আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুপ্রিমকোর্টের জানাজা পড়তে দেওয়া যায় না

রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ বিচার বিভাগের পবিত্র ভূমি সুপ্রিম কোর্ট আঙিনা আজ নষ্ট বিভক্ত রাজনীতির আগ্রাসনে কলঙ্কিত হচ্ছে। জঘন্য দলবাজির ঊধের্্ব থাকা আইন পেশার সঙ্গে জড়িত কালো কোট পরা নাগরিকদের সঙ্গে গোটা বাংলাদেশ এতে স্তম্ভিত এবং বিক্ষুব্ধ। মানুষের আশ্রয়ের শেষ স্থল সুপ্রিম কোর্ট আঙিনায় দুই দিন ধরে যা ঘটছে তা মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। ন্যায়বিচারের প্রতীক সংবিধানের গার্ডিয়ান সুপ্রিমকোর্ট আঙিনায় গতকাল সিনিয়র আইনজীবী এ কে এম নজরুল ইসলামের জানাজায় সতীর্থরা ভারাক্রান্ত মনে উপস্থিত হয়েছিলেন। স্বজন হারানোর বেদনায় ব্যথিত আইনজীবীদের হৃদয় ভেঙে গেছে সুপ্রিম কোর্ট আঙিনায় চলমান রাজনৈতিক সংঘর্ষের চিত্র দেখে। বাংলাদেশ আমলে তো এমন ঘটনা ঘটেইনি, পাকিস্তান আমলেও নয়। তাই ব্যথিত চিত্তে একজন আইনজীবী মন্তব্য করেছেন, ''সহকর্মীর জানাজা পড়ে কী হবে? রবিবার বিরোধী দলের মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি ঘিরে তো সুপ্রিম কোর্টেরই জানাজা হয়ে গেছে।'' তার এ মন্তব্য কালো গাউন পরা পেশাদার আইনজীবীদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। দলকানা আইনজীবীদের হৃদয় স্পর্শ করেছে কিনা জানা যায়নি। যে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি দেশের বিত্তশালী শিল্পপতি থেকে গ্রামের অক্ষর না জানা অতি সাধারণ দরিদ্র মানুষও সম্মান, শ্রদ্ধা, আস্থা ও সমীহ পোষণ করেন, সেখানে ক্ষমতার লড়াইয়ের অংশীদার বিভক্ত রাজনীতির অসুস্থ দুটি শক্তি তা দেখাতে পারে না। একদিকে আইন পেশার সঙ্গে জড়িত বিএনপি-জামায়াত শিবিরের আজ্ঞাবহ দাস, অন্যদিকে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী যেভাবে রবিবার সুপ্রিম কোর্ট আঙিনার পবিত্রতা নষ্ট করেছে তা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ও চলমান বিধিবিধানবলে এখনই রুখে দাঁড়াতে হবে। অতীতে সুপ্রিম কোর্টে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মিছিল, মহড়া ও প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারা থেকে শুরু করে বিদায় সংবর্ধনায় অনুপস্থিত থাকার ঘটনা দেখেছে বাংলাদেশ। এবার সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এস কে সিনহার মতো সম্মানিত মানুষের বাসভবনের সামনে বোমা হামলা হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ওপর রাতের লন্ডনে হামলা হয়েছে। বিচারপতি নাজমুন আরার বাসভবনের সামনে বোমা হামলা হয়েছে। বোমা হামলা হয়েছে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের বাসভবনের সামনে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের বাড়িতে ককটেল ও পেট্রলবোমা হামলা চালানো হয়। বিচারবিভাগের ওপর এ ধরনের নাশকতা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি সর্বসম্মতভাবে নিন্দা প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখাতে পারেনি। কালো গাউনের নীতি ও আদর্শকে ঊধের্্ব তুলে ধরে রাজনৈতিক হীনম্মন্যতা আড়াল করে বিভক্ত আইনজীবীরা একমঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ পর্যন্ত জানাতে পারেননি। ন্যায়বিচার চাইবেন, গণতন্ত্র চাইবেন অথচ সুপ্রিম কোর্টের সম্ভ্রম রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারবেন না এটি শুধু আইন ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িতদের জন্যই নয়, আমাদের জন্যও লজ্জার।

