আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোলকাতা আপিস



জাতিসংঘ পার্কের মেইন গেটের সাথে লাগোয়া ফুটপাতে ফরিদা খালার চায়ের দোকান। এখানে নিয়মিত আড্ডা দেয় সামিন, রুবেল, ইমরান, সুমন আর রাসেল। তাদের সাথে আরো যোগ দেয় অনেকে। রাতের লাইভ অনুষ্ঠান শেষ করে মতি ভাই আসেন। রাজনৈতিক ফাংশন না থাকলে যাদু ভাই আসেন।

তেমনি অনেক ছোট ভাই ও বড় ভাই নিয়ম করে ঘুরে যান। সন্ধ্যা সাতটা থেকে একে একে জড়ো হতে থাকে তারা। আড্ডা চলে রাত এগারোটা পর্যন্ত। মাঝে মাঝে চা-বিস্কিট আর সিগারেট পর্ব চলে। গল্প-কৌতুক-অভিনয় হয়, হাসি হয়।

দেশের তাবত বিষয় নিয়ে কথকবার্তা চলে। আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে মুখে খই ফোটে। মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি নিয়েও মাতামাতি হয়। সবাই ফুরফুরে মেজাজে থাকে। এখানে আসতে না পারলে রাতের ঘুমটা ভাল হয় না তাদের! একদিন সবাই সম্মতিক্রমে ফরিদা খালার চায়ের দোকানটার নাম দিল ‘কোলকাতা আপিস!’ নামটার একটা নয় দুইটা অর্থ তাদের নিজেদের মাঝে।

এক হল, এখানে মজা করে কেউ কেউ কোলকাতার টানে বাংলা বলে। আবার ফরিদা খালা নিজে বিহারী। উনার সাথে রুবেল ও মিথুন উর্দুতে কথা বলতে চেষ্টা করে ও গাল-গল্পে বিনা টিকেটে কোলকাতা ঘুরে আসে! তাদের এ অফিস (!) নিয়ে আবেগের কমতি নেই। একজন আর একজনকে কথার জালে আটকে দেয়। সবাই তখন মজা দেখে।

প্রেম বিষয়ক অনেক প্যাচাল চলে। একজনকে ফোনে কথা বলতে দেখলে অন্যরা পিছনে লাগে। এভাবেই সময় বয়ে যায়। তাদের কর্মকান্ড দেখে সামনের রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন ফিরে ফিরে তাকায়। হয়তো ভাবে, ‘পাগলের দল...!’ দোকানে অন্য খরিদ্দার এলে বেশিক্ষণ বসে না এদের জন্য।

ফরিদা খালাও তেমন কিছু বলে না কারণ এলাকাটা এরাই সরগরম করে রাখে। উনার সারাদিনে যা বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই এদের কাছে। এরা একদিন না এলে অন্যদিন এসে উনার মুখ থেকে গতদিন কম বিক্রি হওয়ার আক্ষেপ শোনে। *** খালার এই চায়ের দোকান নিজের মূলধনে নয় পুরোটা। একটি মাল্টি-পার্পাস ইকোনোমিক ডেভলপমেন্ট সোসাইটি থেকে অর্ধেক টাকা লোন করেছেন।

প্রতিদিন তাকে বিশটাকা করে শোধ দিতে হয়। এর জন্য একটা পরিশোধ বই আছে। ওটাকে সযত্নে পলিথিনে মুড়িয়ে রাখেন। একটি মহিলা রোজ এসে টাকা নিয়ে যান। তবে এই টাকা দিতেও খালার কষ্ট হয়।

নিরুপায় হয়ে দেন। প্রতিদিনের কাঁচামালের খরচ, কাঠ, তেল ইত্যাদি পরিশোধ করে দোকান বন্ধের সময় কত থাকে তা উনি মাঝে মাঝে বলেন। মুখে মুখে এটা ওটা হিসাব করেন। তবে তার হিসাবে প্রায়ই গড়মিল থাকে এবং চোঁখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরে তখন। সামিন ও তার বন্ধুরা অবাক হয়ে যায়।

জিজ্ঞাসা করে। আর একরাশ গালির সাথে আক্ষেপ শোনে। মাঝে মাঝে দোকানে খালার ভাই ‘বাবু’ বসেন। উনার গাজার নেশা। দোকানের ক্যাশ থেকে সময় সময় টাকা ঝেড়ে দেন।

খালা যখন এটা ধরে ফেলেন তখন শুরু হয়ে যায় ভাই বোনের মধ্যে উর্দুতে তুমুল ঝগড়া। সামিনরা অর্ধেক বোঝে আর বাকি অর্ধেক বোঝে না। ঝগড়া বেশি মাত্রার দিকে গেলে ওরা দাবড় লাগিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। অফিসের চারপাশে নানারকম ঘটনা ঘটে। পার্কে প্রেমিক প্রমিকারা আসে।

গল্প করে, ফুসকা খায়। তারা জুটির মান ও সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। গেটের অন্যপাশে একটু অন্ধকার। রাত দশটা-সাড়ে দশটার দিকে মাঝে মধ্যে দু-একটা পতিতা এসে দাড়িয়ে থাকে। কখনোবা তারা চা খেয়ে যায়।

একবারতো মতি ভাই একটি কমবয়সী মেয়েকে প্রশ্নের জালে জড়িয়ে নাজেহাল করে ছাড়লেন। উনি টিভি সাংবাদিক। এইসব ঘটনা বা বিষয় নিয়ে অনেক রিপোর্ট করেন। তার প্রশ্নের বানে পড়ে মেয়েটি শেষপর্যন্ত চা শেষ না করেই চলে গেল। এরপর থেকে ওকে আর দেখা যায়নি মাস দুয়েক।

