আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফারিয়া-মেহজাবিন সমাচার এবং আমাদের রুচির দীনতা

তোকে দেখিনা, কতো হাজার বছর হয়ে গেলো...
গত কয়েক বছরে ‘মডেল হওয়ার’ শিল্প বেশ ভালোভাবেই দাঁড়িয়ে গেছে বাংলাদেশে। নানা ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পণ্যের প্রচারে মডেল হওয়া মোটেও দোষের কিছু না। বিশ্বের উন্নত-স্বল্পোন্নত সব দেশেই পণ্যের প্রচারে মডেলের ব্যবহার হয়। সুতরাং একজন তারকা যদি কোনো পণ্যের প্রচারে কাজ করেন, তবে অবশ্যই এটিকে সম্মানজনক একটি অর্জন হিসেবে ধরা যায়। কিন্তু সম্মানের জায়গাটা নিতান্তই হাস্যকর ও ঘৃণ্য হয়ে উঠে, যদি মডেল হওয়ার নামে শুধুমাত্র দেহ প্রদর্শনে মনোযোগী হয়ে উঠে কেউ।

শুরুটা বিলবোর্ডের মাধ্যমে। উদ্ভট সব পোশাকে কথিত মডেলদের প্রথম উপস্থাপন করে দেশীয় নামকরা একটি পোশাক ব্র্যান্ড। প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য শুধুমাত্র পোশাকই তৈরী করে না। গরুর দুধও প্রক্রিয়াজাত করে পরিবেশন করে। প্রতিষ্ঠানটির বিলবোর্ড বিজ্ঞাপনে পোশাকের চেয়েও উল্লেখযোগ্য করে দেখানো হয় ‘মডেলদের’ দেহ।

আরো বিশেষভাবে বলা যায়, নারী মডেলদের দেহ। মডেল হওয়ার সম্মানটা প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখনই। পণ্যের প্রচারক হওয়ার নামে অর্থের বিনিময়ে নিজের দেহের প্রদর্শনীকে তখন মনে হয় বেশ্যাবৃত্তির আধুনিকতম সংস্করণ। যশ ও খ্যাতির প্রতি লোভ থাকা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব। একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

তো এই লোভের প্রতি তীব্রভাবে আকর্ষিত হয়ে বহু তরুণ-তরুণী মডেল হওয়ার ব্রত গ্রহণ করে বসে পূর্বাপর কিছু না ভেবেই। ফলাফলটা হয়ে দাঁড়ায় সমাজের জন্য মহা-অসনি সংকেত। মডেল বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে কম বয়সী তরুণীদের সহজেই ঘায়েল করতে থাকে এক শ্রেণীর বিজ্ঞাপন নির্মাতারা। খ্যাতি লাভের দুর্দমনীয় কামনায় দেদারসে শুরু হয় দেহ বিক্রি। সেই বিক্রি কখনো বিলবোর্ড বিজ্ঞাপনে, আবার কখনো টিভি পর্দায় এবং খুব দুঃখজনকভাবে কখনো আবার বিজ্ঞাপন নির্মাতার দামী বিছানায়।

এভাবেই চলতে থাকে মডেল হওয়ার রেস। একসময় আমাদের বিবেক সয়ে নেয় প্রকৃতির প্রতি এমন অনাচার। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আমরাও মেনে নিতে শুরু করি সব কিছু। তারপর যখন ‘উঠতি মডেলদের’ দেখা মিলে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে, রাজধানীর বিভিন্ন পাণশালায় অর্ধনগ্ন মডেলদের মাতাল হওয়ার ছবি প্রকাশিত হয় মিডিয়ায়, পাপ-পরীণতির শিকার হয়ে বেড়ে চলে আত্মহত্যার প্রবণতা- তখনও আমরা নির্বিকার থাকি। আরে, সমস্যা কী! দেশ আধুনিক হচ্ছে না? আধুনিকতার দোহাই; আসলেই তাই।

যুগের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে আমরা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং একই সাথে আমাদের আঞ্চলিক সভ্যতাকেও বিলিয়ে দেই অনায়েসে। ধর্মের কথা তো বাদই। তারপর আমরা লিঙ্গ বিভেদ ভুলে গিয়ে উঁচু করে দেই বুক, আর বলে উঠি দেশ এগুচ্ছে। আমরা হয়ে উঠছি সভ্য জাতি। সবশেষে যা হয়, তা হলো অবচেতন মনে পণ্যের মডেলদের জীবনের মডেল ভাবতে শুরু করি আমরা।

