদের জন্য অনেক সাহসের উৎস ছিল। সামনে সেই সময় যদি আবারো আসে (মনেপ্রাণে চাই না আসুক) আপনি আমাদের সাহসের বাতিঘর হয়ে থাকবেন স্যার। এখন ভালোই হল স্যার, বিভিন্ন আয়োজনে এখন আপনাকে পাশে পাবার সুযোগ নিশ্চয় বেড়ে গেল।
শাহবাগে আপনাকে কিংবা ম্যাডামকে একেবারে ছুঁয়ে-দেখা দুরত্বে পেয়েছিলাম স্যার, আমি জানি ভবিষ্যতেও পাব। আপনি আমাদের চেতনার মেরুদণ্ড স্যার।

আমরা আপনার মত আশা করতে চাই। আস্তে আস্তে হলেও মেরুদণ্ড সোজা করতে চাই। যেদিন সেটা সম্ভব হবে সেদিন নিশ্চয় চশমার ওপর দিয়ে হাসি হাসি চোখে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে আধমুচকি হাসি দিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে মনে মনে বলবেন- “বলেছিলাম না!” আশা করি সেইদিনটা আসবেই স্যার, খুব তাড়াতাড়ি না হলেও। যতদিন না আসে ততদিন আমরা আপনার গল্প শুনিয়ে যাব আগামী প্রজন্মকে। ভাল থাকুন স্যার, অনেক অনেক ভাল।

এই শুভেচ্ছাটুকু ছাড়া দেবার যে কিছুই নেই এ নিঃস্ব হাতে।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।