রবিবারের বিরোধী দলের মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ আগেই নিষিদ্ধ করেছিল। বিএনপির নেতা-কর্মীরা মাঠে নামতে পারেননি। সুপ্রিম কোর্টের ভেতর বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা সমবেত হয়েছেন, মিছিল করেছেন। আমরা অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, রাজনৈতিক দৃঢ়তা নিয়ে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে বিএনপির সিনিয়র পর্যায়ের নেতা লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ড. ওসমান ফারুক ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে যেতে পারেননি। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে দল ও তাদের নেত্রীর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়ার সাহস দেখাতে পারেননি। অথচ তাদের মতো বিজ্ঞজনরা যেটি করেছেন সেটি আমাদের বিস্মিত করেছে। অতীতে বিরোধী দলের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন নেমে এলেও কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা সুপ্রিম কোর্ট আঙিনায় মিছিল-সমাবেশ করেননি। কিন্তু রবিবার বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীদের মিছিলে যোগ দিয়ে বিএনপির এই তিন নেতা নতুন নজির স্থাপন করলেন। আর সুপ্রিম কোর্ট আঙিনায় দলীয় নেতাদের মিছিল দেখেই পুলিশ প্রধান ফটক আটকে দিয়েছিল। ফটকের ভেতরে পুলিশের জলকামান ব্যবহারের পরও বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা সরে দাঁড়াননি। বিএনপি নেতারা মিছিল করার সুবাদে সুপ্রিমকোর্ট আঙিনায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। আর সেই ফাঁদে পা দিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল কর্মীরা প্রধান ফটক খুলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন। দুই পক্ষ নির্লজ্জ ও নগ্ন রাজনীতির ছোবলে কী করুণভাবেই না সুপ্রিম কোর্ট আঙিনাকে কলঙ্কিত করলেন! গোটা দুনিয়া স্তম্ভিত হয়ে দেখল চলমান রাজনৈতিক সংঘর্ষ থেকে দেশের মানুষের আস্থার জায়গা, সম্মানের পবিত্র মাটি সুপ্রিম কোর্ট এলাকা রক্ষা পেল না! কীভাবে কর্দমাক্ত হয়ে গেল!

সুপ্রিম কোর্টে অতীতে সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা গেছেন, হলরুমে আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। কিন্তু রাজপথের সংঘাত-সংঘর্ষকে, মিছিল-সমাবেশকে কখনোই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ঠাঁই দেওয়া হয়নি। একজন নাগরিকের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। যুগে যুগে দুনিয়াজুড়ে আইনজীবীরাই রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভূমিকা রেখেছেন। আইনজীবীদের প্রাধান্য রাজনীতিতে থাকুক আমরা চাই। তাই বলে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে রাজনীতি নয়। রাজনীতির সে াতে গা ভাসাতে নয়াপল্টন হোক আর পল্টন ময়দানই হোক সেখানেই যেতে হবে। এককালের প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড বলা হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। শিক্ষকদের দলকানা রাজনীতির দাসত্ব সেই মর্যাদার আসনে আর রাখেনি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। ডাকসুকে এক সময় সেকেন্ড পার্লামেন্ট বলা হতো। ছাত্রসমাজকে বলা হতো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। ডাকসু নির্বাচন বন্ধ করে দিয়ে সেকেন্ড পার্লামেন্টের মৃত্যুই ঘটানো হয়নি, ছাত্ররাজনীতিকে মেধাহীন অছাত্র টেন্ডারবাজদের হাতে তুলে দিয়ে বন্ধ্যা করা হয়েছে। এই ছাত্ররাজনীতি এখন আর বাহান্ন থেকে ঊনসত্তরের গৌরবময় রাজনীতির উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে না। একালের ছাত্ররাজনীতি আইবুড়োদের হাত ধরে নেতানেত্রীদের বন্দনা করে আর মূল্যবোধহীন আদর্শের পথ ধরে হাঁটে। একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিতে ছাত্রদের উত্তাল মিছিল দেখা যায়নি। একটি দলদাস গ্রুপকে দেখা গেছে। গণতন্ত্রের উজ্জ্বল দ্বীপ জাতীয় প্রেসক্লাব আঙিনাকেও রবিবার বিভক্ত রাজনীতির অসুস্থ ধারার আগ্রাসনের শিকার হতে হয়েছে। দুই দলের আজ্ঞাবহ, সুবিধা কুড়ানো নেতৃত্বনির্ভর দুটি সে াত বহমান। বিএনপি-জামায়াতপন্থি সাংবাদিকরা কিছু কিছু বহিরাগত নিয়ে