আধুনিক হওয়ার চ্যালেঞ্জ না আমাদের! তারপর মডেলদের পোশাক চড়ে বসে আমাদের মধ্যবিত্ত শরীরে। আমাদের কথা বলায় ভাগ বসায় ডিজুস সংস্কৃতির ‘আভিজাত্য। ’ টিভি মিডিয়ার ঈর্ষনীয় উন্নতিতে ঘরে বসেই আমরা পেতে শুরু করি মডেল হওয়ার আদর্শ শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও বাদ থাকে না আমাদের। সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার গুরুভার গ্রহণ করে কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়।

সব মিলিয়ে দুর্দান্ত গতীতে চলতে থাকে আমাদের ভেতর-বাহিরের আধুনিকায়ন। আধুনিক হওয়ার শিক্ষা গ্রহণের সমান্তরালে চলতে থাকে আমাদের পরীক্ষাও। দেশীয় টিভি চ্যানেলের সাথে সে পরীক্ষা নিতে পৃষ্ঠপোশকতার হাত বাড়ায় ‘গোলাপের মতো সুন্দর ত্বকের’ যত্ন নেওয়ার দ্রব্য নির্মাতারা। হাত বাড়ায় ‘ত্বক ফর্সা করার’ যাদুকরী ক্ষমতাবান ক্রিম নির্মাতারাও। ব্যাস, চলে আমাদের পরীক্ষা।

মা-বাবা মিলে বসে পড়েন মেয়েকে ‘মডেল’ বানানোর প্রতিযোগীতায়। কিন্তু মা-বাবা যদি একান্তই অনুপযুক্ত হন আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে, তাতেও অসুবিধা নেই। সুন্দরীদের মডেল বানানোর যুদ্ধে অবতীর্ণ করার কল্যাণকর কাজ করে দেন বন্ধুরা; তারা তো আর অনাধুনিক হতে পারে না! সে পরীক্ষা শেষে বের হয়ে আসেন চোখ ধাঁধাঁনো সৌন্দর্যের প্রতিনিধিরা। আমরা চোখ বড় বড় করে দেখি সুন্দর কাকে বলে! আধুনিক হয়ে যাওয়া আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি; আমাদের দেশে কতো সুন্দরী। আমাদের তৃপ্তি, বিশেষ করে আমাদের চোখের তৃপ্তি বহুগুণ বেড়ে যায় যখন দেখি, সেই সুন্দরীরা আমাদের সঙ্গ দিচ্ছেন সব সময়।

সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি অঙ্গও দেখান; চলতি পথে বিলবোর্ডে, ড্রইং রুমের টিভিতে, পত্রিকার ছাপানো বিজ্ঞাপনে, এমনকি ছোট্ট ট্যাবলয়েডের আরো ছোট্ট আকারের ছবিতেও মডেলদের ছবি ছাপিয়ে লেখা থাকে ‘ডাউনলোড করুন’! আমরা ডাউনলোড করি বা না করি, আমাদের মোবাইলে সুন্দরীরা ঠিকই ধরা দেন ক্ষুদেবার্তা হয়ে। দেখা করতে চাইলে, সুন্দরীদের সাথে এক মিনিট কথা বলতে চাইলে নির্দিষ্ট নাম্বারে ফোন দিলেই হয়ে যাবে। চাইলে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও চলতে পারে মডেল-দর্শন! আধুনিক হওয়ার চূড়ান্তে পৌঁছানোর পথে আমরা ভুলে যাই অনেক কিছু। আধুনিক হওয়ার দোহাই দিয়ে ভুলে বসি আভিজাত্যের সংজ্ঞা। খুব দুঃখজনকভাবে মডেলদের চাল-চলন, জীবনধারা এমনকি নোংরামিও আমাদের চোখে ধরা দেয় অনুকরণীয় হিসেবে।

