আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জোশি প্রেমঃ দশক ৯০

আমার খুব কষ্ট হয়, যখন RAJAKAR বানানটা বাংলা বর্ণমালায় লিখা হয়। এটা বর্ণমালার জন্য অপমান।

মুখবন্ধঃ জানিনা কেন, প্রেম শব্দটাকে সবসময় একটা নিষিদ্ধ শব্দ হিসেবে দেখা হতো সবসময়। ইদানিং এর পরিধি বাড়লেও অপবাদ ঘোচেনি। ছেলেবেলায় মফস্বলে ছিলাম, সেখানে ২০ বছর আগেও প্রেমকে যে দৃষ্টিতে দেখা হতো, এখনো তার চেয়ে ভালো কিছু দেখা হয় না।

হয়তো, পরিণতি মেনে নেবার ক্ষেত্রে বাবা-মা আগের চেয়ে উদার হয়েছেন-যা বিশ বছর আগে প্রায় অসম্ভব ছিলো। তবে সে সময় প্রেমের তীব্রতা ছিলো অনেক যা মানুষকে দুঃসাহসী করে তুলতো। বিশ্বস্ত পত্রবাহক হবার সুবাদে মফস্বলের ১৯৯০ পরবর্তী কয়েক বছরের প্রেমের প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে পরিণতি পর্যন্ত খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ/দুর্যোগ হয়েছে। সেখান থেকেই পরিচিত আশেপাশের মানুষ থেকে দেখা (নিজের নয় মোটেই) প্রেমের কিছু অভিজ্ঞতার কথা সবার সাথে ভাগাভাগি করছি। তখন চিঠিই ছিলো প্রেমের ক্ষেত্রে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা।

কারো কারো বাসায় ল্যাণ্ড ফোন ছিলো, কিন্তু পরিবারের সবার চোখ-কান এড়িয়ে দু’চারটে প্রেমের কথা বলাটা ছিলো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলার সামিল। হয়তো মাসে-দু-মাসে এক দুবার হাত ধরার সুযোগ পেতো তারা। দেখা করা বলতে বুঝাতো স্কুলে যাবার পথে চোখা-চোখি, একটু হাসি বিনিময়। একটা ছেলে একটা মেয়ে রাস্তায় কথা বলতে বলতে পাঁচ মিনিট হেঁটেছে তো মরেছে! মুরুব্বিদের বক্রদৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বন্ধু কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী, গাছ খোদাই করে, ক্লাসের দেয়ালে, ব্ল্যাক বোর্ডে-লিখে রাখতো ‘অমুক+তমুক’। লেখাটা থাকতো একটা হার্ট সাইনের ভেতর-যে হার্টে তীর লেগে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যেতো এবং অবশ্যম্ভাবী ভাবে তীরের ভাঙ্গা সুঁচালো মাথা থেকে টপ টপ করে রক্ত পড়তো।

হয়তো যারা একসাথে পাঁচ মিনিট হেঁটেছিলো, তাদের প্রেমের কোন উদ্দেশ্য ছিলো না, তবে ওই দুই নামের সমীকরণ তাদের সম্পর্ককে তীব্রতায় নিয়ে যেতো। মানে, হয় প্রেম, অথবা চিরকালীন বৈরীতা। এমনও দেখেছি, হয়তো বন্ধুরা দুষ্টামি করে কারো সাথে কারো নাম জুড়ে দিয়েছে, এই অপরাধে মেয়েটির জীবন থেকে প্রপোজাল নামক শব্দটা হারিয়ে গেছে। কারণ, অমুক কে তো অমুকে পছন্দ করে, ওদিকে তাকানো যাবেনা, বরং অন্যখানে চেষ্টা করি-ব্যাপারটা এমন। একসাথে দু’তিন প্রেম করছে, এমনটাও যে কম ঘটেনি তা নয়।

ছোট বোন প্রেমে ধরা পড়েছে বলে বড় ভাই তাকে টেনে হিঁচড়ে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে-এটা ছিলো সবচেয়ে দুঃখজনক দৃশ্য। এরকম কয়েকটা প্রেমের পত্রবাহক ছিলাম আমি। পত্রদাতা-দাত্রীরা অনেকেই এখন নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁদের কয়েক জন আমার লিখা নিয়মিত পড়েন বলে নাম গুলো সজ্ঞানে এড়িয়ে গেলাম। চিঠি আদান প্রদান করার সবচেয়ে নিরাপদ সময় ছিলো দুপুর তিনটা থেকে সাড়ে চারটার ভেতর আর মাগরেবের আজানের ঠিক পর পর। কাভার হিসেবে ব্যবহার করা হতো বইয়ের মলাট কিংবা সেবা প্রকাশনীর বই।

হাতে বই নিয়ে আপুদের বাসার সামনে দিয়ে কয়েকবার যাতায়াত করতাম, আপুরাও তক্কে তক্কে থাকতো। একসময় হাতের বই দেখে জিগ্যেস করতো, ‘এটা কি বই? দে আমি পড়বো’। তারপর একটা সাজানো লোকদেখানো জোরাজুরি, এরই ফাঁকে বইয়ের ভেতর থেকে চিঠি উদ্ধার করে জামার গলার নিচ দিয়ে নিরাপদ জায়গায় চালান করে দেয়া, আমার পকেটে চকলেট আর আগের চিঠির জবাব গুঁজে দেয়া এবং বই না দেবার অপরাধে অভিশম্পাত; অভ্যস্ত হাতে এসব কিছু ঘটে যেতে ৩০ সেকেণ্ডের বেশি লাগতো না। মাঝে মাঝে জড়িয়ে ধরে চুমুও দিতো! (প্রিয় পাঠক, চোখ বড় বড় করার কোন কারণ নেই। ১১-১২ বছরের একটা বালকের কাছে তখন এই চুমু আর মা-বাবার চুমু’র কোন তফাৎ ছিলো না)।

