আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বনন্দিত ম্যান্ডেলার বিদায়

নিভে গেল ইতিহাসের এক আলোকবর্তিকা। বিশ্ববাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে অনন্তের পথে চলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। ফুসফুসের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতি টেনে মুছে দিলেন জীবনের বর্ণিল রেখা। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাসে কিংবদন্তি দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বৃহস্পতিবার জোহানেসবার্গে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিশ্বনন্দিত ম্যান্ডেলার চিরপ্রস্থানের খবর দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা।

এ খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে বিশ্বের আনাচ-কানাচ। শোক প্রকাশ করেন বিশ্ব নেতারা। মৃত্যুর সময় জোহানেসবার্গের হাউটন শহরতলিতে নিজ বাড়িতে বিশেষ ব্যবস্থায় নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন ৯৫ বছর বয়সী ম্যান্ডেলা। ফুসফুসে সংক্রমণজনিত অসুস্থতার কারণে প্রিটোরিয়ার মেডিক্লিনিক হাসপাতালে প্রায় তিন মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ১ সেপ্টেম্বর বাসায় ফেরেন তিনি। আগামী ১৫ ডিসেম্বর তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে।

জাতির জনক খ্যাত ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগ করেন তিনি। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ ম্যান্ডেলা তার সেই ২৭ বছরের কারাজীবন থেকে বেরিয়ে বর্ণবাদে বিভক্ত রক্তাক্ত দেশটিকে দেখিয়েছিলেন গণতন্ত্রের পথ। ৯৫ বছরের জীবন তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সেই সংগ্রামের পথেই।

বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দক্ষিণ আফ্রিকার শোকাহত প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা বলেন, 'প্রিয় দেশবাসী, আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, দক্ষিণ আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ সন্তান, আমাদের সবার প্রিয় নেলসন রোহলিহলা ম্যান্ডেলা চলে গেছেন। নিজ বাড়িতেই শান্তিপূর্ণভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন তিনি। ' একই ভাষণে তিনি জানান, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্মানে অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ববরেণ্য এই নেতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। এ সময় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেন তিনি। ২৭ বছরের কারাজীবন থেকে বেরিয়ে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে (এএনসি) সংগঠিত করেন নতুন করে।

বহুবিধ সংকট-সন্ত্রাস-আক্রমণ-বিপদের খাদ পেরিয়ে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর শ্বেতাঙ্গদের দল ও উগ্র অশ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে তিনি গঠন করেন জাতীয় ঐকমত্যের গণতান্ত্রিক সরকার। একই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম অশ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে গ্রহণ করেন শাসনভার। বিশ্বের বুকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটি সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন দ্রুততম সময়ে। এরপর মাত্র এক মেয়াদ সম্পন্ন করে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে বিদায় নেন নেলসন ম্যান্ডেলা। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এই স্বল্প সময় দায়িত্ব পালন করে দেশটির চরম বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থাকে তিনি উন্নীত করেন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়, যাতে প্রতিফলন ঘটে তার অসাধারণ প্রজ্ঞা আর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার।

উন্মুক্ত করেন 'এক নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা' গড়ে তোলার পথ।

বর্ণবাদবিরোধী রাজনীতিতে ম্যান্ডেলা সক্রিয় হয়েছিলেন কলেজে অধ্যয়নকালেই। সেই থেকে জীবনের এক পর্ব থেকে অন্য পর্ব কেটেছে তার জেল-জুলুম, সংগ্রাম আর সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতির পেছনে। জীবনের এক বাঁকে ২৭ বছর তাকে কারাভোগ করতে হয় রোবেন দ্বীপের কারাগারসহ বিভিন্ন কারাগারে। নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় এক রাষ্ট্রনেতা, যিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে।

তিনি ছিলেন একজন স্নেহময় পিতা, একজন প্রেমিক স্বামী, একজন পরোপকারী বন্ধু_ সর্বোপরি একজন অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। ২০০৪ সালে ৮৫ বছর বয়সে সব ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন ম্যান্ডেলা। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাবেন জানিয়ে তিনি ওই সময় বলেন, 'আমাকে ডেকো না। আমিই তোমাদের ডাকব। ' এরপর কেটে যায় বেশ কিছু সময়।

২০১১ সালের জানুয়ারিতে জোহানেসবার্গের একটি হাসপাতালে ভর্তির পর প্রেসিডেন্ট দফতর থেকে জানানো হয়, অনেক দিন আগেই ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে এই বিশ্বনেতার। এরপর আর খুব বেশি সুস্থতা বোধ করেননি। গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে যেতে হয় তাকে। ২০১২ সালের শুরুর দিকে ম্যান্ডেলা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে জানানো হয়, পাকস্থলীর সমস্যায় ভুগছেন তিনি। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফুসফুস সংক্রমণে বারবার চিকিৎসা নিতে হয় তাকে।