চাল-চলন ও জীবনধারা গ্রহণ করতে গিয়ে মডেলদের নোংরামিও রক্তে ঢুকিয়ে ফেলি আমরা। ক্রমান্বয়ে বদলাতে থাকে আমাদের রুচিবোধ। প্রভাবিত হতে থাকে আমাদের মিডিয়া, সমাজ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের বর্তমান প্রতিনিধিরা। সম্প্রতি দুই মডেল মেহজাবিন ও ফারিয়ার ফেসবুক-কাণ্ড সম্পর্কে অবগত আছেন? এদের একজন ফারিয়া প্রথমে ‘দুষ্টুমি’ করে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন; তাতে আপত্তিকর মন্তব্য উঠে এসেছিলো মেহজাবিনের বিপক্ষে। ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য কিভাবে আসলো? কারণ মন্তব্যটি যে আপত্তিকর হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারেননি ফারিয়া।

কেন বুঝতে পারেননি? কারণ আধুনিক হওয়ার রেসে দৌড়াতে গিয়ে কোনটি আপত্তিকর আর কোনটি আপত্তিকর নয়, সে রুচিবোধ যারা হারিয়েছেন তিনিও তাদের একজন। ফারিয়ার স্ট্যাটাস নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রতি-স্ট্যাটাস দিয়ে দেন মেহজাবিন। তাতেও ছিলো হিংসার ঝাঁঝালো উচ্চারণ। এখানে মেহজাবিনও দেখিয়েছেন রুচিহীনতার সুস্পষ্ট প্রদর্শনী। ঘটনার এই পর্যায়ে ঘটেছে আরো ভয়াবহ কাণ্ড।

কতিপয় ফেসবুক ব্যবহারকারী ফারিয়ার নামে বানানো ফেসবুক পেইজ থেকে মেহজাবিনকে আক্রমণ করেছেন অশ্লীলতায় ভরা শব্দ দিয়ে। দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের রুচি দীনতার ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। মডেল হওয়ার রেসে নেমে ফারিয়া-মেহজাবিন যা ভুলেছেন, আমরা তা ভুলেছি তাদের অনুরকরণ করতে গিয়ে। অনুকরণীয় হিসেবে তাদের গ্রহণ করে। ঘটনার বাকি অংশে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন মেহজাবিনের চেয়ে বয়সে কিছুটা বড় ফারিয়া।

সিনিয়র মডেলের প্রতি ওমন অবিবেচক স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি ঠিক করেননি, এমনটি জানিয়ে দিয়েছেন নতুন স্ট্যাটাস। মেহজাবিন আধুনিক মানুষের প্রতিনিধি; তিনিও সব মেনে নিয়ে ‘ক্ষমা’ করে দিয়েছেন ফারিয়াকে। ঘটনার শেষ হওয়া উচিত ছিলো এখানেই; কিন্তু হয়নি। কেনো হয়নি? কারণ রুচিহীনতার পরিচয় দেওয়া বাকি ছিলো আমাদের মিডিয়ার। নাম সর্বস্ব কিছু অনলাইন পোর্টাল সে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছিলো সবার আগে।

যা খুশি তাই লেখে ভালোভাবেই দায়িত্ব সামলেছে তারা। এতে দুঃখ পাওয়ার কিছু ছিলো না। কিন্তু ‘আলোর দোকানদারী’ করে ‘সব বদলানোর’ ঝাণ্ডাধারীরাও যখন ফারিয়া-মেহজাবিনের কাণ্ড নিয়ে অনলাইন পোর্টালে নিউজ করে ফেলে, যা খুশি তা লেখে বসে; তখন দুঃখে কান্না চেপে আসে। স্পষ্ট হয়ে উঠে আলোর পেছনের গভীর অন্ধকার। আধুনিকতার দুর্দম্য স্রোত, তাতে গা ভাসানোর বিলাসিতা এবং সমান্তরালে পরিবর্তিত হওয়া পরিপার্শ্ব দেখে এখন কী বলবো, কী-ই বা বলা উচিত।

ফারিয়া-মেহজাবিন সমাচারে রুচির কী নিদারুণ দীনতার পরিচয় দিলাম আমরা! সব মডেল খারাপ নন; কেউ কেউ বরং এতোটাই ব্যক্তিত্ববান যে, তাদের আসলেই অনুকরণ করা উচিত। কিন্তু তা তো আমরা করি না! ইচ্ছে করছে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দেই আর বলি, সাবাশ; আমিও তো আধুনিক মানুষের প্রতিনিধি!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।