আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হ ম এরশাদের শাসনামল - ৬

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

হ ম এরশাদের শাসনামল - ৬ ---------------------- ডঃ রমিত আজাদ (পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে) কর্ণেল হামিদ তার বইয়ে লিখেছেন, "এরশাদ ছিলেন একজন দুর্বল সামরিক অফিসার। তিনি ১৯৫২ সালে কোহাট অফিসার্স ট্রেনিং স্কুল থেকে প্রথমে অনিয়মিত অফিসার হিসাবে নিয়োগ পান, অনেক পরে নিয়মিত হন। " আমাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনী কর্মকর্তা বলেছিলেন, "এরশাদের গলফ খেলার স্টাইল দেখলেই বোঝা যায় যে, তিনি নিয়মিত অফিসার হিসাবে সরাসরি যোগ দেননি। " ১৯৭১ সালে এরশাদের ভূমিকা রহস্যজনক। কোন কোন সূত্র মতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তিনি বাংলাদেশে ছুটি কাটাচ্ছিলেন (পোস্টেড ছিলেন পাকিস্তানে), মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে, দ্রুত পাকিস্তানে চলে যান এবং সপ্তম ইষ্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে পুনরায় কাজে যোগদান করেন ।

আবার কোন কোন সূত্রমতে তিনি সে সময় পাকিস্তানেই ছিলেন। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসুস্থ পিতা মোহাম্মদ মকবুল হোসেনকে দেখার জন্য সেপ্টেম্বরে এরশাদ পুনরায় রংপুর এসেছিলেন অসুস্থ পিতাকে দেখে আবার পাকিস্তানে ফিরে যান । অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ও সুযোগ থাকা সত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি, এটা নিশ্চিত। উপরন্তু পাকিস্তানে যে সকল বাঙালী অফিসার ও সৈন্যরা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো তাদের বিচারের জন্য একটি ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছিলো, এরশাদ সেই ট্রাইবুনালের প্রধান ছিলেন। এই সব তথ্য থেকে এটাই স্পস্ট হয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এরশাদের কোন সমর্থন ছিলোনা।

১৯৮২ সালে এরশাদ যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন তিনি একা ছিলেন না। একা কারো পক্ষেই কিছু করা সম্ভব না। নিঃসন্দেহে তার সমর্থনে কিছু লোকজন ছিলো, তারা কারা? বেসামরিক লোকদের কথা পরে লিখবো, সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে তার অনুগত সিনিয়র অফিসাররা ছিলেো মূলতঃ অমুক্তিযোদ্ধা । এরশাদ সমর্থ হয় এই অমুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের ঐক্যবদ্ধ করে তার পতাকাতলে নিয়ে আসতে। জেনারেল এরশাদের অনুগত অফিসার ছিলেন জেনারেল আতিক পরবর্তিতে সেনা-প্রধান একজন অমুক্তিযোদ্ধা, জেনারেল নূরুদ্দিন পরবর্তিতে সেনা-প্রধান তিনিও একজন অমুক্তিযোদ্ধা।

গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে এরশাদের সময় তার অনুগত অমুক্তিযোদ্ধা সেনা-কর্মকর্তাদের প্রাধান্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেনাবাহিনীতে চেইন অফ কমান্ড থাকে খুব শক্ত তাই সেখানে জুনিয়র অফিসারদের তেমন কোন ভয়েস থাকেনা। মত প্রকাশ না করে হুকুম পালন করাটাই তাদের দায়িত্বশীলতার মধ্যে পড়ে। আর সাধারণ সৈনিকরা তো পুরোদস্তর রোবট হূকুম তামিল করাটাই তাদের পেশাগত কর্তব্য। তাই সেদিন এরশাদের ক্ষমতা দখলে জুনিয়র অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের কোন ভূমিকা ছিলোনা।