সেই চিঠি আর বই ভাইয়াসকলের কাছে পৌঁছে দিয়ে একটাকা-দু’টাকা কপালে জুটতো। লে হালুয়া! ভাইয়াদেরকে দেখতাম চিঠি জমাতো পলিথিনে মুড়ে ভেন্টিলেটরের ফাঁকে কিংবা ঘরের সিলিং এর ফাঁকে। আপুরা বইয়ের ভাঁজে। একবার মন ভালো থাকায় এক ভাইয়া, আপুর লিখা চিঠি পড়তে দিয়েছিলো। চিঠি ভর্তি লিপিস্টিক দেয়া ঠোঁটের সিল লাগানো।

আহা! জোশি প্রেম! তাঁদের প্রেমের সময় কেমন কাটছে-তা বোঝা যেতো চিঠিতে কালির ব্যবহার দেখে। সাধারণত দেখতাম, বেশিরভাগ প্রেমিক প্রেমিকারাই নীল কালি ব্যবহার করতো। রোল টানা কাগজ, লুকিয়ে লেখার কারণে বাক্য বিন্যাসে গোলমাল এবং প্রচুর বানান ভুল। কখনো কখনো কাগজের গায়ে সুগন্ধী মাখানো থাকতো কিংবা লালগোলাপের পাপড়ি; ময়ূরের পালক। চিঠি গুলিতে বক্তব্যের চেয়েও বেশি থাকতো ‘পুনশ্চ’ ‘বিঃদ্রঃ’।

সম্পর্কে যখন টানাপোড়েন চলছে, তখন কালির বদলে ব্যবহার করা হতো রক্ত। না, আমার পরিচিত কাউকে নকল রক্ত ব্যবহার করতে দেখিনি। হাতে ব্লেড দিয়ে কেটে সেখান থেকে টাটকা রক্ত নেয়া হতো। এসিড পাতা নামে একটা পাতা পাওয়া যেতো, যার রস দিয়ে হাতে কারো নাম লিখলে সেখানে চামড়া পুড়ে নাম খোদাই হয়ে যেতো। এবং বেশিরভাগ ছেলেদের প্রেম ধরা পড়তো ওই কাটা দাগ আর এসিড পাতার খোদাই দেখে।

মেয়েদের চিঠি জমানোটাই বিপদ ডেকে আনতো। হয়তো বইয়ের ফাঁক থেকে পড়ে যাওয়া কোন চিঠি কাল হয়ে দাঁড়াতো! এক্ষেত্রে গার্ডিয়ানের হস্তক্ষেপে ‘আর কোনদিন ওর সাথে দেখা করবো না’ জাতীয় প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে অনেকের সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটতো। আর দুঃসাহসী যারা, তারা আবার নতুন উদ্যোমে শুরু করতো। আমার পরিচিত এক জোড়া প্রেমিক প্রেমিকাকে দেখেছিলাম চিঠি লিখার জন্য নিজেদের তৈরি অক্ষর ব্যবহার করতে। অনেকটা চাইনিজ অক্ষরের আদলে লিখা তাদের চিঠির মর্মোদ্ধার করা কারো পক্ষে সম্ভব ছিলো না, কারণ সে অক্ষর কেবল তারা দুজনেই চিনতো।

আমাকে চেনানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো, কিন্তু দু’তিনটা অক্ষর দেখেই রণে ভঙ্গ দিয়েছিলাম। নিজেদের গোপন করার জন্য অদ্ভুত বুদ্ধিবৃত্তি এনে দিয়েছিলো প্রেম! সে সময়গুলোতে সম্পর্কের চুড়ান্ত মিলন ছিলো জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া পর্যন্ত। তার চেয়ে বেশি সাহস খুব কম মানুষের ছিলো। দু-এক জন অবশ্য দাবি করতো যে তারা সেক্স করেছে, কিন্তু চাপাবাজি কিংবা গোপনীয়তা-যে কোন কারণেই হোক, তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি। হ্যাঁ আমাদের অতি সাহসী ৯০ এর দশকের প্রেমিকারা গভীর রাতে বের হতে ভয় পেতো না, কারণ প্রেমিকের হাতের তৃষিত স্পর্শ রাতের ভীতির চেয়েও বেশি নির্ভরতার ছিলো।

আমি যাদের দেখেছি, দু-একজন বাদে বাকীদের প্রেমে কোন খাদ ছিলো না। অনেককেই দেখেছি সম্পর্ক ছিন্ন হবার কারণে হাপুশ হয়ে কাঁদতে! কেউ কেউ পরিবারের সবার অগোচরে ভাত ফেলে দিতো উপোষ করবে বলে। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে কেউ কেউ। এক দুঃসাহসী আপু তার জামার হাতা একটুখানি তুলে দেখিয়েছিলো ব্লেড দিয়ে কেটে লিখা তার প্রেমিকের নাম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রেম টিন এজ পার হতো না, কিন্তু যতদিনই সম্পর্ক টিকে থাকতো, নির্ভেজাল প্রেম দেখেছি-ভণিতা দেখিনি।

তারপর একসময় হয়তো বাবার বদলি কিংবা মেয়ের পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে, পরিণতি হতো প্রেমের। ছেলে-মেয়ের হাতের কাটাদাগ কিংবা এসিড পাতার খোদাই ধীরে ধীরে মুছে যেতো; ভেন্টিলেটরে রাখা চিঠির বান্ডিলে বাসা বাঁধতো চড়ুই। তারপর এলো ডিশ এন্টেনা। তারপর মোবাইল। তারপর ইন্টারনেট।

তারপর... ============================= ছবিঃ সংগৃহীত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.