সামনের রাস্তায় প্রায়ই এক্সিডেন্ট হয়। ওরাই দৌড়ে যায় সর্বপ্রথম। ধরাধরি করে পাশের ইসলামি ব্যাংক হসপিটালে নিয়ে যায়। পার্কের মধ্যে এক কোণায় নেশা খোরেরা আসে। গাজা বা ফেনসিডিল খেয়ে দ্রুত সটকে পড়ে।

দীর্ঘদিন এই জায়গায় আড্ডা দেওয়ার কারণে ওরা বুঝে গেছে কোন লোক এখানে কি করতে আসে। দেশের অধিকাংশ পার্কেই এই অবস্থা। পার্ক এখন আর মানুষের সৌন্দর্য বর্ধক বা নির্মল আনন্দে সময় কাটানোর জন্যে নয়। যেখানে পার্ক, সেখানেই কিছু নেশাগ্রস্থ লোক, সেখানেই কিছু পতিতা, সেখানেই চোর-ছিনতাইকারীর আনাগোনা। *** একদিন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব।

সামিন ডাকবাংলার দিক থেকে আসছিলো। দুপুর বেলা। তার মনে হল ভেজা শরীরে খালার দোকান থেকে এককাপ চা খেয়ে যায়। সেই মত এল। এসে দেখল বাইরে যেমন বৃষ্টি পড়ছে তেমনি খালার দু’চোখ বয়ে পানি ঝরছে।

সে বলল,‘ও...খালা...আজ আবার কি হল...?’ উনি তখন আবার কেঁদে দিয়ে বললেন, ‘ছয়শ টাকা চুরি হইছে...আমার কি কষ্টের টাকা...’ সামিন বলল, ‘বাবু মামা নেয়নি তো...?’ - ‘না আজকেতো ও আসে নাই...। ’ - ‘তাহলে...আজকেরটার কাহিনী কি...?’ খালা তখন চোঁখ মুছে বললেন, ‘আমি চা বানায় ঐ দোকানের বুড়োর কাছে দিতে গেলাম। তার আগে টাকা গুণে রাখলাম কৌটার মধ্যে। এসে দেখি টাকা নাই...। ’ উনি আবার কান্না শুরু করলেন।

সামিন পড়লো অস্বস্তিতে। লোকজন কান্না শুনে তাকাচ্ছে এদিকে। একজন পৌঢ়া মহিলা কাঁদছে রাস্তায় আর সে বসে আছে কাছে, এটা যেন দেখতে কেমন! তাই বলল, ‘খালা কান্না-কাটি করে লাভ নেই। তুমি ভালো করে খোঁজো। আর একটু চোখ কান খোলা রাখ।

আশে পাশের কেউ একজন হয়তো এটা করেছে। তক্কে ছিল... বুঝলে...’ উনি আর একবার উনার কাঠের বাক্সটা খুঁজে বললেন, ‘তুমরা আইজ এই নিয়ে একটা বিহিত করবা। একটু খেয়াল করলেই ধরা যাবে। রুবেল ভাগ্নে আসলি তুমি বলবা...। ’ সামিন বলল, ‘আচ্ছা...এখন এককাপ চা দাও...ভেজা গা তো শুকায় গেল...।

’ ‘বস...দিচ্ছি...। ’ সামিন তখন একটু ভেবে বলল, ‘আজতো আর কিস্তি দিতে পারবা না। মহিলা আসলে তখন তো আবার ঝগড়া লাগাবা...। ’ উনি চায়ে চিনি দিতে দিতে বললেন, ‘কি করে দেব...মাগী আসলেই হা করে থাকে...। ’ - ‘আচ্ছা আজকের কিস্তি আমি দিয়ে দেব কিন্তু এই শেষ।

তোমার টাকা ডেইলি চুরি যাবে আর আমরা কিস্তি দেব...তা হবেনা...’ ফরিদা খালার মুখে এবার একটু হাসি ফুটলো। উনি তখন চায়ের সাথে একটা নোনতা বিস্কুট দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা...আচ্ছা...তুমি ভাগ্নে সবার থেকে এট্টু আলাদা...। ’ সামিন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘এইতো শুরু করলে...তোমার ভাগ্নেরা সবাই ভাল। আমাকে বেশি ফুলাবা না। তুমি এর দোষ তার, তার দোষ এর কাছে বল...।

’ উনি তখন চোঁখ বুজে একটু গম্ভীর করে বললেন, ‘কোই...না ভাগ্নে... এমন করিনাতো, আমার মিথুন ভাগ্নে, ইমরান ভাগ্নে, রুবেল ভাগ্নে, সুমন ভাগ্নে সবাই তো বহুত আচ্ছা...। ’ - ‘হু বুঝলাম...। ’ চা দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। দাম মিটিয়ে আরো এক্সট্রা বিশ টাকা কিস্তি বাবদ দিয়ে বাসার পথ ধরল সে। ঐ দিন ঘটনা ক্রমে তারা কেউই কোলকাতা আপিসের আড্ডায় যেতে পারল না।

পরদিন গিয়ে দেখল পার্কের গায়ে কোন চায়ের দোকানই নেই। মাটির চুলা ভাঙ্গা। কাঠের বাক্স পার্কের মধ্যে পড়ে আছে। খোঁজ নিতেই পাশের এক লোক বললেন, ‘আজ দুপুরে সিটি কর্পোরেশনের লোকজন এসে সব চায়ের দোকান উঠায়ে দেছে ফুটপাত থেকে। ’ অগত্যা তারা সাতরাস্তার মোড়ে চলে এল।

ঐ দিনেই ফরিদা খালার চায়ের দোকানের চির সমাপ্তি ঘটলো। এবং একই সাথে কোলকাতা আপিসেরও! শাশ্বত ২০.০৭.১৩

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.