১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ ক্ষমতা দখলের দুই বা তিনদিন পরে সেনাবাহিনীর সদর দফতরের অভ্যন্তরে অবস্থিত কনফারেন্স রূমে সেনাসদরের সকল অফিসারদের একটি সভা ডাকা হয়। ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ও অফিসার কমান্ডিংগণকেও এই সভায় ডাকা হয়। জেনারেল এরশাদ সকলের সামনে ক্ষমতা গ্রহনের পরিপ্রেক্ষিত, তার উপর আরোপিত পরিস্থিতিগত বাধ্যবাধকতা ও ইমিডিয়েট ফিউচার-এর কর্মপন্থা সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন যে, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ, মারামারি কাটাকাটিতে জনজীবন বিপর্যস্ত, ................, গণতন্ত্র হুমকীর সম্মুখীন হয়েছে এবং সার্বিকভাবে দেশের অবস্থা ডাউন হিল। তিনি আরো বলেন যে, প্রেসিডেন্ট সাত্তার তাকে ডেকে দায়িত্ব নেয়ার জন্য বলেছেন; তিনি দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়েছেন, তিনি এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী ছিলেন না, কাউকে না পেয়ে প্রেসিডেন্ট তাকেই দায়িত্ব দিয়েছেন।

এই বক্তব্য রাখার সময় এরশাদের সামনে একটি ছোট আকারের টেবিলে একটি পবিত্র কোরান শরীফ রাখা ছিলো। তিনি বলেন অনেকটা এরকম, "আল্লাহ্‌ স্বাক্ষী আমি ক্ষমতালোভী নই; আপনাদের মধ্যে কেউ যদি চান তাহলে আমার চেয়ারে বসে দায়িত্ব পালন করেন; আমাকে মুক্তি দেন। আপনারা কেউ যদি দায়িত্ব না নেন তাহলে আমাকে সাহায্য করুন, সহযোগিতা করুন, যেভাবে প্রয়োজন অন্তত পরামর্শ দিয়ে হলেও। আপনাদের কোন কিছু বলার থাকলে এখন বলেন। " এদিকে দেশের সাধারণ জনগণ ঘুণাক্ষরেও টের পেলনা কি অঘটন ঘটে গিয়েছে।

সামরিক উর্দি পরিহিত বলিষ্ঠ জেনারেলের আগমনে তাদের মনে হয়েছিলো, এবার বোধ চোর-চোট্টারা শায়েস্তা হবে। প্রথিতযশা সাংবাদিক ফজলে লোহানীও বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'যদি কিছু মনে না করেন'-এ তিনি কৌতুক দেখালেন চোর-চোট্টারা কেঁদে-কেটে গান গাইছে, "ঠগবাজী করে এখন ভেবে ভেবে মরেছি"। এমনকি আজীবন বাক স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সংগ্রামী ফজলে লোহানী এরশাদের জনদলেও যোগ দিয়েছিলেন। অবশ্য পরবর্তিতে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি প্রতারিত হয়েছিলেন।

একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা (যতদূর মনে পড়ে পত্রিকাটির নাম ছিলো সন্ধানী ) প্রচ্ছদ কাহিনী করেছিলো, 'বছরের আলোচিত চরিত্র হুসেইন মোহম্মদ এরশাদ'। 'দৈনিক বাংলার বাণী' সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলো। টেলিভিশনের এক সাক্ষাৎকারে এরশাদ বলেছিলেন যে, তিনি দেশের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এসেছেন, সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে এলে আবার ব্যারাকে ফিরে যাবেন। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, "আপনারা কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন?" উত্তরে এরশাদ বলেছিলেন, "আনুমানিক দু'বছর"। এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর দেশের কাজ ফেলে রেখে তার ক্ষমতার দাপট দেখাতেই বেশী ব্যস্ত ছিলেন।

এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিশোধ পরায়নও হয়ে ওঠেন। একটা ছোট্ট ঘটনা শেয়ার করছি। ১৯৮২ সালে সিলেট ক্যাডেট কলেজে-র অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক বাকিয়াতুল্লাহ্‌। সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান রাজকীয় চেহারার অধিকারী বাকিয়াতুল্লাহ্‌ স্যারের আদর্শ শিক্ষক হিসাবে খ্যাতি ছিলো। কলেজের অধ্যক্ষ-র রূমে চেয়ার আলো করে তিনি বসতেন।

শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী সকলের কাছেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও জনপ্রিয়। বাৎসল্য প্রেমী এই শিক্ষক ক্যাডেটদের জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। শোনা যায় অতীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় একবার জেনারেল এরশাদের সাথে তার কনফ্লিক্ট হয়েছিলো। তখন কিছু করতে না পারলেও এরশাদ সেটা মনে রেখেছিলো, সিএমএলএ হওয়ার পর এরশাদ হয়ে উঠলো বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, পুরণো ক্ষত তার মনে পড়লো। নজর গেলো অধ্যাপক বাকিয়াতুল্লাহ্‌-র দিকে।