আশির দশকে রোবেন দ্বীপে বন্দী থাকার সময় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্ট কেপটাউনের ছোট্ট এক গ্রামে যোসা ভাষাভাষী ম্যাটেম্বু গোত্রে। নিজের গোত্র থেকে পাওয়া 'মাদিবা' নামেও দেশবাসীর কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। রোলিহ্লাহ্লা ডালিবুঙ্গা নামের কালো শিশুটি নেলসন ম্যান্ডেলা নামটি পান এক স্কুলশিক্ষকের কাছ থেকে। আর এ নামেই বরেণ্য হন তিনি।

বাবা ছিলেন ম্যাটেম্বু গোত্রের 'অভিজাত' পরিবারের পরামর্শক। তিনি যখন মারা যান, ম্যান্ডেলার বয়স তখন নয় বছর। এরপর গোত্রপ্রধানের তত্ত্বাবধানেই বেড়ে উঠতে থাকেন ম্যান্ডেলা। ১৯৪১ সালে যখন ২৩ বছরের টগবগে যুবক, আয়োজন হয় বিয়ের। কিন্তু বিপ্লবী-মন কি কখনো সংসার বোঝে! সংসারে বাঁধা পড়ার কোনো রকম ইচ্ছা ছিল না বলে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে চলে যান জোহানেসবার্গে।

পালিয়ে কাটে দুই বছর। এরপর উইটসওয়াটারান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন আইন বিভাগে। সেখানেই তিনি দেখতে পান বর্ণবাদ ও বৈষম্যের রূপ আসলে কতটা ভয়াবহ।

ভবিষ্যতের বিশ্বনেতা ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের শুরু ওই সময় থেকেই। ওই বছরই তিনি যোগ দেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি)।

গড়ে তোলেন তরুণ শাখা 'এএনসি ইয়ুথ লিগ'। ১৯৪৪ সালে এভেলিন মাসের সঙ্গে বিয়ে হয় ম্যান্ডেলার। চার সন্তান জন্মের পর ১৯৫৮ সালে বিচ্ছেদ ঘটে তাদের। এরই মধ্যে আইনজীবী সনদ পান ম্যান্ডেলা। ১৯৫২ সালে জোহানেসবার্গে অলিভার ট্যাম্বোর সঙ্গে যোগ দেন আইন পেশায়।

দক্ষিণ আফ্রিকার শাসনক্ষমতায় তখন সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের দল ন্যাশনাল পার্টি। ক্ষমতাসীনদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সোচ্চার হন ম্যান্ডেলা। আইনি লড়াই চালিয়ে যান বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। ১৯৫৬ সালে প্রথম মামলা হয় ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে। আরও ১৫৫ জনের সঙ্গে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় দেশদ্রোহের।

তবে চার বছর পর মামলার রায়ে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান ম্যান্ডেলা। ওই রায়ের পর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন নতুন গতি পায়। বিশেষ করে নতুন আইনে কালোদের বাসস্থান ও কাজ নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ। এরই মধ্যে ১৯৫৮ সালে উইনি মাদিকিজেলাকে বিয়ে করেন ম্যান্ডেলা। ১৯৬০ সালে এএনসি নিষিদ্ধ করার পর আত্দগোপনে চলে যান তিনি।

একই বছর পুলিশের গুলিতে ৬৯ জন কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হওয়ার পর তীব্রতর হয় সরকারবিরোধী ক্ষোভ। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে সরে আসে এএনসি। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে হামলার সিদ্ধান্ত নেন দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলা। এরপর গ্রেফতার হন ম্যান্ডেলা, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে হামলা ও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। মামলার শুনানিতে রিভোনিয়ার আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমতার দাবি তোলেন ম্যান্ডেলা।

বলেন, 'আমি একটি গণতান্ত্রিক ও ?মুক্ত সমাজের স্বপ্ন লালন করি, যেখানে সবাই সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করবে সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। এটিই আমার আদর্শ। এটিই আমি অর্জন করতে চাই। এর জন্য প্রয়োজন হলে মরতেও প্রস্তুত আমি। '

১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করে সরকার।

১৯৬৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ম্যান্ডেলার। ১৯৬৮-৬৯ সালের মধ্যে ১২ মাসের ব্যবধানে মৃত্যু হয় মা ও বড় ছেলের। তাদের শেষকৃত্যে উপস্থিত হওয়ারও সুযোগ মেলেনি তার। ১৯৮২ সালে পোলসমুর কারাগারে নেওয়ার আগে রোবেন দ্বীপে বন্দীজীবন কাটাতে হয় যৌবনের ১৮টি বছর। টানা ২৭ বছর বর্ণবাদী সরকারের কারাগারে বন্দী থাকতে হয় তাকে।

ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে ভয়াবহ রূপ নেয় আন্দোলন।

১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এফ ডবি্লউ ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ বর্ণবাদবিরোধী সংগঠনগুলোর ওপর থেকে তুলে নেন নিষেধাজ্ঞা। আসে শুভক্ষণ। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি।

দীর্ঘ ২৭ বছরের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসেন বিশ্ব ইতিহাসের এই মহানায়ক।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.