প্রেসক্লাবের পবিত্র মাটিতে সমাবেশ করে মিছিল নিয়ে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এখানে প্রেসক্লাবের প্রধান ফটক খুলে প্রবেশ করতে না পারলেও আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল কর্মীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছেন। সরকারি দলের অনুগতরাও মিছিল করেছেন। সাংবাদিকদের ঐক্য ও গৌরবের প্রতীক জাতীয় প্রেসক্লাব আঙিনায় যুগে যুগে গণতান্ত্রিক শক্তির বরেণ্য নেতারা গণবিরোধী শাসকের বিরুদ্ধে আশ্রয় নিয়েছেন, কর্মসূচি দিয়েছেন। সেই ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করে সাংবাদিকতার নীতি আদর্শকে পদদলিত করে বিভক্ত রাজনীতির ধারা এখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কারও রাজনীতি করার খায়েশ থাকলে পছন্দের মঞ্চে যেতেই পারেন। কিন্তু বাইরের রাজনীতিকে টেনে এনে জাতীয় প্রেসক্লাবের মানমর্যাদা ও অহংকারের ঐতিহ্য ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার সুযোগ কারও নেই। দলীয় দাসত্বের আজ্ঞাবহতা দেখাতে গিয়ে যারা প্রেসক্লাবের মানমর্যাদা মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন তাদের ব্যাপারেও আজকে পেশাদার সাংবাদিকদের দাঁড়ানোর সময় এসেছে। একদিকে বিরোধী দলের সহিংস সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি, অন্যদিকে সরকারের একগুঁয়েমি ও সমঝোতার পথ ছেড়ে দমননীতি দেশবাসীকে এক ঘোর অন্ধকার সময়ের মুখোমুখি করেছে। বিরোধী দলের আন্দোলনে ককটেল বোমা ও পেট্রলবোমা আর নাশকতা সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে কর্মসূচি যতটা না আঘাত হানছে তার চেয়ে বেশি সাধারণ মানুষ ও দেশের অর্থনীতির ওপর ভয়ঙ্কর আঘাত হানছে। মানুষের জীবন নিরাপদহীন, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ওয়ান-ইলেভেনের অবস্থা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সরকার যেমন দায় এড়াতে পারে না মানুষের জানমালের ক্ষতি সাধনের, তেমনি বিরোধী দলও সমান দায় বহন করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। এ পরিস্থিতিতে সংঘাতময় রাজনীতির বাইরে দেশের অর্থনীতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় সর্বাত্দক পদক্ষেপ সরকারকে যেমন নিতে হবে, বিরোধী দলকেও ভাবতে হবে দেশ ও অর্থনীতি না থাকলে কীসের রাজনীতি? একই সঙ্গে বিচারবিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের ওপর যে আঘাত আসছে সেখানে সরকারকে যেমন কঠোর হতে হবে, তেমনি বিরোধী দলকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। প্রয়োজনে সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পেশাদারি কর্মকাণ্ডের বাইরে সুপ্রিম কোর্ট আঙিনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট আঙিনার পবিত্রতা রক্ষা করতে, বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নয়, আইন পেশার সঙ্গে জড়িত নাগরিকগণ ও গণমানুষকে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়। যারা টেলিভিশন পর্দায় সুপ্রিম কোর্টের রবিবারের দৃশ্য দেখেছেন, রণক্ষেত্রের চিত্র অবলোকন করেছেন, এমনকি গতকাল বাহির থেকে যুব মহিলা লীগের কর্মীদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত আইনজীবীদের ভেতর থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপের করুণ অবস্থা দেখেছেন তারা সবাই ব্যথিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে মুখ খারাপ করা গালমন্দ- সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়। এটি বরদাস্ত করা যায় না। এই অসুস্থ শক্তিকে রুখতেই হবে। যারা ভেতরে পরিবেশ নষ্ট করছে, যারা বাহির থেকে হামলা করছে_ উভয়েই আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধ শক্তি। এই শক্তিকে রুখতেই হবে। এদের হাতে সুপ্রিম কোর্টের জানাজা পড়তে দেওয়া যায় না। পবিত্রতা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.