একদিন কলেজ পরিদর্শনে গেলেন পদস্থ এক সরকারী কর্মকর্তা (খুব সম্ভবত ডিফেন্স সেক্রেটারী), পরিদর্শনে গিয়ে বাকিয়াতুল্লাহ্‌ স্যারকে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, 'আপনার চাকরী শেষ'। শ্রুতি রয়েছে নির্দেশটা এসেছিলো সিএমএলএ-র কাছ থেকে। ক্যাডেটদের কাছ থেকে নেয়া বিদায় অনুষ্ঠানে বাকিয়াতুল্লাহ্‌ স্যার কেঁদে ফেলেছিলেন। দেশের দৈন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় যেখানে আদর্শ শিক্ষকদের মূল্যায়ণ করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করা দরকার, সেখানে তাকে আরো দুর্বল করা হলো। এরশাদের এই ক্ষমতা দখলে কেউ কেউ বুঝে অথবা না বুঝে উল্লসিত হলেও রাজনৈতিক দল বিএনপি খুশী হওয়া তো দূরের কথা বরং ক্ষিপ্ত হয়েছিলো।

কারণটা স্বাভাবিক এরশাদ কর্তৃক তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলো। এদিকে বিএনপি-র যে অংশটি এরশাদকে ক্ষমতা দখলে সহযোগিতা করেছিলো তারা রাতারাতি এরশাদের মন্ত্রী-উপদেষ্টা বনে যায়। অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকেও কিছু মন্ত্রী-উপদেষ্টা হয়ে তাকে উপদেশ দিতে থাকেন। সেইসব উপদেশে দেশের ভালো না হয়ে মন্দ হতে থাকলে, বাংলাদেশের বরাবরের সচেতন ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কাউন্টার ফোর্স দেশের ছাত্র সমাজ এরশাদের বিরুদ্ধে নড়াচড়া করতে শুরু করে। আঠারো দফা দিলেই এরশাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান সিরাজুর রহমান তার 'শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একটি প্রেক্ষিত মূল্যায়ন' (07 November 2013, Thursday) শিরোনামের আর্টিকেলে লিখেছেনঃ 'বাংলাদেশ ও ভারতে রানী এলেজাবেথের রাষ্ট্রীয় সফরে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের সাথে আমিও ছিলাম। ১৪ নভেম্বর (১৯৮৩) আমরা ঢাকা পৌঁছি। কথা ছিল পরদিন আমি রানীর স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সাথে শ্রীমঙ্গল যাব। কিন্তু অতি ভোরে জনৈক ক্যাপ্টেন হায়দার শেরাটন হোটেলে এসে আমার ঘুম ভাঙালেন। তিনি বললেন, মাননীয় রাষ্ট্রপতি আমাকে প্রাতঃরাশের নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন, এখনি আমাকে তৈরি হয়ে তার সাথে যেতে হবে।

কর্নফ্লেকস থেকে পরোটা আর ভাজা কিডনি পর্যন্ত বহু পর্বের প্রাতঃরাশ খেতে খেতে জেনারেল এরশাদ আমাকে তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের একটা বর্ণনা দিলেন। তারপর তিনি বলেন যে, প্রধান দু’টি দলের নেত্রীদের কেউ যদি একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য তাকে মনোনয়ন না দেন তাহলে তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে বাধ্য হবেন। নেত্রীদের মতামত যাচাইয়ের দায়িত্ব তিনি চাপিয়ে দিলেন আমার ওপর। ' এরশাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ও স্বৈরাচারী মনোভাব সম্পুর্ণরূপে প্রকাশিত হয়ে গেলে, স্বৈরাচার এরশাদ সরকারকে হটিয়ে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৪টি ছাত্র সংগঠন নিয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ২১ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়।

শুরু হয় এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অন্যদিকে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর জোট ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দল, গঠিত হয় '৮৩ সালের ৩১ জানুয়ার ও বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল নামে আরেকটি জোট গঠিত হয় । ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। ১৪ ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে ছাত্রদের মিছিল বেরোলে ঘটে ভয়াবহ ঘটনা। (চলবে) (আমি আর্টিকেলটি লেখার সময় যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি তা ত্রুটিমুক্ত রাখতে, তারপরেও কোন ত্রুটি বা তথ্যগত কোন ভুল থাকলে তা অনিচ্ছাকৃত, ভুলটি আমাকে জানাবেন, আমি তা সংশোধন করে নেব।

)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।